Thursday, April 9, 2015

ফুল: 'নন্দিনী' আসছে


এতোটা বয়স পেরিয়ে এলাম, তবু কি জানলাম, চড়ুইয়ের ঠোঁটে কেন এতো তৃষ্ণা? কীট বুকে নিয়ে গোলাপ, কতোটা গোলাপ?' বেদনাহত কবি আবুল হাসানের কাছে এমনিভাবে ধরা দিয়েছিল সুরভিত গোলাপ। তবে এখন বাহারি গোলাপ, রজনীগন্ধা বা গাঁদা ফুলের একচেটিয়া আদর কাড়ার দিন বুঝি শেষ হতে চলেছে। পাশাপাশি নানা জাতের বিদেশি ফুল দখল করে নিচ্ছে ফুলদানি, গৃহকোণ ও উৎসব প্রাঙ্গণ। এমনই একটি নতুন ধরনের বিদেশি ফুলের জাত 'নন্দিনী'। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ উদ্ভাবিত এই ফুল শিগগিরই বাজারে মিলবে আপন মহিমায়। আর রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী' নাটকের নায়িকার নামে নামকরণ করা নান্দনিক ফুলটি বাজারে থাকবে বছরজুড়ে। শিগগিরই বাণিজ্যিকভাবে ফুলটি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আমাদের গৃহকোণ, ভালোবাসা, উৎসব বা পূজা-পার্বণে কয়েক ধরনের গোলাপের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। তবে সারা বিশ্বে ফুল রপ্তানিকারক দেশগুলোর অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে গোলাপের চেয়ে 'লিসিয়েন্থাস' (বৈজ্ঞানিক নাম Eustoma grandiflorum) নামের ফুলের কদর বেশি। জাপানের বাজারে পাওয়া যায় প্রায় ৪৫ ধরনের লিসিয়েন্থাস ফুল। ফুলদানিতে গোলাপ যেখানে সতেজ থাকে মাত্র চার-পাঁচ দিন, সেখানে লিসিয়েন্থাস স্থায়ী হয় ১০ থেকে ১৫ দিন। আর সৌরভহীন হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে এটি কোনো অংশেই গোলাপের চেয়ে কম নয়। চারা গাছ থেকে ফুল উৎপাদন সহজ বলে চারা গাছ ও ফুলই রপ্তানি করা হয় বিদেশে। কিন্তু এ ধরনের ফুলের বীজতলা তৈরি খুব সহজ নয়।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ এফ এম জামাল উদ্দীন সম্প্রতি গবেষণাগারে উদ্ভাবন করেছেন নতুন জাতের লিসিয়েন্থাস ফুল। তিনি এর নাম দিয়েছেন 'নন্দিনী'। বীজতলা উদ্ভাবনেই তাঁর সময় লেগেছে ১১ বছর। আর এ কাজে তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল উদ্যমী ছাত্রছাত্রী। জাপান থেকে জামাল উদ্দীন ডক্টরেট ডিগ্রিও নিয়েছেন এই ফুলের ওপর।

আলাপচারিতায় উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. জামাল উদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, "সারা বিশ্বে সুরভিত ফুলের চেয়ে নান্দনিক ফুলের কদর বাড়ছে। কারণ ফুলের সৌরভে পোকামাকড়সহ রোগজীবাণু বিস্তারের ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া ফুলদানিতে ফুলের স্থায়িত্ব কত দিন সেটিও পুষ্পপ্রেমীদের কাছে জরুরি। এ জন্য ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বাজার অনেক আগেই দখল করে নিয়েছে লিসিয়েন্থাস ফুল। তবে অধিকাংশ দেশই সরাসরি চারা আমদানি করে তা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে। কারণ এই ফুলের বীজ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। এখনো এই গবেষণায় সাফল্য পাননি ভারত, নেপাল, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের কৃষিবিজ্ঞানীরা। আর লিসিয়েন্থাস ফুল চাষের এই সীমাবদ্ধতা আমরা অতিক্রম করেছি বাংলাদেশের মাটিতে, একেবারে দেশি আবহাওয়ায়। দীর্ঘ শ্রম ব্যয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে পরিমিত আলো, তাপ ও পানি সরবরাহ করে সম্প্রতি সম্ভব হয়েছে 'নন্দিনী' নামের নতুন ধরনের লিসিয়েন্থাস ফুলের চাষ। গোলাপসহ অধিকাংশ বাণিজ্যিক ফুল যেখানে সহজলভ্য শুধু শীতকালে, সেখানে 'নন্দিনী' সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ফুটলেও সারা বছরই উৎপাদন করা যায়।" নন্দিনীর চাষপদ্ধতি সম্পর্কে ড. জামাল উদ্দীন জানান, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষ বা গ্রিনহাউসে চারা উৎপাদন করতে হয়। এর বীজ অঙ্কুরোদগমের জন্য দরকার হয় জৈব পদার্থসমৃদ্ধ উন্নত মানের মিহি মাটি। অঙ্কুরোদগমে সময় লাগে সাধারণত ১০-১২ দিন। চারায় চার জোড়া পাতা গজানোর পর তা মাঠে রোপণ করা যায়। আর চারায় চার জোড়া পাতা হতে ৮০-৯০ দিন সময় লাগে। বীজ থেকে চারা উৎপাদনে দীর্ঘ সময় ও কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন হলেও পরবর্তী পরিচর্যা খুব সহজ। এ জন্য প্রথমেই জমি ভালোভাবে আড়াআড়ি চাষ দিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে জৈবিক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে জমি তৈরি করে নিতে হবে। চাষের সময় চুনের গুঁড়া জমিতে ছিটিয়ে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি বর্গমিটারে চার-পাঁচ কেজি হিসাবে পচা গোবর, ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করে ভালোভাবে জমিতে মেশাতে হবে। বীজতলার প্রস্থ এক মিটার হলে এর পরিচর্যায় সুবিধা হয়। প্রয়োজন মতো তৈরি করে নিতে হবে সেচ ও নিষ্কাশন নালা। নন্দিনী চাষে রোগ ও পোকামাকড় সমস্যা নেই বললেই চলে।

উদ্ভাবক জামাল উদ্দীন আরো জানান, ইতিমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে 'নন্দিনী' চাষের জন্য অ্যাডভান্স কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (এসিআই) সঙ্গে তাঁরা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের পর শুরু হবে বিশাল পরিসরে এর বাণিজ্যিক চাষাবাদ। ইতিমধ্যে 'নন্দিনী'র চারা আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত সরকার। অর্থাৎ দেশের বাজারের চাহিদা পূরণ করে এই ফুলের চারা গাছ বিদেশে রপ্তানিরও জোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2015/04/09/208517#sthash.UmsyxZub.oTnCnO40.dpuf

No comments:

Post a Comment