পৃথিবীতে যুদ্ধ দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে ন্যায় যুদ্ধ, আরেকটি হচ্ছে অন্যায় যুদ্ধ। আমরা ন্যায় যুদ্ধের পক্ষে। — মাও সে তুং
গেরিলা যুদ্ধের পটভূমি১৯৬০ সালের কাপ্তাই জলবিদ্য্ৎু প্রকল্পের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৫৪ হাজার একর চাষযোগ্য ভূমি জলমগ্ন হয়। এতে ভিটেমাটি হারিয়ে পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হন প্রায় এক লাখ মানুষ। জমিজমা হারিয়ে অনেক পাহাড়ি পরিবার ঘরবাড়ি স্থানান্তরের পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরা, অরুণাচল ও মিয়ানমারের মিজোরামেও পাড়ি জমান। কাপ্তাই লেকের পানিতে তলিয়ে যায় রাঙামাটির নান্যারচর থানার মাওরুম নামক এম এন লারমার নিজস্ব গ্রামটিও। কিশোর এম এন লারমা এর আগে ভিটেমাটির এক মুঠো মাটি কাগজে মুড়ে তাঁর বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনুকে দিয়ে বলেছিলেন, তিনি যেন এই মাটিটুকু সযত্নে সংরক্ষণ করেন। [১] ধারণা করি, উন্নয়নের নামে ভিটেমাটি হারানোর বেদনা এম এন লারমা সারা জীবন বহন করেছিলেন।
পরে ১৯৬৩ সালে তিনি কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ছাত্র সম্মেলন সংগঠিত করতে গিয়ে কারাবরণও করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনোক্রমেই পাহাড়িদের বন্ধু নয়। এ কারণে পাহাড়ি ছাত্র সমিতিতেও এম এন লারমা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করলেও মং রাজা মং প্রু সেইন, কে কে রায় ও এম এন লারমা প্রমুখ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁরা তরুণ পাহাড়িদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য সংগঠিত করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।
কিন্তু তৎকালীন রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ত্রিপুরায় সন্দেহবশত ‘চাকমাদের জবাই করার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁরই প্রত্যক্ষ মদদে সে সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আসা এম এন লারমাসহ বেশ কিছু পাহাড়ি যুবককে ত্রিপুরায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাদের যুদ্ধে যোগ দিতে দেওয়া তো হয়ই নি, উপরন্তু কয়েকজন পাহাড়ি যুবককে হয়রানিমূলক শাস্তিও পেতে হয়। [২]
এছাড়া ১৯৭১ সালে কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা ও বিডিআর (এখন বিজিবি) রামগড়, পানছড়ি ও বরকলের পাহাড়ি জনপদে বড় ধরনের অপারেশন চালিয়ে গণহত্যা, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ত্রিপুরা রাজ্য ভ্রমণে এলে এসব লোমহর্ষক ঘটনার বিচার দাবি করে সেখানের আশ্রিত পাহাড়িরা তাঁকে একটি স্মারকলিপি দেন। ওই স্মারকলিপিতে এর বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়। [৩]
এসব কারণে বাংলাদেশ নামক বাংলাভাষীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্নে এমএন লারমা ১৯৭৩ সালেই বুঝেছিলেন, আঞ্চলিক শায়ত্তশাসন ছাড়া ভাষাগত সংখ্যালঘু, তথা পাহাড়ি আদিবাসীর মুক্তি নেই। তাই তিনি স্বতন্ত্র সাংসদ ও জনসংহতি সমিতির আহবায়ক হিসেবে সংসদ অধিবেশনে তুলে ধরেছিলেন পাঁচ দফা দাবিনামা। এগুলো হচ্ছে :
‘ক. আমরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাসমেত পৃথক অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পেতে চাই। খ. আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার থাকবে, এ রকম শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন চাই। গ. আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষিত হবে, এমন শাসনব্যবস্থা আমরা পেতে চাই। ঘ. আমাদের জমিস্বত্ব, জুম চাষের জমি ও কর্ষণযোগ্য সমতল জমির স্বত্ব সংরক্ষিত হয়, এমন শাসনব্যবস্থা আমরা পেতে চাই। ঙ. বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে যেন কেউ বসতি স্থাপন করতে না পারে, তজ্জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার প্রবর্তন চাই।’…১৯৭২ সালের খসড়া সংবিধান রচনার কালেও উপেন্দ্র লাল চাকমা, এম এন লারমাসহ পাহাড়ি নেতারা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাবনা নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে তাৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবনাটি তীব্রভাবে নাকচ করেন। তিনি প্রতিনিধিদলকে সৌজন্যবশত বসতেও বলেননি। উপরন্তু তাঁদের মুখের ওপর প্রস্তাবনার ফাইল ছুড়ে মেরেছিলেন। [৪]
