[প্রায় এক যুগ আগে ভারতের বিশিষ্ট লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে প্রয়াত লেখক আখতারুজ্জমান ইলিয়াসের একটি দীর্ঘ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই অসমাপ্ত সংলাপে উঠে আসে মহাশ্বেতা দেবীর জীবন, কর্ম, সাহিত্য ও সংশ্লিষ্ট নানা ভাবনা। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাহিত্য পত্রিকা ‘তৃণমূল’ এর পঞ্চম সংখ্যা, মার্চ ২০০১ সালে সংলাপটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি সম্পাদক আনু মুহাম্মদের অনুমতিক্রমে ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নেয়া মহাশ্বেতা দেবীর সাক্ষাৎকার’ শীর্ষক লেখাটি সংক্ষিপ্ত আকারে ধারাবাহিকভাবে এই প্রথম আন্তর্জালে প্রকাশিত হচ্ছে। -- অনুলেখক]
০১. মহাশ্বেতা: ...আমার বিয়ে হয় কুড়ি, পরে একুশে, বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠাতা, ফাউন্ডার অ্যাক্টর, নাট্যকার, গীতিকার, গায়ক। তখন, তার আগে ১৮ বছর বয়সে আসে ৫০ এর মহা মন্বন্তর। তখনই আমি যেটুকু দূর্িভক্ষের জন্য কাজ করি, তার ফলে কমিউনিস্ট পার্িট পরিচালিত আন্দোলনের সাথে আমার সেটুকু যোগাযোগ হয়। তারপর জীবনের বেশ কিছু পর্ব অন্যভাবে যায়। এখন ৬০ থেকে শুরু হয় কি ৬২ থেকে, তারপর ৭৫ সাল পর্যন্ত যে কারণেই হোক, আমি পালামৌ জেলায় বার বার যাই। এবং ইনসিডেন্টলি জানতে পারি ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে...যা দেখতাম, বন্ডেড লেবার সিস্টেমের কথা জানতে পারি এবং তখন আমার আগ্রহ বন্ডেড লেবারে। তার স্ট্যাটেস্টিক্স গ্রহণ করা, তারপর নানা রকম হেনতেন করতে করতে গ্রামে গ্রামে ঘোরা। প্রায় পালামৌ জেলাই পায়ে হেঁটে ঘোরা হয়ে গেল। তার লড়াই, সে সব লিখেটিখে সেসব অন্যভাবে চললো।
সেই সময় আমি রাঁচি, মুন্ডা, বীরসা, ওরাং ওদের খুব কাছ থেকে দেখি। এবং ফিরে আসার পর কোন একটা সময় ৬৬/৬৭ সালে শান্তি চৌধুরি মারা গেছেন, ছবি করতেন, উনি বললেন, বীরসার ওপরে একটা ডকুমেন্টারি করবেন। বলে, সুরেশ সিং এর ‘ডাস্ট স্টর্ম অ্যান্ড হ্যাঙিং মিস্ট’টা আমাকে পড়তে দিলেন। কুমার সুরেশ সিং এর এই বইটাকে পরে আমার অনুরোধে অক্সফোর্ড ইউনিভার্িসটি প্রেস অনেক রিভাইজ করেটরে ‘বীরসা মুন্ডা অ্যান্ড হিজ রেবোলিয়ান’ নামে ছাপাল।
তখন দেখি সুরেশ যেসব গানটান ব্যবহার করেছে, এসব আমি অনেকদিন আগে থেকেই সংগ্রহ করছি। করতে, করতে, করতে আবার বীরসা কান্ট্রিতে ফিরে এলাম। সত্যি কথা বলতে কি, রাঁচির মুন্ডাদের সঙ্গে আমার অত...আমি তাদের সঙ্গে জীবনে জীবন যোগ করা যতটা না হয়েছে...আমি একটা বন্ডেড লেবার অনুসন্ধান করছি। মুন্ডাদের মধ্যে বন্ডেড লেবার হয় না। ওঁরাওদের মধ্যে যাচ্ছি, ওদের মধ্যে বন্ডেড লেবার হয় না। অন্যান্য জায়গায় হয়, তা এইভাবে একটা গুরুত্ব না থাকলে আমি ‘বীরসা মুন্ডা’ লিখতে পারতাম না; লিখা প্রয়োজন মনে হয়েছিল।
