“আপোষ করতে, করতে মানুষ ক্রমেই ছোট হয়ে যায়”...
আমার সাংবাদিকতার হেডমাস্টার, রাঙামাটির প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে ঠিক এই কথাটিই মোটা লাল হরফে সদর দরজায় লিখে রেখেছেন।
“আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের” কর্মসূচিতে শনিবার দূর দূরান্ত থেকে ভাপসা গরমে তীব্র যানজট ঠেলে পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির ভাইবোনেরা ঐতিহ্যবাহি সাজ-পোষাকে ঢাকায় এসেছিলেন শুধু জানান দিতে, “এই দিনটি আমাদের!” কিন্তু তাদের সব হাসি-গান, আনন্দ-উচ্ছাস মুহূর্তেই যেন ম্লান হয়ে যায়। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটশনে অনুস্ঠান স্থলে দুপুর নাগাদ খবর এলো, পাহাড়ে রাজনৈতিক অভিবাসিত সেটেলার বাঙালিরা খাগড়াছড়ির মাটিরাঙার অন্তত পাঁচটি পাহাড়ি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে!...
সেই ১৬ বছর আগে স্বাক্ষরিত এক ধূসর শান্তিচুক্তির সমর্থনে সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমার সংগ্রামী আহ্বান শেষে আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানস্থলে তখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে নাচ-গান পরিবেশন করছিলেন খাসিয়া পাহাড়ের ভাইবোনেরা; ক্ষণিকের জন্য তারাও যেন ওই খবরে খেই হারিয়ে ফেলেন।
“তোমাকে পাওয়ার জন্য হে মানবতা, আর কতোবার, আর কতোবার ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়? আর কতোবার দেখতে হবে খাণ্ডব দাহন?”...
ফুপুমনির আদেশ মেনে আমরা মিডিয়া-ম্যানেরা তো দৈনিক পাকিস্তান, কি পাকিস্তান অবর্জারভারের কায়দায় ভালোই আছি! কি চমৎকার শাহী ফরমান মেনে গত এক বছর ধরে আমরা পাখিপড়ার মতো আউরে চলেছি, “এতোদ্বারা আদিষ্ট হইয়া জানানো যাইতেছে যে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ সকলেই বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন। এদেশে কোনো আদিবাসী নাই। উপজাতিরা সকলেই বহিরাগত। তাহারা বড়োজোর ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি [ইহা হয় কি বস্তু?]। আভিধানিক অর্থে বাঙালিরাই আদিবাসী।” ...ইত্যাদি।
এরপরে তো সর্বত্রই “বহিরাগত”, “নাক চেপ্টা” ক্ষুদ্রজাতির “অসভ্য”, “খর্বকায়” এবং “বর্বরদের” বিদেশী নাগরিক হিসেবে এদেশে স্বসন্মানে বাস করার কথা! সর্বত্রই বয়ে যাওয়ার কথা দুধ ও মধুর নহর। তাহলে কেন এই আগুন? কেন এই জ্বালাও পোড়াও?
নিশ্চিত এসএসসি’তে “বিরোধী দলীয় ষড়যন্ত্রে” মারাত্নক বিপর্যয়ের শোক সংবাদের ভীড়ে মাটিরাঙার দিশেহারা জুমচাষি পরিবারগুলোর খবরাখবর সেভাবে মিডিয়ায় স্থান পাবে না। বরজোর দৈনিকে ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় এক কলাম দুই ইঞ্চি বা টেলিভিশনের খবরে তৃতীয় দফা বিজ্ঞাপন বিরতির পর ফিলার নিউজ হিসেবে ২০ সেকেন্ডের উভ [আউট অব ভিশন], এর বেশী কিছু তো মাটিরাঙার বরাদ্দ হতে পারে না।...
এখন যদি সব বঞ্চনার খেদ হিসেবে রাখাইন জাতির ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা উসুয়ে হাওলাদার বা বান্দরবানের মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং বীরবিক্রম বেঁকে বসেন, ঘোষণা করেন, “১৯৭১ এ আমরা ভুল করেছি, এই দেশ আমার নয়”, অথবা রামগড়ের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খগেন্দ্রনাথ চাকমার অতৃপ্ত আত্না যদি চিৎকার দিয়ে বলেন, “পাকিস্তান জিন্দাবাদ!”...
তাহলে ফুপুমনি, আপনি খুশী হবেন তো? জিত তো আপনারই হবে, তাই না?...নাকি আসল জিত হবে জলপাই রোদ চশমার? [খুব খেয়াল করে]...
___
[দ্র. পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধ: অন্য আলোয় দেখা ]
No comments:
Post a Comment