আর এভাবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে চরমভাবে উপেক্ষিত হয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি। বর্তমান সংবিধানের মতো সেখানেও ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’–এমন কথা বলা হয়। শুধু তাই নয়, ১৪ জুন ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব রাঙামাটির জনসভায় পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা সবাই বাঙালি হইয়া যাও। আমি তোমাদের উপজাতি থেকে জাতিতে প্রমোশন দিলাম’। [৫]
আমাদের নীতি হচ্ছে পার্টি বন্দুককে কমান্ড করবে, বন্দুক পার্টিকে কখনোই নয়। — মাও সে তুং
এম এন লারমার গেরিলা জীবন
ধারণা করি, এসব বঞ্চনার ঘটনা এমএন লারমাকে গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পাহাড়ি ছাত্র সমিতি সংগঠিত করার সময়ই এম এন লারমা বুঝেছিলেন, পশ্চাৎপদ জুম্ম (পাহাড়ি) জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে তাদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার সবার আগে প্রয়োজন। কারণ একজন শিক্ষিত মানুষ তার বাকি চারটি মৌলিক চাহিদা–অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার শর্ত পূরণে সক্ষম। তাই তিনি সহকর্মীদের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি বেসরকারি স্কুল খোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন।
এ কারণেই এম এন লারমা থেকে শুরু করে শান্তিবাহিনীর শীর্ষ নেতারা সকলেই ছিলেন স্কুল-কলেজের শিক্ষক। তাই অনেকেই শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামটিকে চিহ্নিত করেন ‘মাস্টার্স রেভল্যুশন’ নামে। আর গেরিলা গ্রুপ গঠন করে নিজ দেশেই সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দাবি আদায় সম্ভব, জনসংহতি সমিতির মধ্যে এই ধারণাটি সম্ভবত এসেছিল লাল ডেঙ্গার নেতৃত্বাধীন গেরিলা গ্রুপ মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) মাধ্যমে। মিজো বাহিনী ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত রাঙামাটির বিলাইছড়ি ও বান্দরবানের ক্রেওক্রাডং-এর পাহাড়ে অবস্থান করেছে। আর তারা দাবি করেছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ‘মিজোল্যান্ড বা মিজোরা ‘। এ কারণে ওপরে উদ্ধৃত এম এন লারমার সংসদ ভাষণের ছায়ায় ১৯৭৩ সালে জনসংহতি সমিতি তথা গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর সংশোধিত পাঁচ দফার প্রথম দাবিটিই ছিল এ রকম: ‘সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রাদেশিক অঞ্চলের মর্যাদা দিতে হইবে। এই অঞ্চলের নাম হইবে জুম্মল্যান্ড।‘
তবে সাবেক গেরিলা নেতারা এই লেখককে জানিয়েছেন, মিজো বাহিনীর কাছ থেকে শান্তিবাহিনী কখনো অস্ত্র ও প্রশিক্ষণগত সহায়তা পায়নি। উপরন্তু বেশ কয়েকবার তাদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষও হয়েছে। আর গবেষকরা জানাচ্ছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে মিজো বাহিনীকে পাকিস্তান সরকার ব্যবহার করেছে।
