পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি (জুম্ম) জনগোষ্ঠীর গান, কবিতা, কথামালা, সুখ-দুঃখ নিয়ে এই প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে বেসরকারি বেতার 'জুম্মল্যান্ড রেডিও'। এটি পাহাড়ের ১৩টি ক্ষুদ্র ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তো বটেই, সারা বাংলাদেশের ৭৫টি ক্ষুদ্র জাতিরই প্রথম বেসরকারি বেতার। অনলাইন বেতারটির ওয়েব ঠিকানা : জুম্মল্যান্ডরেডিওডটকাস্টারডটএফএম (jumlandradio.caster.fm)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরীক্ষামূলকভাবে সম্প্রতি চালু হওয়া এই বেতারে আপাতত চাকমা ভাষার গান প্রচারিত হচ্ছে। পরে বিভিন্ন ভাষার গান প্রচারের পাশাপাশি অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এই অনলাইন বেতারের উদ্যোক্তা রাঙামাটির একদল তরুণ। তবে তারা গণমাধ্যমে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে আগ্রহী নয়।
জুম্মল্যান্ড রেডিওর ফেসবুক পেজ থেকে জানা যায়, গত ২ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে এই বেতার। দিনটি ছিল পার্বত্য শান্তিচুক্তির ১৭তম বর্ষপূর্তি। পরীক্ষামূলকভাবে এখন শুধু রেকর্ড করা বিভিন্ন চাকমা লোকগান ও আধুনিক সংগীত প্রচার করা হচ্ছে। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বেতার পরিচালকরা শ্রোতাদের মতামত সংগ্রহ করে তাদের চাহিদা বোঝার চেষ্টা করছেন। অনলাইন বেতার হওয়ায় এর সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো সারা বিশ্ব থেকেই শোনা সম্ভব। শ্রোতারা ইচ্ছে করলে অনলাইনে নিজেদের পছন্দের গান প্রচারের জন্যও অনুরোধ করতে পারেন। তবে প্রচারিত গানগুলো ডাউনলোড করে ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচবার নতুন নতুন গানের ডালা সাজিয়ে বেতারটি হাজির হয় শ্রোতাদের সামনে।
ক্ষুদ্র জাতির এই বেতারের কার্যক্রম অজ্ঞাত কারণে কয়েক দিন বন্ধ ছিল। পরীক্ষামূলক বলে এখনো তৈরি হয়নি এর কোনো নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানসূচি। এমনকি বেতারটির কোনো পরিচিতিমূলক লোগো বা মাস্ট হেডও নেই। তবে ঠিক কতটা সময় পরে বেতারটি অনলাইনে নতুন অনুষ্ঠান প্রচার করবে, তা মূল বেতারের ওয়েবসাইটে (jumlandradio.caster.fm) আগাম জানিয়ে দেওয়া হয়। ওয়েবসাইটটিতে জুম্মল্যান্ড রেডিও সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'এটি পার্বত্যবাসীর প্রথম বেসরকারি বেতার। পাহাড়ে বৈষম্যকরণ, দমন-নিপীড়ন ও বর্ণ বিভাজনের বিরুদ্ধে এই বেতার কথা বলবে। ঐতিহ্যবাহী গান, বাজনা, নাটক, কথিকার পাশাপাশি এই বেতার প্রচার করবে আসল খবর।'
ভিন্ন একটি সূত্র মতে, ক্ষুদ্র জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে কমিউনিটি রেডিও খোলার বিষয়ে বিভিন্ন মহল আগ্রহ প্রকাশ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। আর পাহাড়ে নিরাপত্তা বিঘ্ন হওয়ার আশঙ্কায় বহু বছর সেখানে বন্ধ ছিল মোবাইল টেলিফোন ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক। ২০০৭ সালে পার্বত্যাঞ্চলকেও আনা হয় মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের আওতায়।
অনলাইন বেতারটির আর্কাইভ ঘেঁটে দেখা যায়, সম্প্রতি বেতারটিতে চাকমা নাটক 'চান্দবীর ১২ মাস' প্রচারিত হয়েছে। অডিও এই নাটকটি লিখেছেন ড্যানিশ চাকমা। পরিচালনায় ছিলেন নিরুপম চাকমা। নাটকটি প্রযোজনা করেছেন সুভাশিষ বড়ুয়া। এই নাটক ছাড়াও বেতারটি পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যও প্রচার করেছে। পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীরাই মূলত এর শ্রোতা। এই উদ্যোগ নিয়ে ফেসবুকে নানা সময় নানাজন ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। আদিবাসী ভয়েজ পেজ সংহতি জানিয়ে মন্তব্য করেছে। কানাডা প্রবাসী চাকমা রাজপুত্র অর্যদেব রয় স্বাগত জানিয়েছেন এই উদ্যোগকে। আবার অনেকে রোমান হরফে চাকমা ভাষায় জানাচ্ছেন তাঁদের ভালো লাগার কথা।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন কালের কণ্ঠকে বলেন, তরুণ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আমরা আশা করব অপেশাদারিত্বের সূত্রে একদিন নিশ্চয়ই পেশাদার ও ভালো কিছু গড়ে উঠবে। পাহাড় ও সমতলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য চাই নিজস্ব গণমাধ্যম। এসব গণমাধ্যম বিনোদন দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিগুলোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও ধারণ করতে সক্ষম।
একটি বেসরকারি এফএম বেতারের তথ্য-প্রযুক্তিবিদ জ্যোতি চাকমা কালের কণ্ঠকে বলেন, জুম্মল্যান্ড রেডিওর ওয়েবসাইটটি ফ্রি হোস্টিংয়ে চলছে বলে এটি খুব বেশিদিন প্রচুর সংখ্যক অনুষ্ঠান প্রচারে সক্ষম নয়। এজন্য চাই পেশাদার অনলাইন রেডিও। এটি আবার ব্যয়বহুল ও দক্ষ জনবলসাপেক্ষ। তারপরও এ ছোট ছোট উদ্যোগ ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু করতে ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীকে আশার আলো দেখাবে। প্রসঙ্গত, সারা দেশে প্রায় ৭৫টি ক্ষুদ্র জাতির প্রায় ৩০ লাখ লোক বাস করেন। আর রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিনটি জেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেখানে বাঙালিরা ছাড়াও রয়েছে ১৩টি ভাষাভাষী পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর প্রায় আট লাখ মানুষের বাস।
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2015/04/07/207679#sthash.h8YlhZy7.fosObhHQ.dpuf
No comments:
Post a Comment