ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে মেয়র পদপ্রার্থী তিন তরুণ বাম নেতা কাফি রতন, বজলুর রশিদ ফিরোজ ও জোনায়েদ সাকি। শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন তাঁরা ঢাকা মহানগরীর নিত্য নাগরিক সমস্যাকে। নগর পরিষেবা নিশ্চিত করতে তাঁদের রয়েছে ভিন্ন মত, ভিন্ন চিন্তা। এসব বিষয় নিয়ে এই তিন প্রার্থীর সঙ্গে বিপ্লব রহমানের আলাপচারিতা
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশকে গরিববান্ধব নগরী হিসেবে ঢেলে সাজাতে চান সিপিবি সমর্থিত প্রার্থী কাফি রতন। 'হাতি' প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন তিনি। তাঁর মতে, নগরবাসীর প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম হচ্ছে আবাসন। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষ ও বস্তিবাসীর সংকট চরমে। অনেক ছিন্নমূল মানুষের কোনোক্রমে মাথা গোঁজার জায়গাটুকুও নেই। তারা ফুটপাথেই ঘুমায়। সব মিলিয়ে একটি অমানবিক ঢাকা উপস্থিত তাদের সামনে।
কাফি রতন বলেন, 'আমি বাসযোগ্য মানবিক ঢাকা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমার স্বপ্ন, বস্তিবাসীর পুনর্বাসনে ভবিষ্যতের ঢাকায় অসংখ্য বহুতল ভবন হবে। স্বল্প মূল্যে ও ২০ বছর ধরে কিস্তিতে এসব ভবন বুঝিয়ে দেওয়া হবে বস্তিবাসীকে। পুরোপুরি বন্ধ করা হবে বস্তি উচ্ছেদ। এভাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে বস্তিবাসীর আবাসন অধিকার। কিন্তু যত দিন আমরা তা না করতে পারছি তত দিন প্রতিটি বস্তিতে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।'
ঢাকার বিভিন্ন বস্তি এলাকায় সরেজমিনে গণসংযোগ ও ভোটের প্রচারণার কথাও জানান কাফি। তিনি বলেন, "গাবতলীর 'সিটি কলোনী' নামক এলাকায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা যে অমানবিকভাবে বাস করেন, তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সবচেয়ে বিস্ময়কর এই যে সিটি করপোরেশনের অনেক কর্মচারী টানা ২০-২৫ বছর ধরে অস্থায়ী নিয়োগে কাজ করে চলেছেন।" তিনি বলেন, 'ঢাকা উত্তরে পাঁচটি প্রশাসনিক অঞ্চল রয়েছে। এই অঞ্চলগুলোর মাধ্যমে নগরবাসী যেন পরিষেবা পায়, আমি সেটি নিশ্চিত করতে চাই। এ জন্য আমি চাই, এই সেবাগুলো ওয়ার্ডভিত্তিক করতে। মানুষ যেন তার নিজের ওয়ার্ড অফিসে গিয়ে সেবাগুলো পায়।'
মেয়র হিসেবে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর উল্লেখ করে কাফি রতন বলেন, 'আমি নির্বাচিত হলে মেয়র হিসেবে অনলাইনে সংযুক্ত থাকব। মানুষ তার সমস্যার কথা সিটি করপোরেশনকে বলবে। আধাঘণ্টার মধ্যে করপোরেশন তার সমস্যার সমাধানে জবাব দেবে। এভাবেই স্থানীয় সরকারকে প্রাসঙ্গিক করতে হবে।'
নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবেন সাকি : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আরেক মেয়র পদপ্রার্থী গণসংহতি আন্দোলন সমর্থিত জোনায়েদ সাকি। 'টেলিস্কোপ' প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে সোচ্চার সাবেক এই ছাত্রনেতা। সাকির মতে, ঢাকাবাসীর নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত করা গেলেই সব পরিষেবা নিশ্চিত হবে। কারণ ঢাকাবাসীর এখন কোনো নাগরিক মর্যাদাই নেই। এই শহরে পরিষেবা বদলে নগরবাসীকে পদে পদে শিকার হতে হয় হয়রানির। আবাসন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যানজট, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস- প্রতিটি পরিষেবা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। এ নগরীতে শিক্ষা যেমন নিশ্চিত নয়, তেমনি নিশ্চিত নয় নারীর নিরাপত্তা। উপরন্তু সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে নাগরিক পরিষেবা নিতে গেলে দুর্নীতিবাজ ও আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের কাছ থেকে বিস্তর হয়রানির শিকার হতে হয়।