বলা ভালো, এই উপমহাদেশে সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম, আদিবাসী বিদ্রোহ যেমন হয়েছে, তেমনি মাস্টার দা সূর্য সেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামদের মতো বীর যোদ্ধারা গেরিলা সংগ্রামও করেছেন। আর ১৯৬৬ সালের চীনা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঢেউ আছড়ে পড়লে এদেশের চীনাপন্থী কমিউনিস্টরাও ভারতের চারু মজুমদারের সশস্ত্র সংগ্রামের তত্বকে অনুসরণ করেন। মাওবাদীরা সে সময় চিহ্নিত হন ‘নকশাল‘ নামে। সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টিও মাওবাদিতা অনুসরণ করে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে কৃষক মুক্তি, তথা সশস্ত্র বিপ্লবের চেষ্টা চালায়। কিন্তু লক্ষণীয়, সাতের দশকের মাওবাদী গ্রুপগুলোর প্রতিটিই জনবিচ্ছিন্নতায় গোষ্ঠী বিপ্লব, তথা অস্ত্রনির্ভর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এরই ফলে দেখা দেয় একাধিক উপদলীয় কোন্দল, শক্তিক্ষয়, অস্ত্রের যথেচ্ছ ভুল ব্যবহার। এসব কারণে দেশপ্রেম ও চরম আত্মত্যাগ সত্ত্বেও স্বাধীনতার পরে এই চরমপন্থী দলগুলোর অন্তিম পরিণতি সকলেরই জানা। [৬]
এদিক থেকে তুলনামূলক বিচারে একমাত্র ব্যতিক্রম এম এন লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম। কারণ সত্যিকার অর্থেই জনসংহতি সমিতির এই সামরিক শাখাটি গড়ে উঠেছিল জনযুদ্ধের ভিত্তিতে, অর্থাৎ জনগণের ভেতর থেকে জনগণের জন্য গড়ে ওঠা যুদ্ধ। আবার বৃহত্তর অর্থে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধটিও ছিল সফল গেরিলা যুদ্ধ। যদিও এই গেরিলা যুদ্ধের মূল নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর কাছে অনেকটাই সমর্পিত হয়েছিল। সেটি অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আর এম এন লারমা যেমন বলেন, ‘নেতৃত্বের মৃত্যু আছে, আদর্শের মৃত্যু নেই’, তাঁর কথার সত্যতা দেখি, দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের রণনীতিকে কেন্দ্র করে শান্তিবাহিনীর প্রায় তিন দশকের সশস্ত্র সংগ্রাম। এই জনযুদ্ধের চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে উপদলীয় কোন্দলে বিভেদপন্থী প্রীতি গ্রুপের হাতে এমএন লারমার মৃত্যু পর্যন্ত হয়। কিন্তু আদর্শিক দৃঢ়তার কারণে জ্যোতিরিন্দ্রি বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমাসহ শীর্ষস্থানীয় গেরিলা নেতারা যুদ্ধটিকে এগিয়ে নেন। শান্তিচুক্তিতে এর যৌক্তিক পরিণতি ঘটে, সে কথা আগেই বলা হয়েছে।
লক্ষণীয়, শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র যুদ্ধটি ছিল চরম জাতিগত নিপীড়ণের বিরুদ্ধে জুম্ম (পাহাড়ি) জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধের লড়াই। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর এম এন লারমা (ছদ্মনাম প্রবাহন) অন্তর্দলীয় সংঘাতে নিহত হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে অনুজ সহোদর সন্তু লারমাকে (ছদ্মনাম তুং) লেখা এক হাতচিঠিতে বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। দিকনির্দেশনামূলক ওই সংক্ষিপ্ত চিঠিতে সবশেষে প্রবাহন লেখেন, ‘আমরা টেরোরিস্ট নই। আমরা আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ, অর্থাৎ জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণে সংগ্রামী। আমরা কারো টেরোরিস্ট হবো না, হতেও চাই না।’ [৭]
আবার স্বাধীনতার পর তুমুল বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারের বিপরীতে এম এন লারমাই প্রথম দেশের এক-দশমাংশ পার্বত্যাঞ্চলের ১৩ ভাষাভাষী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে জনসংহতি সমিতি, তথা শান্তিবাহিনীর ব্যানারে সংগঠিত করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন, আদিবাসী পাহাড়িরা কোনোক্রমেই বাঙালি নয়। তাদের রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও ঐতিহ্য। এ কারণেই এমএন লারমাকে বলা হয় জুম্ম জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত।
কোনো কোনো মৃত্যু আছে, তাই পাহাড়ের ওজনের চেয়েও ভারী। কোনো কোনো মৃত্যু আছে, বেলেহাঁসের পালকের চেয়েও হালকা। –মাও সে তুং
এম এন লারমার হত্যাকারী কারা?এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে সে সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এম এন লারমার মৃত্যুসংবাদের চুম্বক অংশটুকু পাঠ করা যাক। ‘শান্তিবাহিনী প্রধান মানবেন্দ্র লারমা নিহত’ এই শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয় :
