বন্ধুজন পল্লব চাকমা একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল থেকে তাদের সম্পাদনায় প্রকাশ করতেন পাহাড়ের ছোট কাগজ "জুম"।
বলা ভাল, জুম হচ্ছে পাহাড়ের ঢালে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বিশেষ চাষাবাদ পদ্ধতি, যার সংগে প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিস্বত্ত্বার সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে।
তো "জুম" পত্রিকাটি নিয়ে
পল্লব সদ্য একটি চমৎকার স্মৃতিচারণমূলক লেখা লিখেছেন। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। একই সংগে তিনি মনে করিয়ে দিলেন অনেক পুরোনো কথা।
সে সময় আমার সৌভাগ্য হয়েছে প্রাণের বন্ধু রোনাল্ড চাকমার সূত্রে "জুম" এর কয়েকটি সংখ্যায় লেখা দেয়ার পাশাপাশি এর নেপথ্য কারিগরদের সংগে মেশার।
২
স্বীকার করি, ২০০৪-৫ সালের দিকে পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে বোধগম্য কারণে প্রথমেই "জুম" গোষ্ঠীকে আস্থায় নিতে পারিনি, এর আদর্শ ও মান যাচাই করতে চেয়েছি। এ জন্য এর কয়েকটি পুরনো সংখ্যা আগে চেয়ে নিয়ে পড়েছি। সম্ভবত বন্ধুজন হিরণ চাকমা আমাকে সে সময়ের কর্মস্থল বিডিনিউজে "জুম" এর কয়েকটি কপি পৌঁছে দিয়েছিলেন। রোনাল্ডও তখন বিডিনিউজের সহযোগী পত্রিকা "সাপ্তাহিক ৭১" এর সাংবাদিক সহকর্মী ছিলেন।
কয়েকটি সংখ্যা পড়ার পর আমাদের ভেতরে আর দূরত্ব থাকেনি। "জুম" গোষ্ঠীর চিন্তার গভীরতা আমাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে তখন সরাসরি জগন্নাথ হলে "জুম" এর কার্যালয় কাম সম্পাদক মণ্ডলীর আবাসিক কক্ষে গিয়ে সবার সাথে পরিচিত হয়েছি। এরপর দীর্ঘদিন আলাপচারিতা, আড্ডা, এমনকি রাত্রিযাপনও হয়েছে এক আধবার।
৩
শান্তিচুক্তির আগে নয়ের দশকে অশান্ত পার্বত্য পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতার পেশাগত জীবনের শুরুতে দীর্ঘদিন কাজ করছি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। তখন বিঝুকে কেন্দ্র করে রাংগামাটির জুম এস্থেটিক কাউন্সিল (জাক) থেকে তো বটেই, পাহাড়ের আনাচে কানাচে অসংখ্য ছোট কাগজ স্মরণিকা ইত্যাদি প্রকাশ পেত; আর এসব সংখ্যায় লেখার জন্য দূর দূরান্ত থেকে বিভিন্ন পরিচিত, স্বল্প পরিচিত, এমন কি অপরিচিত জনের অনেক অনুরোধ পেতাম।
সূত্রটিকে আস্থায় নিলে ডাক যোগে লেখা পাঠিয়ে দিতাম, আর না হয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) কর্মীদের হাতে হাতে লেখা পৌঁছে দেয়া হতো। শর্ত থাকতো একটাই, কোনো লেখা সম্পাদনা বা পরিবর্তন করা যাবে না, লেখা প্রকাশ করতে হবে হুবহু। তবে যোগাযোগ সীমাবদ্ধতায় অনেক সময়ই এসব লেখা আদৌ প্রকাশ হয়েছে কি না, তা জানার উপায় ছিল না। আবার প্রকাশিত সব পত্রিকার লেখক কপিও হাতে এসে পৌঁছাত না। বরাবরই এসব লেখালেখিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন সহকর্মী প্রিসিলা রাজ।
তখন পিসিপির মুখপত্র "কেওক্রাডং", ছোট কাগজ "রাডার", "স্যাটেলাইট", "জুম্মকণ্ঠ" ইত্যাদি রাজনৈতিক পত্রিকায় লিখেছি অকপটে। তবে দু চার সংখ্যা প্রকাশের পর শিগগিরই সরকারের পক্ষ থেকে এসব পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়।
৪
শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে সম্ভবতঃ সবচেয়ে আলোচিত ছোট কাগজ ছিল বন্ধুজন দীপায়ন খীসা সম্পাদিত "মাওরুম"। যেমনই ছিল এর প্রচ্ছদ, তেমনই ছিল মান। সাহসী লেখনির কারণে শিগগিরই ছোট কাগজটি পাহাড়ে ও সমতলে খুবই জনপ্রিয়তা পায়।
সে সময় অনিল চাকমা গোর্কি, অভিলাষ চাকমাসহ
ইউপিডিএফ-এর কয়েকজন দলছুট নেতা (তাদের অনেকেই পরে দলত্যাগ করায় নির্মম হত্যার শিকার হন) "মাওরুম" এ সংগঠনটির তীব্র সমালোচনা করে কিছু সাহসী লেখা লিখেছিলেন। এরমধ্যে গোর্কি তিন বিদেশি অপহরণের নেপথ্য কথা, টাকা ভাগাভাগির চিত্রও তুলে ধরে "মাওরুম" এ একটি দীর্ঘ স্মৃতিচারণমূলক লেখা লিখেছিলেন। থলের বেড়াল ফাঁস হওয়ায় এরপরই খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়িতে তাকে জীবন দিতে হয়েছে! অভিলাষও হত্যার শিকার হয়েছেন একইভাবে।
এসব কারণে পাহাড়ে অঘোষিতভাবে " মাওরুম" ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। দীঘিনালায় "মাওরুম" বিক্রি করতে গিয়ে কয়েকজন ছাত্র মারধরের শিকার হয়েছেন, আবার বেশ কয়েক জায়গায় পত্রিকাটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।
৫
বছর চারেক ধরে অনিয়মিতভাবে নিয়মিত প্রকাশের পর
সম্ভবতঃ আর্থিক অনটন ও সম্পাদকের ব্যস্ততায় "মাওরুম" আর প্রকাশ হতে পারেনি। অন্যদিকে, ছাত্র জীবন শেষে সম্পাদকদের পেশাগত জীবনের চাপে "জুম" প্রকাশনাও উঠে গেছে অনেকদিন।
কিন্তু এখনো "জুম" এবং "মাওরুম" পত্রিকা দু'টির অনুপস্থিতি আমাকে পীড়া দেয়। পাহাড়ে এত মান সম্পন্ন, এত সাহসী, এত নান্দনিক ছোট কাগজ আর হবে না।
No comments:
Post a Comment