সমস্ত বঞ্চনাটা দেখেছিলাম, সবকিছুই দেখেছিলাম। আর ‘অরণ্যের অধিকার’ লিখে মনে হলো, এটা সম্পূর্ণ হলো না। ওটাকে ‘কাস্ট অ্যান্ড ক্লাস’ না বলে আমি বলবো ‘ট্রাইব অ্যান্ড কাস্ট’, অবশ্যই ক্লাস; একসঙ্গে মিলিয়ে একটা জায়গায় আনা। যা হচ্ছিল, যা চোখে দেখেছিলাম, সেটাই আনার জন্য ‘চোট্টি মুন্ডা’ লেখা। কিন্তু ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতাটা রেখেছিলাম। কেননা, বীরসা মুন্ডার যে তীর, সেটাই ধানি মুন্ডা বহন করছিল, সেটাই ‘চোট্টি মুন্ডা’তে দিয়ে যায় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। এই লিখতে, লিখতে একটা সময় আসে নকশাল আন্দোলন, এল-গেল। তারপরে আমি যখন-তখন, আমাকে সব জায়গাতেই ডাকে, সিংভূমে গেছি, ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের প্রথম স্টেজে ৭০ এর দশকে গেছি। বন্ডেড লেবার তো বটেই। বহু হেঁটেছি, বহু কিছু করেছি।
পালামৌ সম্পর্েক এটি বলা দরকার হবে যে, এরপরে বন্ডেড লেবার নিয়ে প্রচুর আন্দোলন করা, তাদের সংগঠিত করা, প্রথম বন্ডেড লেবার করা; তারপরের বছর অগ্নিবেশকে ওখানে নিয়ে যাই। এবং তার আগের বছরই আমরা শহরের ভেতর যারা কোনদিন ঢোকেনি, সেই বন্ডেড লেবার হাজার হাজার ঢুকিয়ে...তারা নিজের জীবন নিয়ে নিজেরা নাটক করে দেখায় গান্ধী ময়দানে এবং হাজার হাজার এই যে ‘বন্দুয়া প্রথা নেহি চলেগা, যো বহেগা ওহি খায়েগা’, ‘যো বোহেগা, ওহি কাটেগা, বন্দুয়া প্রথা বন্দ কর’...এসব বলে শ্লোগান দিতে দিতে ডিসি কোর্ট ঘেরাও করে ট্রাকের ওপর (ওখানে ট্রাইব ডিস্ট্রিক্ট, কাজেই ডেপুটি কমিশনার হয়) লাফিয়ে ওঠে, অনেক চেঁচামেচি করে টরে।
তখন ওদের সংগঠন যখন গঠন করা হল, তারপর অগ্নিবেশ সেটাকে নিখিল ভারত বন্দুয়া মোর্চার সঙ্গে সংযুক্ত করে। তাতে খুব কাজ হয়নি। কেননা তার পরে পরে ৭৬/৭৭, পালামৌ চলে এল কৃষ্ণা সিং-এর পেছনে, নকশাল আন্দোলন চলে এল। নকশাল আন্দোলন যখন চলে এল, তখন এদের অবস্থা একটা হলো, আরেকটা মজার জিনিষ হলো, ডালটনগঞ্জ থেকে অমৃতসর পর্যন্ত একটা রেল লাইন হয়। অর্থাৎ ওরা ওই কাজ না করলেও পারে, ওরা অন্য জায়গায় কাজের জন্য চলে যেতে লাগল। উপরন্তু আমাদের এই মিছিল এবং এই ডেমোস্ট্রেশন মিটিং এর পরে ওরা বললো যে, এটা ঠিক হবে কি না? আমি বললাম, এটাই ঠিক হবে। ডিসিকে দিয়ে আমি বলিয়েছিলাম, ১৯৭৬ সালে এই প্রথা অ্যাবলিশ করা হয়েছে। বললো, হ্যাঁ। আমি বললাম, এই প্রথা তোমার এখানে এতো বেশী চলে যে, এখন এটা চিহ্নিত অ্যাজ এ বন্ডেড লেবার ডিস্ট্রিক্ট এবং অ্যাবাভ ফোর্িট থাউজেন্ড এবং ও বললো হ্যাঁ। আমি বললাম, ওরা যদি আর না করে, তোমরা লিগ্যালি কিছু করতে পারো? তখন চুপ করে আছে। আমি বললাম, লিগ্যালি কিছু করতে পারো? বললো, না।