লক্ষণীয়, প্রীতি গ্রুপের প্রীতি, গিরি, দেবেন ও পলাশ–এই চার প্রধান নেতার সঙ্গে এমএন লারমা গ্রুপের শান্তি সংলাপ চলার সময়েই আকস্মিকভাবে ওই হামলায় এম এন লারমা নিহত হন। আরো লক্ষণীয়, সংবাদপত্রে উদ্ধৃত ‘ভারতপন্থী প্রীতি দলের নেতা প্রীতি চাকমা’ এবং তার অনুসারীরা ১৯৮৩ সালের পর অধিকাংশই জেনারেল এরশাদ সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। [৯]
লক্ষণীয়, শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র যুদ্ধটি ছিল চরম জাতিগত নিপীড়ণের বিরুদ্ধে জুম্ম (পাহাড়ি) জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধের লড়াই। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর এম এন লারমা (ছদ্মনাম প্রবাহন) অন্তর্দলীয় সংঘাতে নিহত হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে অনুজ সহোদর সন্তু লারমাকে (ছদ্মনাম তুং) লেখা এক হাতচিঠিতে বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। দিকনির্দেশনামূলক ওই সংক্ষিপ্ত চিঠিতে সবশেষে প্রবাহন লেখেন, ‘আমরা টেরোরিস্ট নই। আমরা আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ, অর্থাৎ জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণে সংগ্রামী। আমরা কারো টেরোরিস্ট হবো না, হতেও চাই না।’ [৭]
আবার স্বাধীনতার পর তুমুল বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারের বিপরীতে এম এন লারমাই প্রথম দেশের এক-দশমাংশ পার্বত্যাঞ্চলের ১৩ ভাষাভাষী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে জনসংহতি সমিতি, তথা শান্তিবাহিনীর ব্যানারে সংগঠিত করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন, আদিবাসী পাহাড়িরা কোনোক্রমেই বাঙালি নয়। তাদের রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও ঐতিহ্য। এ কারণেই এমএন লারমাকে বলা হয় জুম্ম জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত।
কোনো কোনো মৃত্যু আছে, তাই পাহাড়ের ওজনের চেয়েও ভারী। কোনো কোনো মৃত্যু আছে, বেলেহাঁসের পালকের চেয়েও হালকা। –মাও সে তুং
এম এন লারমার হত্যাকারী কারা?এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে সে সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এম এন লারমার মৃত্যুসংবাদের চুম্বক অংশটুকু পাঠ করা যাক। ‘শান্তিবাহিনী প্রধান মানবেন্দ্র লারমা নিহত’ এই শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয় :
‘বাংলাদেশ জাতীয় পরিষদের প্রাক্তন সদস্য, তথাকথিত শান্তিবাহিনীর প্রধান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান মি. মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হইয়াছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়া গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাত্রে আমাদের রাঙামাটি সংবাদদাতা জানান, মি. লারমা গত ১০ই নভেম্বর সীমান্তের অপর পারে ভারতে ইমারা গ্রামে বাগমারা নামক স্থানে শান্তিবাহিনীর কল্যাণপুর ক্যাম্পে প্রতিদ্ব›দ্বী শান্তিবাহিনীর ‘প্রীতি’ গ্রæপের সদস্যদের হামলায় নিহত হইয়াছেন।
‘বিভক্ত শান্তিবাহিনীর মধ্যে মি. মানবেন্দ্র চীনপন্থী ও ঘাতক প্রীতি দলের নেতা প্রীতি চাকমা ভারতপন্থী বলিয়া পরিচিত। মানবেন্দ্র লারমার সহিত তাঁহার বড় ভাইয়ের শ্যালক মনি চাকমা, খাগড়াছড়ি হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক অপর্ণা চরম চাকমা, কল্যাণময় চাকমা ও লেফটেনেন্ট রিপনসহ শান্তিবাহিনীর আটজন সদস্য ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। শান্তিবাহিনীর ছয়-সাতজন কেন্দ্রীয় নেতাও এ হামলায় আহত হয়। ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত এই ক্যাম্পে শান্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতা সন্তু লারমা, রূপায়ণ দেওয়ান, ঊষাতন তালুকদারসহ অন্যান্য নেতার ভাগ্যে কী ঘটিয়াছে, তাহা এখনো জানা যায় নাই। সন্তু লারমাকেই মানবেন্দ্র লারমার পর শীর্ষ নেতা বলিয়া মনে করা হইত।’ [৮]
