বিপ্লব রহমান ও বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্ত্তী সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে গেছে। বাঘের পায়ের ছাপের আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্রের (ক্যামেরা ট্র্যাপিং) প্রাথমিক বিশ্লেষণে এমন তথ্য ধরা পড়েছে। বন বিভাগ জানিয়েছে, বাঘশুমারির অংশ হিসেবে সম্প্রতি একদল বিশেষজ্ঞ বন থেকে সংগ্রহ করেছেন বাঘের পায়ের ছাপচিত্র। আর বছরখানেক ধরে সংগ্রহ করা হয়েছে বাঘের ভিডিওচিত্র। বিশেষজ্ঞরা এখন এ দুটি নমুনা মিলিয়ে দেখছেন, বিশ্লেষণ করছেন। তাঁদের মতে, সিডর-আইলাসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বনে চোরা শিকারির উৎপাত বৃদ্ধি, মানুষের সংঘাত, খাদ্যশৃঙ্খল ক্ষেত্রবিশেষে ভেঙে পড়ার কারণে সুন্দরবনে বাঘের অস্তিত্ব এখন অতি বিপন্ন।
ক্যামেরা ট্র্যাপিং প্রকল্পের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) জাহিদুল কবির। কালের কণ্ঠকে তিনি জানান, সুন্দরবন থেকে ধারণ করা বাঘের ভিডিওচিত্র ও পায়ের ছাপ বিশ্লেষণের কাজ এখনো চলছে। ভারত ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে এ পর্যন্ত এসব ছবি বিশ্লেষণ করে আশঙ্কা করছেন, বনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে। বিশ্লেষণ শেষে আগামী জুন মাসে বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা ঘোষণা করবেন।
জাহিদুল কবির আরো জানান, ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে বাঘশুমারির পদ্ধতি বাংলাদেশে এই প্রথম। পাশাপাশি যোগ হয়েছে বাঘের পায়ের ছাপচিত্র সংগ্রহ। বাঘশুমারির প্রকল্পটি 'বন্য প্রাণী সংরক্ষণে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারকরণ' নামক একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অধীন। দুই বছর মেয়াদকালের শুমারির উপপ্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক।
বন বিভাগের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৫৩টি। ১৯৮৫ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা মেলে ৪৫০টি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এফএওর বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৯৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৩৬৯টি। আর ২০০৪ সালের সর্বশেষ বাঘশুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি। এর মধ্যে শাবক ২১টি। ওই বাঘশুমারি করা হয়েছিল কেবল পায়ের ছাপ বিশ্লেষণের প্রাচীন পদ্ধতি অনুসরণে।
সূত্র মতে, এর আগে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে পায়ের ছাপ গণনা শেষে দুই শতাধিক বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১২ সালে সেখানে ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে মাত্র ৬০ থেকে ৭০টি বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ জন্য বাঘের সঠিক সংখ্যা জানতে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের বিকল্প নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নূরজাহান সরকার কালের কণ্ঠকে জানান, সাধারণভাবে দেখতে একই রকম মনে হলেও প্রতিটি বাঘের ডোরাকাটা দাগ আলাদা ধরনের। পায়ের ছাপও আলাদা। বাঘের ভিডিওচিত্র ও পায়ের ছাপচিত্র বিশ্লেষণ করলে জানা যাবে বনের মোট বাঘের পাশাপাশি পূর্ণবয়স্ক, পুরুষ, মাদী ও শাবকের সংখ্যাও।
অধ্যাপক নূরজাহান সরকারের মতে, প্রাকৃতিক বন সুন্দরবনকে নির্বিঘ্ন থাকতে দিলেই বাঘের বিচরণ হবে নিরাপদ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি চোরা শিকারি ও বনজীবীদের আনাগোনায় বাঘ হুমকির মুখে। এ ছাড়া রয়েছে বনের যত্রতত্র মানুষের বিচরণ। এ অবস্থায় নতুন করে বাঘের আবাসস্থল নির্মাণ সম্ভব নয়। চোরা শিকারি ও বনে মানুষের বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করে বাঘের আবাসকে অনেকটাই নির্বিঘ্ন করা সম্ভব।
বন বিভাগ জানিয়েছে, বাঘশুমারির প্রথম পর্বে সুন্দরবনকে তিনটি ব্লকে ভাগ করে দুই দফায় ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে ধারণ করা হয় ভিডিওচিত্র। ২০১৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত চলে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ। 'ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া'র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দিপাঞ্জন নাহার নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত ৩০ জনের দল অংশ নেয় অভিযানে। প্রথম দিকে টানা প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস ধরে বনের দুটি ব্লকে ১৪৩টি পয়েন্টে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে ধারণ করা হয় বাঘের ভিডিওচিত্র। পরে গত বছর অন্য ব্লকের ১৩২টি পয়েন্টে চলে ক্যামেরা ট্র্যাপিং। প্রতিটি স্থানে দুটি করে অত্যাধুনিক ক্যামেরা একটানা ৪০ দিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধারণ করে ভিডিওচিত্র।
দ্বিতীয় পর্বে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর থেকে শুরু করে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয় বাঘের পায়ের ছাপচিত্র। এ জন্য নির্দিষ্ট করা হয় বনের প্রায় ১৫০টি গ্রিড। একেকটি গ্রিডের আয়তন প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার। চলতি বছর প্রথমে ১২ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের দুবলা ও হলদিবুনিয়া অংশে শুরু হয় ছাপচিত্র সংগ্রহের কাজ। পরে গত মার্চে আরো দুটি প্রশিক্ষিত দল অভিযানে যোগ দেয়। পাঁচটি দলে বিভক্ত মোট ৪২ জনের দল সংগ্রহ করে বাঘের পায়ের ছাপচিত্র।
বন বিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবনে গত ১৪ বছরে অবৈধ শিকার ও গণপিটুনির পাশাপাশি রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৪৯টি বাঘ। সর্বশেষ গত ৩ ও ৫ ফেব্রুয়ারি র্যাব ও বন বিভাগ সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাট, বরগুনা ও সাতক্ষীরা জেলায় অভিযান চালিয়ে দুটি বাঘ ও ৩৮টি হরিণের চামড়াসহ চার চোরা শিকারিকে আটক করে। এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থেকে আটক করা হয় একটি বাঘের চামড়া, মাথা, ২৯টি দাঁত ও ২৪টি হাড়গোড়। গ্রেপ্তার করা হয় তিন চোরা শিকারিকে।
প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো 'বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান' হিসেবে এই বনকে চিহ্নিত করে। বিচিত্র জীববৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবন বাণিজ্যিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং আটটি উভচর প্রজাতির আবাস। এদের একটি বড় অংশ সারা দেশে তো বটেই, সারা বিশ্বেও বিরল। এর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মিঠা পানির কুমির, শুশুক, হাঙ্গর, কাঁকড়া, কচ্ছপ অন্যতম। এ ছাড়া রয়েছে কয়েক শ প্রজাতির জলজ ও বনজ উদ্ভিদ। - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2015/05/04/217866#sthash.BdTHCfKJ.3gymqyvA.dpuf
No comments:
Post a Comment