Sunday, May 24, 2015

কল্পনা ​চাকমা থেকে বিচিত্রা তির্কি...


০১. কল্পনা চাকমা অপহরণ ইস্যুতে গত ১৮ বছর ধরে কতিপয় মানবাধিকার সংস্থা বছর জুড়ে আশ্চর্য নিরবতা পালন করলেও শুধু অপহরণ দিবসের আগেভাগে মেকি কান্নাকাটি করছে। ২৭ মে এই মামলাটির শুনানী রাঙামাটি আদালতে হওয়ার কথা। এ নিয়ে আমার সতীর্থ পাহাড়ি বন্ধুরা বিশেষ উদ্বিগ্ন। তাদের উদ্বিগ্নতাই স্বাভাবিক। কারণ, গত ১৮ বছর ধরে এই স্পর্শকাতর মামলাটি রয়েছে দীর্ঘসূত্রীতায়।

অন্তত চার দফায় প্রশাশন মামলাটিকে খারিজ করে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে। অর্থাৎ রেহাই দিতে চেয়েছে অভিযুক্ত অপহরণকারী লেফটেনেন্ট ফেরদেৌসসহ আরো তিন সহযোগির। কল্পনা অপহরণ মামলা ধামাচাপা দেওয়া হলে এতো বড় একটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেই ধামাচাপা দেওয়া হবে। ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হবে স্বাধীন দেশে গত চার দশক ধরে পাহাড়ে আদিবাসী মানুষেরও ওপর সীমাহীন গণহত্যা, গণধর্ষন, খুন, অপহরণ ও গুম করার ধারাবাহিকতার একটি জঘন্নতম অধ্যায়।


এদিকে, যেন ‌‌'কান টানলেই মাথা আসবে' সূত্রে পাহাড়ি বন্ধুদের এই উদ্বিগ্নতার জের ধরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের কয়েকজন 'পার্বত্যবোদ্ধা' ও 'আদিবাসী বিশেষজ্ঞ' কোং যথারীতি নড়েচড়ে বসেছেন। আন্তর্জালের এক সুতোয় 'মানবাধিকার', 'আদিবাসী বান্ধব' ইত্যাদি তকমা আঁটা রথি-মহারথিরা কল্পনা অপহরণ মামলাটিকে নিয়ে ফের একঘেয়ে মায়াকান্না জুড়েছেন। প্রতি বছর কল্পনা চাকমা অপহরণ দিবসের [১২ জুন] আগে 'রুদালি'দের কান্নাকাটির এই অশ্লীল প্রতিযোগিতা বেশ প্রকটভাবেই প্রকাশ্য হয়।

তথ্য সাংবাদিকতার পেশাগত কারণে বহু বছর পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী বিষয়ক প্রতিবেদন, ব্লগ নোট ও দু-একটি বইপত্র লেখার দায় থেকে এই মায়াকান্নার নাটকের ভেতর নাটকটুকু খোলসা করা প্রয়োজন বোধ করি।

০২. লক্ষ্যনীয়, হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমা রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ির নিউ লাইল্ল্যাঘোনা ক্যাম্প থেকে অপহরণের দিনটি ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনের দিন [১২ জুন ১৯৯৬]। ২১ বছর পর ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ। আর এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করতে দেশের এনজিওগুলো একটি বড় ধরণের ভূমিকা রেখেছিল।

কল্পনা চাকমা অপহরণের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত বলে প্রথম থেকেই এই অপহরণ মামলাটি ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য অস্বস্তিকর। এ কারণে সে সময় আমরা অল্প কয়েকজন সাংবাদিক জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে এই অপহরণের একাধিক সরেজমিন সংবাদ করে এটিকে আন্তর্জাতিক সংবাদে পরিনত করতে পারলেও সে সময় দাতাগোষ্ঠি পরিচালিত কথিত মানবাধিকার সংস্থাগুলো কল্পনা চাকমা ইস্যুটিকে মোটেই আমলে নেয়নি।

আমরা সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্বের বাইরে মানবিক দায় থেকে সে সময় বাঘাইছড়ি থানা থেকে এই অপহরণ মামলার সমস্ত নথি একটি মানবাধিকার সংস্থাকে পেৌছেঁ দেই। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আইনী সহায়তার মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার ওই মানবাধিকার সংস্থা কাম এনজিওটি কল্পনার মামলাটির দায়িত্ব সে সময় নেয়নি। এমনকি আওয়ামী প্রীতির কারণে এর পরের বছরগুলোতে ৮ মার্চ নারী দিবসে সম্মিলিত নারী সমাজ কল্পনা ইস্যুর ব্যানার নিয়ে হিল উইমেন্স ফেডারেশনকে শাহবাগ ও শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানস্থলেও দাঁড়াতে দেয়নি।

এর পর আবারো খালেদা-জামাত এবং মঈন-ফখরুদ্দীন এবং বর্তমান দুই দফায় আওয়ামী রাজনীতির মাঠেও অবশ্য পরিস্থিতির খুব হেলদোল হয়নি।