লক্ষণীয়, প্রীতি গ্রুপের প্রীতি, গিরি, দেবেন ও পলাশ–এই চার প্রধান নেতার সঙ্গে এমএন লারমা গ্রুপের শান্তি সংলাপ চলার সময়েই আকস্মিকভাবে ওই হামলায় এম এন লারমা নিহত হন। আরো লক্ষণীয়, সংবাদপত্রে উদ্ধৃত ‘ভারতপন্থী প্রীতি দলের নেতা প্রীতি চাকমা’ এবং তার অনুসারীরা ১৯৮৩ সালের পর অধিকাংশই জেনারেল এরশাদ সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। [৯]
তবে প্রীতি চাকমা নিজে ভারতের ত্রিপুরায় রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগে ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে এই লেখকের সঙ্গে প্রীতি চাকমার আগরতলার বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়। সে সময় তিনি লেখককে গণমাধ্যমের জন্য কোনো সাক্ষাৎকার বা ছবি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। প্রীতি চাকমার ‘ভারতপন্থা’ এবং ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের মধ্য দিয়ে এটি পরিষ্কার যে, এম এন লারমা হত্যাকাণ্ডে অবশ্যই ভারত সরকারের হাত রয়েছে। আবার একই সময়ে জে. জিয়াউর রহমানের ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে সামরিকীকরণের নীতি অব্যাহত রাখায় জে. এরশাদ সরকারের এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ইন্ধন থাকাও বিচিত্র নয়।
এনএন লারমার শিক্ষাএকটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন, এম এন লারমার সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার জন্য নয়, বরং পাহাড়ের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় শান্তি-সংলাপে বসার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিই ছিল এর লক্ষ্য। এ কারণে তাঁর নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে শান্তি-সংলাপের সুযোগও উন্মুক্ত রেখেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে শান্তি-সংলাপ অব্যহত রাখে, যার সূচনা এম এন লারমার জীবদ্দশাতেই হয়েছিল। এসব শান্তিসংলাপের ফল হিসেবে জনসংহতি সমিতির সংশোধিত পাঁচ দফার ভিত্তিতে সংবিধানের আওতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি। তবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের দুদশক পরেও পার্বত্যাঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের ভূমি সমস্যার সমাধান, পাহাড়ে আঞ্চলিক শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়াসহ এর মৌলিক শর্ত পূরণ হয়নি। সব মিলিয়ে চুক্তিটি অনেক আগেই পরিণত হয়েছে কাগুজে চুক্তিতে। সন্তু লারমা যেমন বলেন, সরকারগুলোর সদিচ্ছার অভাবে চুক্তিটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। উপরন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্নে সরকারগুলো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দানের পাশাপাশি সীমাহীন প্রতারণা করে চলেছে। [১০] তবে সে সবই ভিন্ন প্রসঙ্গ। [১১]
এ পর্যায়ে সমীকরণ টেনে বলা যায়, আত্মদানের মধ্য দিয়ে এম এন লারমার রাজনৈতিক শিক্ষা এক কথায়, আন্দোলনে অর্জন। পর্যবেক্ষণ বলছে, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্নে জনসংহতি সমিতি প্রকাশ্য রাজনীতিতে সেমিনার, মানববন্ধন, সমাবেশ এবং সংলাপ ছাড়া সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য সেভাবে রাজপথের সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি। এর বিপরীতে সব ধরনের জনমত উপেক্ষা করে সরকারগুলো একের পর এক বাধাহীনভাবে চুক্তিবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে। উপরন্তু রয়েছে রাজনৈতিক দেউলিয়া ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট)-এর শান্তিচুক্তি বিরোধী সশস্ত্র তৎপরতা, যার টার্গেট গ্রুপ প্রধানত জনসংহতি সমিতি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ কী?
