ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা কি জান, আমাদের দেশের
এক কোনে, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে
উঁচু উঁচু পাহাড়, ঘন সবুজ বন, ঝর্ণা,
মেঘে আর প্রাকৃতিক শোভায় সুন্দর এক জনপদ? রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান– এই তিনটি জেলা নিয়ে
গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রাম এই জনপদের নাম। পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে সেখানে আনুমানিক প্রায়
১৫ লাখ লোক বাস করেন।
প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষে
দুর্গম বান্দরবান জেলাটি আয়তন প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গ কিলোমিটার। এদেশের সব চেয়ে উঁচু পাহাড়, তাজিনডং (উচ্চতা ৯৮৭ মিটার, ৪,৫৯৯ ফিট) এই
জেলাতেই রয়েছে, এর আরেক নাম বিজয় বা মদক মুয়াল। উচ্চতার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কেওক্রাডং
(উচ্চতা ৮৮৪ মিটার, ৩,১৭২ ফিট)। এসবই
সরকারি পরিসংখ্যান।
তবে সম্প্রতি
ব্রিটিশ অভিযাত্রী জিঞ্জ ফুলেন দাবি করেছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে গহীন
অরণ্যে আরো দুটি পর্বত চূড়া রয়েছে, এগুলো হলো- মদক তাং (২,৯৬৯ ফিট) এবং পূর্ব
সীমান্তের আরেক চূড়া মদক মুয়াল (৩,২২৯ ফিট)। ফুলেনের হিসেব সঠিক হলে কেওক্রাডং-এর অবস্থান
উচ্চতার দিক থেকে হবে তৃতীয়।
বান্দরবানের মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখ,
তাদের মধ্যে আবার অর্ধেকেরও বেশি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। মারমা ও ম্রো জনগোষ্ঠি সংখ্যাই পাহাড়িদের মধ্যে
বেশি। আরো আছেন বম, লুসাই, খুমি, খেয়াং, চাকমা, চাক, পাংখো, ত্রিপুরাসহ ১৩টি
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। সংখ্যায় কম হলেও প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজ নিজ ভাষা,
আলাদা সাজ-পোষাক, ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি।
বন্ধুরা, তোমাদের আরেকটি তথ্য জানাই।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা "পাউবো" এ দেশের নদ-নদীগুলোকে
সংখ্যাবদ্ধ করেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ি, বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা এখন
৪০৫টি। এরমধ্যে মাত্র দুটি নদ-নদী শঙ্খ ও মাতামুহুরি-র জন্ম এপারে, বান্দরবানেই। আর
বাকী সব নদ-নদীর উৎসস্থল ভারত ও নেপালে। আজকে আমরা জানবো, পাহাড়ি নদ শঙ্খের কথা। এটি বান্দরবান জেলার
প্রধান জল প্রবাহ। আর এ নদকে ঘিরে আদিকাল
থেকে সেখানে চাষাবাদ, যোগাযোগ, মাছের ব্যবসা ইত্যাদি গড়ে উঠেছে।
মায়নমার সীমান্তের দুর্গম মদক পাহাড়ে শঙ্খ
নদের উৎপত্তি। দুষ্টু পাহাড়ি বালকের মতো চঞ্চল-অস্থির শঙ্খ নদ। এটি
