আপনারা আমার নাম ছেপে দিন, আমার ছবি প্রকাশ করুন। গণধর্ষিত বলে আমি এসবে ভয় পাই না। আমার সঙ্গে তাবত্ উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ আদিবাসী ভাই-বোন আছে। আমার স্বামী, ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন -- সবাই আমার সঙ্গে আছে। লোকলজ্জার ভয়ে আমি নাম-পরিচয় গোপন করলে আসামীরা সকলেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। ওরা সরকারি দল আওয়ামী লীগ করে। সকলেই চলে যাবে পর্দার আড়ালে।...
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা সদর হাসপাতালের বিছানায় আধশোয়া হয়ে কথাগুলো আমাদের বলছিলেন সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের মারপিটে গুরুতর আহত, সম্ভ্রম হারানো ওঁরাও আদিবাসী নেত্রী বিচিত্রা তির্কি (৩৫)। আমরা সেদিন ঢাকা থেকে একদল সাংবাদিক ওই হাসপাতালে গিয়েছি তার সন্ধানে। আমাদের গাইড করছিলেন কমল হেমরম নামের একজন সাঁওতাল জনগোষ্ঠির কলেজ ছাত্র।
হাসপাতালের দোতলায় বিচিত্রার নির্ধারিত রুমটিতে উঁকি দিয়ে কমল জানালেন, দিদির বিছানাটি ফাঁকা। তাকে পরিচর্যাকারী হাসপাতালের একজন আয়া খবর দিলেন দিদিকে তিন তলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। আমরা সাংবাদিকদল সঁিড়ির মুখেই ওঁরাও নেত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
খানিক পরে আমরা তাকে একনজর দেখেই চিনে ফেলি। দুজন নার্সের কাঁধে ভর দিয়ে কালো মতো একজন আদিবাসী মেয়ে তিন তলার সঁিড়ি ভেঙে নামছিলেন। ব্যাথায় মুখটি সামান্য কুঁচকে আছে। এক পা ছঁেচড়ে চলছেন। ওই অবস্থাতেই তার ছবি তোলার জন্য দলের একজন সাংবাদিক ক্যামেরা তাক করে। আমি মৃদূ তিরস্কারে তাকে নিবৃত্ত করি। কারণ, অনুমতি ছাড়া নির্যাতীতার ছবি তোলা, তথা নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা গণমাধ্যমের সম্পূর্ণ নীতি বিরোধী।
বিছানায় তাকে আধ শোয়া করে বসিয়ে দেওয়ার পর কমল আমাদের কথা নেত্রীকে জানায়। আমরা একে একে তাকে সশ্রদ্ধ প্রনাম করে নেমকার্ড দেই। ছোট্ট কামরাটি ভরে যার সাংবাদিকদের দলবলে।
এইফাঁকে জানাই, বিচিত্রা তির্কির ওপর অমানুষিক নির্যাতনের খবরটি সেদিনই (৪ আগস্ট) আমি জেনেছি, বন্ধু মানিক সরেনের কাছ থেকে। সে বিচিত্রা তির্কির সংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক। সঙ্গে সঙ্গে আমি খবরটি টেলিফোনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সীমান্ত জেলা রাজশাহী প্রতিনিধিকে জানাই। তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। সেদিনই পর পর দুফায় সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়। অবশ্য তখনো খবরগুলোতে তার নামপরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। আমাদের দলের অন্যান্য সাংবাদিকরাও সেদিনই খবরটি জানতে পারেন ওই অনলাইন সংবাদটি ইমেইলে, ফেসবুকে ও টুইটারে শেয়ার করার সূত্রে।
তবে বিচিত্রা সর্ম্পকে আমাদের বেশ খানিকটা ধারণা দিয়েছিলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সবিন মুন্ডা। সবিন দা’র ভাষায়,
আদিবাসীদের জমি রক্ষার দাবিতে ওঁরাও নেত্রী সব সময়ই সোচ্চার। কারণ, তিনি উত্তরাঞ্চলে সমতলের আদিবাসী গ্রামগুলো ঘুরেছেন বহু বছর ধরে। তাই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন, জমির ওপর অধিকার হারালে আদিবাসীর আর কোনো মেৌলিক-মানবিক অধিকারই থাকে না। ধীরে ধীরে তাদের অসি্ত্বই টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে।
তো বিচিত্রা তির্কি সবশেষ ২০১২ সালের ২-৩ অক্টোবর দুবছরের শিশু সন্তানকে গামছা দিয়ে পিঠে বঁেধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পদযাত্রা কর্মসূচিতে। এটি ছিল আদিবাসীর জমি রক্ষার দাবির লড়াই। ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রাটি ছিল রাজশাহীর নাচোল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁকনহাট পর্যন্ত। তখন থেকেই তিনি দুষ্কৃতকারীদের রোষানলে পড়েন। তঁার নিজস্ব ২২ বিঘা জমি কেড়ে নিতেও সন্ত্রাসীরা তত্পর। এ কারণেই তঁাকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে। এ মামলার প্রধান আসামীরা সরকারি দলের। তাই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না।
আর হাসপাতালে ওঁরাও নেত্রী, ইউপি সদস্যা খুব স্পষ্ট উচ্চারণে আমাদের বলেন তার নিজের কথা। তিনি বলেন,
গোমস্তাপুরের জিনারপুর গ্রামে আমার মোট ৪৮ বিঘা জমির মধ্যে ২২ বিঘা বিরোধপূর্ণ বলে সরকারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বাকী জমির একাংশে আমি একটি শিশু শিক্ষার স্কুল ও কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন আমার নিজস্ব প্রায় ২২ বিঘা জমিও সন্ত্রাসীরা কেড়ে নিতে চায়।