উপসংহারের বদলে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা টেনে বলা যায়, লেখককে একাধিকবার পাহাড়ি বন্ধুমহলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যত কী? এমন গূঢ় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। জবাবে বিনয়ের সঙ্গে স্মৃতিচারণা করে উপস্থাপন করা হয়েছে ত্রিপুরা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তথ্য-সাংবাদিকতার পেশাগত কারণে লেখককে ১৯৯৬-৯৭ সালে পাহাড়ি শরণার্থী শিবিরসমূহ পরিদর্শনের জন্য বেশ কয়েকবার আগরতলাসহ ত্রিপুরার কয়েকটি অঞ্চল পরিদর্শন করতে হয়েছে। সে সময় লেখক প্রথমেই ধাক্কা খান যে, ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় ত্রিপুরা বা টিপরাদের দেখা আর মেলে না, অধিকাংশই বাঙালি, যাঁরা ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এপার থেকে পাড়ি জমিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ওপারে। অনেক চেষ্টা-চরিত্রের পর অবশেষে দেখা মেলে একজন বয়স্ক মতো টিপরা রিকশাচালকের। তিনি টিপরা কি না, জানতে চাইলে সেই পাহাড়ি ব্যক্তিটি খুব গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমি টিপরা। ত্রিপুরা রাজ্যে টিপরারা নেই কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রিকশাওয়ালার ঝটপট জবাব ছিল, আমরা আছি তো! আমরা আছি ওই উঁচুতে, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়, গহীন জঙ্গলে।
পার্বত্য সমস্যা সমাধানে, তথা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সেভাবে দুর্বার আন্দোলন গড়ে না উঠলে অদূর ভবিষ্যতে পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়িদের পরিণতি ত্রিপুরার টিপরাদের মতোই হবে, সে আশঙ্কা থেকেই যায়। এর বিপরীতে বটম পয়েন্টে, সিঁধু-কানহু, বিরসা মুণ্ডা, কুমুদিনী হাজং, এম এন লারমা, কল্পনা চাকমা, চলেশ রিছিল, পিরেন স্নাল প্রমুখর প্রদর্শিত সংগ্রামী পথটিই পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীর মুক্তির পথ। আর দীর্ঘতর ও রক্তে পিচ্ছিল আদিবাসীর সংগ্রামের পথে প্রগতিশীল বাঙালি জনগোষ্ঠীকেও পাশে থাকা চাই। তবে এর নেতৃত্বে ও কেন্দ্রে থাকবেন আদিবাসীরাই।
অন্যদিকে, পর্যবেক্ষণ বলছে, দাতাগোষ্ঠী বা চার্চের অনুদানে আর যাই হোক, অধিকার আদায়ের আন্দোলন হয় না। বরং এটি ভেতর থেকে ক্ষয় করে আদর্শিক চেতনার বিপ্লবী শক্তিকে।
[পুনর্লিখিত]
_________
*আরো দেখুন ঃ
এনএন লারমার শিক্ষাএকটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন, এম এন লারমার সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার জন্য নয়, বরং পাহাড়ের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় শান্তি-সংলাপে বসার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিই ছিল এর লক্ষ্য। এ কারণে তাঁর নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে শান্তি-সংলাপের সুযোগও উন্মুক্ত রেখেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে শান্তি-সংলাপ অব্যহত রাখে, যার সূচনা এম এন লারমার জীবদ্দশাতেই হয়েছিল। এসব শান্তিসংলাপের ফল হিসেবে জনসংহতি সমিতির সংশোধিত পাঁচ দফার ভিত্তিতে সংবিধানের আওতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি। তবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের দুদশক পরেও পার্বত্যাঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের ভূমি সমস্যার সমাধান, পাহাড়ে আঞ্চলিক শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়াসহ এর মৌলিক শর্ত পূরণ হয়নি। সব মিলিয়ে চুক্তিটি অনেক আগেই পরিণত হয়েছে কাগুজে চুক্তিতে। সন্তু লারমা যেমন বলেন, সরকারগুলোর সদিচ্ছার অভাবে চুক্তিটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। উপরন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্নে সরকারগুলো মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দানের পাশাপাশি সীমাহীন প্রতারণা করে চলেছে। [১০] তবে সে সবই ভিন্ন প্রসঙ্গ। [১১]
এ পর্যায়ে সমীকরণ টেনে বলা যায়, আত্মদানের মধ্য দিয়ে এম এন লারমার রাজনৈতিক শিক্ষা এক কথায়, আন্দোলনে অর্জন। পর্যবেক্ষণ বলছে, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্নে জনসংহতি সমিতি প্রকাশ্য রাজনীতিতে সেমিনার, মানববন্ধন, সমাবেশ এবং সংলাপ ছাড়া সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য সেভাবে রাজপথের সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি। এর বিপরীতে সব ধরনের জনমত উপেক্ষা করে সরকারগুলো একের পর এক বাধাহীনভাবে চুক্তিবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে। উপরন্তু রয়েছে রাজনৈতিক দেউলিয়া ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট)-এর শান্তিচুক্তি বিরোধী সশস্ত্র তৎপরতা, যার টার্গেট গ্রুপ প্রধানত জনসংহতি সমিতি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ কী?