অনেক উঁচু উঁচু দুর্গম পাহাড়, গহিন বন, অনেক পাহাড়ি
জনপদ ছুঁয়ে খলবল করে ছুটে চলেছে বান্দরবানের ভেতর দিয়ে। পরে এই নদ এঁকেবেঁকে দীর্ঘ
পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম জেলার সীমানা ঘেঁষে বয়ে গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।
বান্দরবানে শঙ্খ নদের দুপাড়ে বসবাসকারী
অধিকাংশই মারমা ও ম্রো জাতিগোষ্ঠির মানুষজন। তাদের অধিকাংশের পেশা জুম চাষ (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ
এক ধরণের ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদের নাম - জুম)।
অবাক হওয়ার মতো কথা, এই নদটির নাম বাংলায় ‘শঙ্খ‘ কেন, তার কোনো
ঐতিহাসিক তথ্য নেই। তবে অনেকে মনে করেন, সেই ব্রিটিশ আমলে বাঙালি
আমলারা গেজেটিয়ার করার সময় এটিকে ‘শঙ্খ‘ নদ’ হিসেবে নথিভূক্ত করেন। যদিও শঙ্খ বা শাঁখ
বলতে যে ধরণের সাদা সামূদ্রিক শামুকের কথা বোঝায়, নদের
দুপাড়ে কখনোই এমন শঙ্খের অস্তিত্ব ছিল না।
সম্ভবত ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য
চট্টগ্রাম গেজেটিয়ার প্রকাশ করার সময় ব্রিটিশ শাসকেরা ইংরেজীতে একে ‘সাঙ্গু‘ (Sangu) নদ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে
মারমা জাতিগোষ্ঠীর পাহাড়িরা শঙ্খ নদকে আদিকাল থেকে তাদের ভাষায় ‘রিগ্রাই খিয়াং‘ অর্থাৎ ‘স্বচ্ছ নদ‘ নামে ডেকে আসছেন।
পাহাড়ি এলাকার প্রকৃতি অনুযায়ী, পাহাড়ের
চূড়া থেকে বেয়ে নেমে আসে অসংখ্য ছোটবড় ঝর্ণা। এসব ঝর্ণা মিলে তৈরি হয় থেকে ছোট ছোট অনেক পাহাড়ি নদ বা ছড়া। আবার এসব ছড়া এসে মিশেছে
শঙ্খ নদে, প্রাণ দিয়েছে খরস্রোতা নদটিকে। এমনিতে নদটি বেশ
শান্তশিষ্ট, উচ্ছল। কিন্তু বর্ষাকালে এর রূপ ভয়ংকর। তখন এ নদে তীব্র স্রোতে সাঁতার
কাটা বা নৌকা চালানো খুবই ঝুকিঁপূর্ণ।
বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ঝর্ণা ও ছড়া বেয়ে এসে
জমে শঙ্খ নদে। তখন দেখা দেয় ভয়ংকর পাহাড়ি ঢল। আবার এসব ঢলের কারণে নদের দুকূলে পড়ে প্রচুর পরিমানে পলিমাটি। কোনো ধরণের
সার বা কীটনাশক ছাড়াই সেখানে অনায়াসে চাষ করা যায় মৌসুমের ধান, ডাল, শাক-সব্জি, বাদাম
ও দেশি তামাক পাতা।
আবার শুকনো মৌসুমে কমে যায় শঙ্খ নদের গভীরতা। তখন
কোথাও গলা পানি, আবার কোথাও কোমড় বা হাঁটু পানি
থাকে। নদের তলায় বিভিন্ন ধরণের
প্রাকৃতিক পাথুরে কূপের দেখা মেলে। আর সে সব কূপে পাওয়া যায় ছোট-বড় বিভিন্ন
ধরণের মাছ। এছাড়া শুকনো মৌসুমে নদে রুই-কাতল, কালি ঘোইন্না,
বেলে, গলদা চিংড়ি, শোল, মাগুর, সিং,
মৃগেল ইত্যাদি মাছ ধরাও চলে।
প্রকৃতি গবেষকরা জানিয়েছেন, মাত্র ৫০ বছর আগেও
শঙ্খ নদের দুপাশে ছিল প্রচুর ঘন প্রাকৃতিক বন। এর মধ্যে নাম না জানা