এইটুকুন এর ওপর ভিত্তি করে ওরা বন্ডেড লেবার খাটা ছেড়ে দিয়ে অসম্ভব কষ্ট করেছিল। কেউ কেউ ফিরেও গিয়েছিল। নকশাল আন্দোলন চলে আসার পরে, তার চাপে... কৃষ্ণা সিং’কে যদিও মেরে ফেলে...কিন্তু নকশাল আন্দোলন ওখানে নানাভাবে চলতেই থাকে। যার ফলে ওদের জঙ্গল থেকে মহুয়া নেবার রাইট, তারপর নিজেদের জমি ধরে রাখার রাইট এবং কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষোভ প্রতিবাদ প্রবল হতে থাকে। কাজেই আজকের পালামৌ আর সেই পালামৌ নেই।
যেটা দেখেছিলাম যে, দুই মন ধান গরমকালে বলদকে দিয়ে পাঠাবে না হাটে, একটা বন্ডেড লেবারের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে গরুর গাড়ির জোয়াল। বলদ মরে গেলে দুহাজার টাকা নষ্ট। একটা মানুষ মরে গেলে অত ক্ষতি নেই। সেই জোয়ালটা চাপা পড়ে তার একদিকের কাঁধ বেঁকে যায়। এইগুলোর পরে তখনও আমি হাতে কলমে যে অত কাজ করছি, তা না।
কিন্তু সিংভূমে ডাক পড়ল, ঝাড়খণ্ড মুভমেন্টে ফায়ারিং হল, ৭৯ তে ফায়ারিং হল, ১১ জনের ডেথ ওরা অ্যাডমিট করলো। কমপেনসেশন দিল। কিন্তু ১১ জন মরেনি...তখন ওখানে গিয়ে ইনভেস্টিগেট করতে করতে ১৯টা নাম বের হল। ১৯টা নাম ইপিডাব্লিউডিতে ছাপিয়ে দিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি করে তারপরে যথেষ্ট...তখনকার আন্দোলনটা অন্যরকম ছিল। মেয়েদের একটা আলাদা জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলনও ছিল। মেয়েরা প্রচুর তীর-ধনুক নিয়ে লড়তো।
তারপর সারেন্ডার ফরেস্টের ওপরে, যেখানে ‘কোন’ বিদ্রোহ হয়েছিল, সেখানে বটগাছের ওপরে মাচান করে জিনিষপত্র রাখে, কেননা হাতি আসে। ধানটান ওখানে রাখে। ওখানে দেখি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ফিন্যান্স করা টিউবওয়েল, একটু ঝাঁকালেই জল পড়ে। কোনদিন ছিল না। আমি বললাম, এটা কী করে এখানে এল? ওরা বললো, ফায়ারিং-এর পর কিছুদিন চুপচাপ ছিল। তারপর ওরা প্রচুর করে দিয়েছে। সব জায়গাতেই আমি বলতাম, তোমাদের কি অধিকার আছে, সেটা জান। জলে অধিকার, বিদ্যুতে অধিকার, ওরা নিজেরাই চাইতো-টাইতো।
এরকম হেঁচড়-পেঁচড় করতে করতে ৭৯তে ‘অরণ্যের অধিকার’ অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেল। তখন পশ্চিম বাংলার তিনটা ট্রাইবাল জেলা -- ঝাড়গ্রাম মহকুমা, মেদনীপুরের আর বাঁকুড়ার অনেকটা, আর পুরুলিয়ার এদিকটা...হাটে-বাজারে ঢোল-ডগর দিয়ে ওরা বললো, আমরা পুরস্কার পেয়েছি, আমাদের নাম ইতিহাসে উঠে গেছে, কাজেই এখন আর হাট চলতে পারে না। এবং তারা সব অনেক অনেক...চিঠি, ডেপুটেশন আমার কাছে...কাজেই এই পুরস্কারটা...কাজেই এই পুরস্কারটা, আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন, নিতে দিল্লী যাইনি। ওরা এসে দিয়েছিলেন, মুন্ডারাও সেখানে অনেকে এসেছিল। কাজেই মুন্ডাদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। ...
[চলবে]
---
ছবি: আদিবাসী বিদ্রোহ, আন্তর্জাল।
ছবি: আদিবাসী বিদ্রোহ, আন্তর্জাল।
চলুক (Y)
ReplyDeleteআগামীতেও সঙ্গে থাকার বিনীত অনুরোধ। অনেক ধন্যবাদ।
Delete