জোনায়েদ সাকি বলেন, 'আসলে নগরবাসী অনেকে ঠিকমতো জানেনই না যে তাঁদের কী কী নাগরিক অধিকার আছে বা সিটি করপোরেশনকে ট্যাক্স দিয়ে তাঁরা কী কী সেবা পেতে পারেন। নির্বাচনী প্রচারণায় আমি এসব বিষয় সামনে নিয়ে আসছি।'
সাকি আরো বলেন, "ঢাকা এখন ভীষণভাবে শ্রমজীবী ও গরিবের বিপক্ষের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এই শহরের ওপর যেন তাদের কোনো অধিকার নেই। এই শহর শিশু বা নারীর জন্যও সহায়ক নয়। কারণ এখানে শিশুদের খেলার জন্য কোনো মাঠ নেই। গার্মেন্টসহ হাজার হাজার শ্রমজীবী নারী এ শহরে প্রতিদিন কাজে বের হয়। কিন্তু কর্মস্থলে যাতায়তের জন্য তাদের কোনো পরিবহন নেই। নেই নারীদের জন্য পৃথক টয়লেট। এমনকি তাদের কর্মস্থলে 'ডে কেয়ার' সেন্টারও গড়ে ওঠেনি। ভবিষ্যতের ঢাকা মহানগরীতে এসব সমস্যার সমাধান দিতে চাই। পাশাপাশি চাই 'ওয়ান স্টপ সার্ভিস'-এর মাধ্যমে সব নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে।"
'আগামীর ঢাকা হবে সেবামূলক' জানিয়ে জোনায়েদ সাকি বলেন, 'আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারের চরিত্র জনসেবামূলক নয়, বরং প্রভুমূলক। সিটি করপোরেশনগুলোও তেমনই প্রভুত্বমূলক। আমরা চাই, ভবিষ্যতের ঢাকা হবে সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, সেবামূলক ও পরিচ্ছন্ন একটি নগরী।'
নগর সরকার চান ফিরোজ : বজলুর রশিদ ফিরোজ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে লড়ছেন 'টেবিল' প্রতীক নিয়ে। তাঁর মতে, বহু বছর ধরে সমন্বয়হীনভাবে চলছে নগর পরিষেবা। একে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, তথা সমন্বয়ভুক্ত করতে দরকার নগর সরকার বা সিটি কাউন্সিল। এটি গঠন করা না গেলে নগরীর প্রধান সমস্য যানজট, জলাবদ্ধতা বা পানির অভাবসহ কোনো সংকটেরই স্থায়ী সমাধান হবে না।
ফিরোজ বলেন, 'ঢাকা সিটির নিত্যদিনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে প্রথমেই দরকার সিটি করপোরেশনকে ক্ষমতায়ন করা। সিটির মেয়র পদটি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন এবং তিনি একজন জনপ্রতিনিধি। অথচ আইনবলে স্থানীয় সরকার সচিব তাঁকে বরখাস্ত করতে পারেন। আইনের এসব অসংগতি দূর করা প্রয়োজন। এ ছাড়া ঢাকা নগরীতে আটটি মন্ত্রণালয় এবং ৫৬টি অধিদপ্তর কাজ করছে; কিন্তু তাদের কাজে সমন্বয় নেই। সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কাজের সমন্বয় দরকার। আর এ কাজটা করবে মেয়রের নেতৃত্বাধীন নগর সরকার। আইনের অসংগতি দূর করে সিটির ক্ষমতাও বাড়ানো প্রয়োজন। এক কথায়, সিটি করপোরেশনকে একটি সমন্বিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি এর ক্ষমতায়ন জরুরি। আমি নির্বাচিত হলে এটি বাস্তবায়নে নাগরিক আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করব।' - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2015/04/21/212883#sthash.esZqsNDS.K7xj2PRj.dpuf
No comments:
Post a Comment