সাত সমুদ্দুর তেরো নদী' পাড়ি দিয়ে দেশ-বিদেশের বণিকরা যুগে যুগে জাহাজ ভিড়িয়েছেন সোনার বাংলার ঘাটে ঘাটে। পাল তোলা অসংখ্য নৌকায় সারা পৃথিবীর সঙ্গে স্থাপিত হয়েছিল সে সময়কার বাণিজ্যিক সম্পর্ক। বাংলার পাট, হিরে-জহরত আর ঐতিহ্যবাহী মসলিন ও জামদানি নৌপথেই জয় করেছিল বিশ্ববাজার। গহনা, বজরা, ছিপ, পানসি, কোষা, ডিঙি, সাম্পান- কত সব বাহারি নামের বিচিত্র ধরনের নৌকাই না তখন ভেসে বেড়াত নদীর বুকে। রূপকথার মতোই বিস্ময়কর প্রাচীন বাংলার এই গৌরবগাথা। সে সব অবশ্য আজ কেবলই ধূলি ধূসরিত অতীত। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের পর ডিজেল ইঞ্জিন হয়ে এখন শ্যালো ইঞ্জিনে কোনো রকমে টিকে আছে এই জলযান। হাজারো রকমের বাঁধ, স্লুইস গেট, ব্রিজ-কালভার্ট, দখল আর দূষণে মারা পড়ছে নদী। এত কিছুর পরও বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পের ঐতিহ্যগত নিদর্শন, তথা প্রায় ৫০ রকমের কাঠের নৌকা বিস্ময়করভাবে এখনো দেশের আনাচে-কানাচে কোনো রকমে টিকে আছে।
প্রাচীন বাংলার ক্ষয়িষ্ণু এই শিল্পের গৌরবকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে ফরাসি নৌ-স্থপতি ইভ মার ও তাঁর স্ত্রী রুনা খান মার উদ্যোগ নিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের নৌকার নমুনা নিয়ে অভিনব জাদুঘর প্রতিষ্ঠার। বেসরকারি সংস্থা 'ফ্রেন্ডশিপ'-এর উদ্যোগে সাভারে বংশী নদীর পারে নির্মিত হবে আন্তর্জাতিকমানের এই জাদুঘর। প্রায় এক বিঘা জমির ওপর তৈরি করা জাদুঘরটিতে থাকছে ৮৫ ধরনের কাঠের নৌকার খুদে মডেল, পাঁচটি বড় মাপের নৌকা এবং অসংখ্য আলোকচিত্র।
পরিকল্পনা রয়েছে, এই জাদুঘরে ঐতিহ্যবাহী দেশি নৌকা প্রদর্শনীর পাশাপাশি নৌ-শিল্পের কারিগররা নৌকার বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় দর্শনার্থী ও গবেষকদের বুঝিয়ে দেবেন। পর্যটকদের চিত্তবিনোদনের জন্য থাকছে নৌ-ভ্রমণের ব্যবস্থাও। আগ্রহী দর্শকরা শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে কিনতে পারবেন খুদে আকৃতির মডেল নৌকা। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের জাদুঘর হবে এটিই প্রথম।
'ফ্র্রেন্ডশিপে'র নির্বাহী পরিচালক রুনা খান কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা ১০ বছর ধরে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, 'বাংলা ও বাঙালির প্রাচীনতম কাঠের নৌকার ঐতিহ্যকে সারা বিশ্বে পরিচিত করাতে আমরা প্রথমে পরিকল্পনা নিয়েছিলাম মেঘনার পারে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার। চেয়েছিলাম সোনারগাঁর মুঘল ঐতিহ্য পানাম নগরীর সঙ্গে নৌকার ঐতিহ্যকে সংযুক্ত করতে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণসহ বিপুল অর্থ বিনিয়োগের অভাবে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যায় সেই উদ্যোগ। পরে আরো দু-একটি স্থান জাদুঘরের জন্য নির্বাচন করা হলেও অর্থাভাবে সেটিও পিছিয়ে যায়। তবে আমরা হাল ছাড়িনি। রাজধানীর উপকণ্ঠে এই অভিনব জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা বরাবরই ছিলাম সক্রিয়।' রুনা মার জানান, জাদুঘর প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে তাঁরা বাংলার গৌবরগাথাকে তুলে ধরতে দেশ-বিদেশে আয়োজন করেছেন কয়েক ডজন নৌকার প্রদর্শনী। সাফল্য হিসেবে কয়েকটি দেশের নৌকার জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে আবহমান বাংলার নৌকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দেশের কাঠের নৌকাগুলোর রয়েছে নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী। এগুলোর নির্মাণ ধরন ও আকার-প্রকারের সঙ্গে বিশ্বের অপরাপর নৌকার রয়েছে বিস্তর তফাত। তবে সমুদ্রগামী নৌকাগুলো খানিকটা ব্যতিক্রম। এগুলো অন্যান্য দেশের নৌকার নির্মাণশৈলী থেকে খানিকটা নিয়ে তা ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়েছে, বিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের রূপে। সমুদ্রগামী বেশ কিছু নৌকায় রয়েছে আরব ও চীনা স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের 'সাম্পান'-এর কথা। চীনা নৌযানের নির্মাণ কৌশলে সমৃদ্ধ হয়ে যানটি রূপ নিয়েছে দেশীয় নৌযানে।
অষ্টাদশ শতকে ফরাসি নৌ গবেষক অ্যাডমিরাল প্যারিস বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে তৈরি করেন বিচিত্র সব কাঠের নৌকার নকশা। পাশাপাশি তিনি এসব নৌকা সম্পর্কে প্রাপ্ত গবেষণা-তথ্যও লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর নকশা অনুসারে নানা দেশের নৌকার আদি রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। বিস্ময়করভাবে অ্যাডমিরাল প্যারিসের স্কেচগুলোর মধ্যে এ দেশের বেশ কিছু প্রাচীন নৌকাও রয়েছে। এসব নকশায় ধরা পড়েছে আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐহিত্য। ইভ-রুনা দম্পতি সরেজমিনে দেশের নানা প্রান্তে নিবিড় অনুসন্ধান চালিয়ে দেশীয় নৌকার আরো বিবিধ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। তাঁদের প্রাপ্ত তথ্য মতে, আশির দশকে চালু হওয়া শ্যালো ইঞ্জিন সবচেয়ে বেশি ধ্বংস করেছে নৌ-নির্মাণশৈলী। পাশাপাশি রয়েছে ধাতব নৌকার দাপট। হারিয়ে যেতে বসেছে চিরায়ত পালের নৌকাগুলো। কাঠের নৌকার কারিগররা বাধ্য হন পেশা বদলাতে। নৌরুট সংকুচিত হতে থাকায় শিল্পটিই এখন বিলুপ্ত হতে বসেছে।
__
http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2015/04/02/205658
No comments:
Post a Comment