রাজশাহীর গোদাগাড়ি এলাকার ভাষাগত সংখ্যালঘু সাঁওতাল
পল্লীগুলোতে কয়েক বছর আগেও নিত্য অভাব লেগেই থাকতো। অভাবের তাড়নায় মহাজনদের কাছ
থেকে চড়া সুদে ঋণ নিত ভূমিহীন সাঁওতাল ক্ষেতমজুররা। কিন্তু এখন 'রক্ষাগোলা' তৈরি
করে তারা স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে দুই বেলা পেট ভরে খেতে
পারছেন। ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া করতে পারছে। সবাই এখন ঋণের ছোবল থেকে মুক্ত।
কিছুদিন আগে এই লেখক সরেজমিনে গ্রামগুলো পরিদর্শনে গেলে এভাবেই
নিজেদের সাফল্যগাথার বর্ণনা দেন দেওপাড়া ইউনিয়নের ডাইংপাড়া গ্রামের প্রধান
(মোড়ল) দেবেন বাস্কে (৪৬)।
জেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে পশ্চাৎপদ এই জনপদ ঘুরে
জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চলটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ভাষাগত
সংখ্যালঘু সাঁওতাল জাতির বাস। কালের করালগ্রাসে মামলা-মোকদ্দমা ও ভূমিদস্যুদের
খপ্পরে একসময়ের সচ্ছল কৃষকদের অধিকাংশেরই এখন চাষবাসের জমি নেই। নিত্য হাহাকার
কিছুতেই যেন তাদের পিছু ছাড়ছিল না। আশ্বিন-কার্তিক মাসে যখন জমি-জিরাতের কাজ
একেবারেই থাকে না, তখন অনাহার মোকাবিলায় তারা বাধ্য হয়ে হাত পাতত মহাজনদের কাছে।
এক বস্তা (৫০ কেজি) ধান ঋণ নেওয়ার বিনিময়ে তাদের শোধ করতে হতো দেড় থেকে দুই
বস্তা ধান। এভাবে সুদের কঠিন চক্রে প্রতিটি পরিবার ছিল জর্জরিত।
আলাপচারিতায় দেবেন বাস্কে জানালেন, এক পর্যায়ে তাঁরা গ্রামের
কয়েকজন মিলে শলাপরামর্শ করে ঠিক করেন, আশপাশের সাঁওতাল গ্রামের মতো তাঁদের
গ্রামেও সমবায় ভিত্তিতে ধান-চালের মুষ্টি সঞ্চয় বা 'রক্ষাগোলা' গড়ে তোলার।
অভাবের দিনে এই ধান-চালের গোলা থেকেই দুস্থ পরিবারকে খাদ্য সাহায্য করা হবে। তারপর
গ্রামের সবার সম্মতিতে দুই বছর আগে তাঁরা এই গ্রামে রক্ষাগোলা প্রতিষ্ঠা করেন।
ধীরে ধীরে অভাব কাটিয়ে ওঠেন। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে অনেকে বাড়তি দুই
পয়সা আয়ও করছেন। কোনো পরিবারেই এখন আর অভাব নেই। গ্রামে শান্তি-সৌহার্দ্য এখন
আগের চেয়ে অনেক বেশি।
ওই গ্রামে প্রবেশের পথেই বিশাল একটি টিন শেডের মাটির ঘর
দেখিয়ে রক্ষাগোলার নেত্রী সেলিনা টুডু (২৫) খানিকটা গর্ব করেই বললেন, এই আমাদের
রক্ষাগোলা। ঘরটিকে দুই ভাগে ভাগ করে এক অংশে বানানো হয়েছে ধান-চালের গোলা। অন্য
অংশ ফাঁকা রাখা হয়েছে আমাদের গ্রাম বৈঠক করার জন্য। সেখানে বসে আমরা হিসাব-কিতাব
করি। প্রতি সপ্তাহে কে কত ধান বা চাল জমা দিল, অভাব মেটাতে সঞ্চিত গোলা থেকে কোন
পরিবারকে কত ধান-চাল সাহায্য করা হয়েছে_ইত্যাদি। বাড়তি ধান-চাল বিক্রির টাকা
দিয়ে গ্রামের জন্য কী কী করা যেতে পারে, তাও ঠিক করা হয় এসব গ্রাম বৈঠকে।
বিয়ে-শাদি বা পরবের সময় প্রয়োজনে আমরা রক্ষাগোলা থেকেই দুস্থ পরিবারকে আর্থিক
সাহায্যও দিয়ে থাকি। আমাদের এখানে কোনো সুদের কারবার নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, শুধু ডাইংপাড়া গ্রামটিই নয়, গত ছয়
বছরে একই রকমভাবে রক্ষাগোলা তৈরি করে দেওপাড়া ও গোগ্রাম ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের
প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ খাদ্যে স্বনির্ভর হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ভাষাগত
সংখ্যালঘু সাঁওতাল হলেও অল্প কয়েকঘর উঁরাও, পাহাড়িয়া, রাজুয়ার, রায়, শিং ও
হাজরা জাতিও রয়েছে। গ্রামগুলো হচ্ছে চৈতন্যপুর, শাহানাপাড়া, ঈদলপুর, কান্তাপাশা,
নিমকুড়ি, পাথরঘাটা, বেলডাঙ্গা, গোলাই, জিওলমারী, গড়ডাইং, মূলকী ডাইং, ডাইংপাড়া,
নিমঘুটু, শ্রীরামপুর বিড়ইল, বাগানপাড়া, গণকের ডাইং, ফারসাপাড়া, দাদৌড়,
গুণীগ্রাম রাজাপাড়া, আগলপুর, উদপুর ও নড়সিংগড় আদর্শগ্রাম।
পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে এই ২২টি গ্রামে ৯৬৩টি পরিবারে এক
হাজার ৩৬২ জন নারী, এক হাজার ৩১৯ জন পুরুষ, ৯৬২টি মেয়ে শিশু এবং ৯৯৩টি ছেলে শিশু মিলে
মোট চার হাজার ৬৩৬ জনের বাস। রক্ষগোলা প্রকল্পের অধীনে গ্রামগুলোকে খাদ্যে
স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখিয়েছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব
ভলেন্টারি অর্গানাইজেশন (সিভো)। এই কাজে সিভোকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে অপর
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (বিএফএফ)।
সব দেখে মনে হয়েছে, রক্ষাগোলার উদাহরণ অনুসরণ করে দেশের
অন্যান্য ভূমিহীন অঞ্চলের কৃষকরা জোটবদ্ধ হলে তারাও অভাবের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত
হতে পারেন। এ জন্য দাদন ব্যবসায়ী এনজিওগুলোর দ্বারস্থ হওয়ার কোনোই প্রয়োজন
নেই।...
---
ছবি: ঐতিহ্যবাহী সাঁওতাল নৃত্য, মানিক সরেন।
No comments:
Post a Comment