গত ৪ আগস্ট নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে দিদি বলে চলেন,
সেদিন আমরা কয়েকজন মেয়ে জমিতে কাজ করছিলাম। বেলা ১২ টার দিকে ৩০-৩৫ জন সন্ত্রাসী লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করতে আসছে দেখে আমি অল্প বয়স্ক মেয়েদের পালিয়ে যেতে বলি। তঁারা সরে গেলেও আমরা কয়েকজন পালাতে পারিনি। ওদের হামলার মূল লক্ষ্যই ছিলাম আমি। সন্ত্রাসীরা আমাকে লাঠি ও রড দিয়ে মারছিল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিলাম। আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি। আমি ওদের বলছিলাম, তোরা আমাকে মেরে ফেল। আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে তোরা কেউই বাঁচবি না।দিদির সাহসিকতায় আমাদের কারো কারো মনে পড়বে পাকিস্তানের মুখতার মাইয়ের কথা। তিনিও গণধর্ষিত হওয়ার নিজের নাম-ধাম বা ছবি কোনটাই আড়াল করেননি। একটি কট্টর ইসলামী রাষ্ট্রের ভেতরেই তিনি সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছেন ধর্ষকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে। এখনো লড়ছেন পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তথা নারী মুক্তির জন্য।
এরপর মনিরুল ইসলাম, আবুল কালাম ও আক্তার টেনেহিঁচড়ে ফাঁকা মাঠের আইলের কিনারে নিয়ে আমাকে ধর্ষণ করে। ওরা আমার পাওয়ার টিলার, মোষ ও চাষের যন্ত্রপাতিও লুঠ করে। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় আমার স্বামী লোকজন ডেকে আমাকে উদ্ধার করেন। রাত ১২টার দিকে আমি থানায় গিয়ে মামলা করি। ওই রাতেই পুলিশের সহযোগিতায় উদ্ধার করি লুট হওয়া মালামাল।
সে রাতে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও পরদিন আমার ডাক্তারি পরীক্ষা হয় বেলা দেড়টার দিকে। অনেক দেরিতে পরীক্ষা করায় মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। এছাড়া মামলার প্রধান আসামী মনিরুল ইসলাম (৪৮), আবুল কালাম, আক্তার, আফজাল হোসেন, আব্দুল হামিদ (৪৫), আব্দুস সালাম, তরিকুল ইসলাম ও শেরপুর গ্রামের আক্তার (৪০) এখনো ধরা পড়েনি।
বিচিত্রা তির্কির মামলার অগ্রগতির বিষয়ে আমরা কথা বলি জেলা পুলিশ সুপার বশির আহমেদের সঙ্গে। তার ভাষ্য মতে,
আমরা ওই মামলার আসামীদের ধরতে তত্পর রয়েছি। এরইমধ্যে ৮ জনকে ধরা হয়েছে। কিন্তু প্রধান আসামীরা সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। এরপরেও আমরা বিভিন্ন স্থানে তাদের গ্রপ্তোরের জন্য অভিযান চালাচ্ছি। কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ও চাপের মুখে আমরা পিছু হটবো না। এই মামলায় ন্যায় বিচার করেই ছাড়বো।
প্রায় ২৫ ঘন্টা পর ডাক্তারী পরীক্ষা করা হয়েছে বলে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়েছে কিনা জানতে চাইলে এসপি বশির আরো বলেন,
ধর্ষিতা নেত্রী সন্ধ্যার দিকে থানায় এসেছিলেন। আমরা ওই রাতে ডাক্তারী পরীক্ষার চষ্টো করেছি। কিন্তু রাতে সাধারণত এমন পরীক্ষা হয় না। তাই হাসপাতালে তঁাকে ভর্তির পর পরদিন সকাল সোয়া ১১টায় পরীক্ষা করা হয়েছে। মেডিকেল রিপোর্টেও সময় উলে্লখ আছে।মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া না গেলেও ধর্ষিতার জামা-কাপড়ও পরীক্ষার করা হচ্ছে। এর রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি। এতে নেতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেলেও সন্ত্রাসীদের নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে তাদের ধরা হবে।
জানিয়ে রাখি, মামলার পলাতক প্রধান আসামীরা এসপি বশির ও গোমস্তাপুর থানার ওসির বিরুদ্ধে নওগাঁয় সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাদের দাবি বিচিত্রা তির্কির মামলাটি পুলিশের সাজানো। তাছাড়া মেডিকেল রিপোর্টেও ধর্ষনের আলামত পাওয়া যায়নি — ইতাদি। সংবাদ সম্মেলনের একপেশে খবরটি স্থানীয় কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি ডিআইজিসহ পুলিশের উঁচু কর্তাদেরও নজরে এসেছে।
আলাপ-চারিতায় আমাদের মনে হয়েছে, পুলিশী কর্তব্যের বাইরে ওই বিষয়টিই এসপি বশিরকে আরো বেশী ক্ষপ্তি করেছে। তাই বার বার তিনি আসামীদের ‘দেখে নেওয়ার’ কথা বলছিলেন। তাছাড়া একের পর এক গণমাধ্যমের খবর, বিচিত্রাকে দেখতে হাসপাতালে এমপি ফজলে হোসেন বাদশা, এমপি উষাতন তালুকদারসহ বেশ কয়েকজন নেতানেত্রীর পরিদর্শন, ঘটনার প্রতিবাদে ২৭ আগস্ট হাজার হাজার আদিবাসীর পদযাত্রা — ইত্যাদিও তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকতে পারে। …
__
সংযুক্ত: ভূমি হারানোর আতঙ্কে দিন কাটে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর
মুখতার মাই, পাকিস্তানের নারী নেত্রী
No comments:
Post a Comment