০৩. শান্তিচুক্তির পক্ষের-বিপক্ষের পাহাড়ি সংগঠনগুলোর অব্যহত চাপ এবং গণমাধ্যমের সংবাদসমূহের কারণে এখন অবশ্য দাতাগোষ্ঠি প্রয়োজিত মানবাধিকার সংস্থা কাম এনজিওগুলো কল্পনা চাকমা ইস্যুটি অপহরণ দিবসের আগে হিমঘরের সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের বাইরে নিজেরাও ব্যানার ধরছে বা পাহাড়ি সংগঠনগুলোর সঙ্গে মিশে যেৌথ কর্মসূচি পালন করছে।

কিন্তু লক্ষ্যনীয়, এখনো কোনো নির্দিষ্ট মানবাধিকার সংস্থা কল্পনা চাকমা অপহরণের মামলা পরিচালনার দায়ভার নেয়নি। উপরন্তু গত ১৮ বছর ধরেই এই আলোচিত মামলাটিকে দিদারুণ অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে রাঙামাটি আদালতে। ভাবতে অবাক লাগে, টক শো, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে কল্পনা চাকমাকে নিয়ে, আদিবাসীর মানবাধিকার নিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন যেসব ব্যারিস্টার, উকিল, মুক্তার, মানবাধিকার সংস্থা, তারা এই মামলাটিকে এতোদিন ঢাকার উচ্চ আদালতে নিয়ে আসার প্রয়োজনই বোধ করছেন না! অথচ চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী তাতেঁ বোনা রঙিন খাদি (ওড়না) বা ত্রিপুরাদের তাতেঁর জ্যাকেট পরা এসব মানাবাধিকার কর্মী কাম বুদ্ধিজীবী টেলিভিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বেশ গর্ব করেই নিজেদের পরিচয় দেন এভাবে, ‌'আমরা আদিবাসী নিয়ে কাজ করি', 'আমরা আদিবাসী বান্ধব', 'আমরা আদিবাসীর বন্ধু' ইত্যাদি ইত্যাদি।

এ সব ভন্ডের দলের পক্ষে কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটির দায় বহন না করার অন্যতম কারণ এই যে, এর মূল আসামী নিরাপত্তা বাহিনীর বলে এটি যেকোনো সরকারের জন্যই অস্বস্তিকর। তাই লোক দেখানো দু-একটি কর্মসূচি চালিয়ে যদি মুফতে কিছু ডলার, পাউন্ড, ইউরো কামানো যায় তো ক্ষতি কি!

০৪. পাহাড়ে কল্পনা চাকমা অপহরণের মতোই সমতলে ব্যপক আলোড়ন ফেলেছিল আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলা। জমির লড়াইকে কেন্দ্র করে ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট মহাদেবপুরের ভীমপুর আদিবাসী পল্লিতে সন্ত্রাসীদের হামলায় খুন হন সাঁওতাল এই নেতা। গণমাধ্যমের সুবাদে এই হত্যা মামলা সে সময় সীমানা ছড়িয়ে পরিনত হয় আন্তর্জাতিক সংবাদে। আবারো সব আলোচনার কেন্দ্রে প্রাধান্য পায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা আদিবাসী নির্যাতনের বিষয়টি। কিন্তু কিছুদিন পরেই সবাই যেন রাতারাতি ভুলতে চান এই বর্বরতম হত্যাকাণ্ডটিকে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী ছাত্র পরিষদসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন অবশ্য ঠিকই মনে রেখেছে তাদের শহীদ নেতাকে। আর মনে রেখেছেন আলফ্রেড সরণের ছোট বোন রেবেকা সরেন। জমি বিক্রি করে একাই মামলা চালাচ্ছেন এই সাঁওতাল নেত্রী। মামলা চালাতে চালাতে নিঃস্ব হতে বসেছেন তিনি। এই নিয়ে ঘর ভেঙেছে তার। পারিবারিক বিরোধে একবার আত্নহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন রেবেকা। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়েছে প্রায় দেড় দশক আগের এই মামলাটি।

একইভাবে ইকোপার্ক আন্দোলনে শহীদ গারো নেতা পিরেন স্নাল ও চলেশ রিছিল হত্যা মামলাও ধামাচাপা পড়তে বসেছে। পাহাড়ি আদিবাসী নেত্রী কল্পনা চাকমার মতোই চলেশ রিছিল এখন টাঙ্গাইলের মধুপুরের গারো ও কোচ আদিবাসী অধ্যুষিত শালবনের অমিংমাসিত অধ্যায়।

বছর দশেক আগে মধুপুরের শালবন গর্জে উঠেছিলো বন বিভাগের একতরফা ইকো-পার্ক প্রকল্পের বিরুদ্ধে। সে সময় আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিল আদিবাসীদের সংগঠিত করেন ইকো-পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলন। এ জন্য এক-এগারোর সময় যৌথবাহিনীর ‘এনকাউন্টারে’ জীবন দিতে হয় তাকে। আন্দোলনের সময়ই পুলিশ ও বনরক্ষীদের গুলিতে প্রাণ যায় পিরেন স্নাল নামক আরেক আদিবাসী নেতার। পিরেনের রক্তের বিনিময়ে সে সময় বাতিল হয় ইকো পার্ক প্রকল্প। কিন্তু বাতিল এ প্রকল্পের বন মামলার দায় এখনো বহন করে চলেছেন মৃত চলেশ। এ মামলায় ‘গরহাজির’ থাকায় দুবছর আগে আদালত তাঁর বিরুদ্ধে সমনও জারি করেছেন!