উপসংহারের বদলে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা টেনে বলা যায়, লেখককে একাধিকবার পাহাড়ি বন্ধুমহলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যত কী? এমন গূঢ় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। জবাবে বিনয়ের সঙ্গে স্মৃতিচারণা করে উপস্থাপন করা হয়েছে ত্রিপুরা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তথ্য-সাংবাদিকতার পেশাগত কারণে লেখককে ১৯৯৬-৯৭ সালে পাহাড়ি শরণার্থী শিবিরসমূহ পরিদর্শনের জন্য বেশ কয়েকবার আগরতলাসহ ত্রিপুরার কয়েকটি অঞ্চল পরিদর্শন করতে হয়েছে। সে সময় লেখক প্রথমেই ধাক্কা খান যে, ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় ত্রিপুরা বা টিপরাদের দেখা আর মেলে না, অধিকাংশই বাঙালি, যাঁরা ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এপার থেকে পাড়ি জমিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ওপারে। অনেক চেষ্টা-চরিত্রের পর অবশেষে দেখা মেলে একজন বয়স্ক মতো টিপরা রিকশাচালকের। তিনি টিপরা কি না, জানতে চাইলে সেই পাহাড়ি ব্যক্তিটি খুব গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমি টিপরা। ত্রিপুরা রাজ্যে টিপরারা নেই কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রিকশাওয়ালার ঝটপট জবাব ছিল, আমরা আছি তো! আমরা আছি ওই উঁচুতে, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়, গহীন জঙ্গলে।
পার্বত্য সমস্যা সমাধানে, তথা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সেভাবে দুর্বার আন্দোলন গড়ে না উঠলে অদূর ভবিষ্যতে পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়িদের পরিণতি ত্রিপুরার টিপরাদের মতোই হবে, সে আশঙ্কা থেকেই যায়। এর বিপরীতে বটম পয়েন্টে, সিঁধু-কানহু, বিরসা মুণ্ডা, কুমুদিনী হাজং, এম এন লারমা, কল্পনা চাকমা, চলেশ রিছিল, পিরেন স্নাল প্রমুখর প্রদর্শিত সংগ্রামী পথটিই পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীর মুক্তির পথ। আর দীর্ঘতর ও রক্তে পিচ্ছিল আদিবাসীর সংগ্রামের পথে প্রগতিশীল বাঙালি জনগোষ্ঠীকেও পাশে থাকা চাই। তবে এর নেতৃত্বে ও কেন্দ্রে থাকবেন আদিবাসীরাই।
অন্যদিকে, পর্যবেক্ষণ বলছে, দাতাগোষ্ঠী বা চার্চের অনুদানে আর যাই হোক, অধিকার আদায়ের আন্দোলন হয় না। বরং এটি ভেতর থেকে ক্ষয় করে আদর্শিক চেতনার বিপ্লবী শক্তিকে।
[পুনর্লিখিত]
_________
*আরো দেখুন ঃ
১. মঞ্জুর কিছু স্মৃতি, কিছু কথা, জ্যোতিপ্রভা লারমা, মুক্তমনা ডটকম।
২. পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধ : অন্য আলোয় দেখা, লেখক, মুক্তমনা ডটকম
৩. পূর্বোক্ত।
৪. জীবন আমাদের নয়, সিএইচটি কমিশন রিপোর্ট, ১৯৯১।
৫. ১৯৭৪ সালের একাধিক সংবাদপত্র।
৬. সিরাজ সিকদার : অন্য আলোয় দেখা, লেখক, মুক্তমনা ডটকম
৭. এম এন লারমার ছিন্নপত্র : ঐতিহাসিক দলিল, লেখক
৮. ১৯৮৩ সালের ১৮ নভেম্বর, দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম পৃষ্ঠা, দুই কলাম
৯. পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ, সংহতি প্রকাশন, ২০১৫, লেখক।
১০. ‘আমার বুকে আগুন জ্বলছে’, সন্তু লারমার একান্ত সাক্ষাৎকার, ৯ আগস্ট ২০১৪, দৈনিক কালের কণ্ঠ।
১১. পার্বত্য শান্তিচুক্তি : একটি পর্যালোচনা, লেখক, মুক্তমনা ডটকম
No comments:
Post a Comment