কয়েক ধরণের অসংখ্য বড় বড় গাছপালা, বাঁশ ও বেতের নিবিড়
ঘনবন তো ছিলই। সে সময় এই বনে বড় বড় হাতি,
বাঘ, কালো ও লালচে ভালুক, বুনো শুকর, সাম্বার হরিণ, দেশি লাল হরিণ, জংলি গয়াল, বন মোরগ, মথুরা, ময়ুর,
হনুমান, উল্লুক, কয়েক রকমের বানর, কয়েক ধরণের বন বেড়াল,
অজগর সাপসহ প্রচুর পরিমানে বন্য প্রাণীর দেখা মিলতো।
কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দিন দিন পাহাড়
কাটা ও বন উজাড়ের সংখ্যা হচ্ছে। ক্রমেই কমে আসছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা। অন্যদিকে
পাহাড়ে বনের গাছগুলোর শেকড় মাটি আবদ্ধ করে রাখে। কিন্তু বন উজাড়ের ফলে এখন অতিবৃষ্টিতে
বেলে মাটির পাহাড় ও টিলাগুলো প্রায়ই ধসে পড়ে। এসব পাহাড়ের মাটি এসে মিশছে শঙ্খ নদে।
আর নদটি হারাচ্ছে তার গভীরতা। গত জুলাই মাসেই টানা বৃষ্টিতে শঙ্খ নদ উপচে পানি
ঢুকে পড়ে বান্দরবান শহরে। চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়ে টানা চারদিন
সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আবার শঙ্খ নদ প্রতিনিয়ত ভড়াট হতে থাকায় ক্রমেই
কমছে এর অঢেল মৎস্য সম্পদ। ইঞ্জিন নৌকার সংখ্যা বাড়ায় মাছেরা স্বাভাবিক বংশ
বিস্তার করছে না। রুমা-থানচি এলাকায় তামাকের দেদার চাষ হচ্ছে। এসব তামাক ক্ষেতের
কীটনাশক বৃষ্টিতে ধুয়ে মিশছে শঙ্ঘ নদের পানিতে। ফলে মারা যাচ্ছে ছোট-বড় অনেক মাছ, শামুক, ঝিনুকসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। আবার তামাক পাতা নদের পানিতে ধোয়ার কারণেও শঙ্খের পানিতে মিশছে তামাকের বিষ।
এছাড়া পাথর ব্যবসায়ীরা রুমা-ক্রেওক্রাডং-রোয়াংছড়িতে
শঙ্খ নদ থেকে ইচ্ছেমতো পাথর তুলছেন। এতে সে সব এলাকায় দেখা দিচ্ছে ভাঙণ। সব মিলিয়ে
ছোট্ট এই পাহাড়ি নদটি এখন বেশ কিছুটা হুমকির মুখে।
আর বুঝতেই পারছো, এ নদটি পুরোপুরি বিষিয়ে
গেলে বা ভরাট হয়ে মজে গেলে বান্দরবানের শঙ্খ পাড়ের বিশাল পাহাড়ি-বাঙালি গোষ্ঠি কি ভয়ানক বিপন্নতার
মধ্যে পড়বেন! আর নদের দুপারের পাহাড়ের ঘন বন পুরোপুরি উজাড় হয়ে গেলে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতির
কি বিশাল ক্ষতি হবে! তাই মানুষের নিজেদের স্বার্থেই উচিৎ হবে বন, পাহাড়, নদ-নদী, ঝর্ণা, বন্যপ্রাণী
ইত্যাদি সব প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীব-বৈচিত্র রক্ষা করা, এদের সুন্দরভাবে সংরক্ষণ
করা। তোমরা বড় হয়ে এ বিষয়ে নিশ্চয়ই আরো জানবে।
--
এই লেখাটিতে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন বান্দরবানের পরিবেশকর্মী জুয়ামলিয়ান
আমলাই, কেওচিং কারবারি এবং রুমার বাসিন্দা
এল. দৌলিয়ান বম। এছাড়া ইউকিপিডিয়া থেকেও অনেক তথ্য নেওয়া হয়েছে।
ছবি
: শঙ্খ নদ, লেখক।
No comments:
Post a Comment