আদিবাসী নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় সবশেষ বিশেষ সংযোজন বিচিত্রা তির্কি। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সবিন মুন্ডা আমাদের জানাচ্ছেন, আদিবাসীদের জমি রক্ষার দাবিতে চাঁপাইনবাবগজ্ঞের ওঁরাও এই নেত্রী সব সময়ই সোচ্চার। কারণ, তিনি উত্তরাঞ্চলে সমতলের আদিবাসী গ্রামগুলো ঘুরেছেন বহু বছর ধরে। তাই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন, জমির ওপর অধিকার হারালে আদিবাসীর আর কোনো মেৌলিক-মানবিক অধিকারই থাকে না। ধীরে ধীরে তাদের অসি্ত্বই টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। তো বিচিত্রা তির্কি সবশেষ ২০১২ সালের ২-৩ অক্টোবর দুবছরের শিশু সন্তানকে গামছা দিয়ে পিঠে বেঁধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আদিবাসীদের পদযাত্রা কর্মসূচিতে। এটি ছিল আদিবাসীর জমি রক্ষার দাবির লড়াই। ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রাটি ছিল রাজশাহীর নাচোল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁকনহাট পর্যন্ত। তখন থেকেই তিনি দুষ্কৃতকারীদের রোষানলে পড়েন। তাঁর নিজস্ব ২২ বিঘা জমি কেড়ে নিতেও সন্ত্রাসীরা তত্পর। এ কারণেই তাকেঁ গত বছর ৪ আগস্ট তাকে শিকার হতে হয়েছে গণধর্ষনের। এ মামলার প্রধান আসামীরা সরকারি দলের। তাই পুলিশ প্রথমে তাদের গ্রেপ্তার করেনি। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ এর প্রতিবাদে উত্তরের সব আদিবাসীদের জড়ো করে আবারো পদযাত্রার আয়োজন করে। গণমাধ্যমেও বিষয়টি ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ফলে পুলিশ আসামীদের ধরলেও প্রধান আসামীরা আবার সহজেই জামিন পেয়ে যায়। ...

এ কথা বলা বাহুল্য হবে না যে, কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটির মতোই আলফ্রেড সরেন, পিরেন স্নাল, চলেশ রিছিল বা বিচিত্র তির্কির মামলা কোনো মানবাধিকার সংস্থাই গ্রহণ করেনি। আদিবাসীদের নিজস্ব দল ও সংগঠন বাদে কেউ দাঁড়ায়নি এসব নেতা-নেত্রীদের স্বজনের পাশে। অথচ মানবাধিকার সংগঠনগুলো আদিবাসী নির্যাতনের অসংখ্য মামলার বদলে অন্তত আলোচিত এসব মামলার দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের 'মানবাধিকার' তকমাটিকে বৈধতা দিতে পারতেন।

০৫. বন্ধুজন, আটার কলের কাছে আখের রস চাইছি না। ​দাতাগোষ্ঠির সুতোয় বাধা বলেই কথিত ওইসব মানবাধিকার কাম উন্নয়ন সংস্থার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব নয়। তাই আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের বাস্তবতাটুকু বুঝে নিতেই বিনয় করে বলি, এইসব আটার কল চিনে রাখার জন্য।

আর​ কোদালকে কোদাল, কাঁচকে কাঁচ হিসেবে সানাক্ত করতে বলি। সুবেশী ​​গাছপাকা ভন্ডদের মুখোশকেই আজকাল মুখ বলে ভ্রম হয়। এই​ সব নাদান বিভ্রান্তি কাটিয়ে দাতাগোষ্ঠির প্রযোজিত আন্দোলন বা সংগঠনে আদিবাসীর মুক্তি নাই; আদিবাসীর নিজস্ব শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সিঁধু, কানহু, বিরসা মুন্ডা, কুমুদিনী হাজং, এমএন লারমা, কল্পনা চাকমা, আলফ্রেড সরেন, পিরেন স্নাল, চলেশ রিছিল, বিচিত্রা তির্কি -- প্রমুখর প্রদর্শিত সংগ্রামী পথই আদিবাসীর মুক্তির পথ। একই সঙ্গে লড়াইটিকে এগিয়ে নিতেই ছাগছালের নেকড়ে চিহ্নিত করাও জরুরি।  জয় হোক! ​
__
ছবি: কল্পনাচাকমা ডটঅরগ

No comments:

Post a Comment