দেশের একটি ছোট্ট নৃ গোষ্ঠি 'বম' এই প্রথম নিজস্ব জাতির ইতিহাস লেখার উদ্যোগ নিয়েছে। চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা, মনিপুরি, সাওতাঁল, গারো ও খাসিয়া জনগোষ্ঠির ইতিহাস প্রকাশের পর এ দেশে বসবাসকারী ৪৫ টি ভাষাগত সংখ্যালঘু আদিবাসীদের এটি নবম জাতিগত ইতিহাস প্রকাশের উদ্যোগ।
'বম স্যোশাল কাউন্সিলের' সাবেক সভাপতি জুমলিয়ান আমলাই বম জাতিগোষ্ঠির ইতিহাস লেখার কাজ শুরু করেছেন।
তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, এ জন্য তিনি মিজোরাম থেকে নানা বই - পত্র সংগ্রহ করেছেন। মিজোরামে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বমরা বাস করেন বলে সেখানে তাদের ওপর কিছু লিখিত দলিল ও বইপত্র রয়েছে। এছাড়া সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লরেন্স জি. লোফলার ১৯৬৬ সালে বম ভাষার অভিধান প্রকাশের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি তার এই কাজটি শেষ করতে না পারলেও ড. লোফলার বমদের ওপর নিজস্ব কিছু গবেষণার কাজও করেন। এই সবই যুক্ত হচ্ছে বম জাতির ওপর লেখা এই প্রথম ইতিহাস গ্রন্থে।
জুমলিয়ান আমলাই বলেন, "১৯২৭ সালে বান্দরবানে বসবাসকারী সকল বম জনগোষ্ঠি খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে। বমদের নিজস্ব বর্ণমালা না থাকায় সে সময় ধর্ম প্রচারের জন্য পাদ্রীরা রোমান হরফে বম ভাষায় বাইবেলসহ নানা ধর্মীয় গ্রন্থ লেখেন। ৬০ দশক থেকে রোমান হরফে বম ভাষায় নানা উপকথা, গীতি কবিতা, লোক সংগীত - ইত্যাদি লেখা হচ্ছে। কিন্তু এ সবের চর্চা এখন একেবারেই কম। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে ব্যক্তি উদ্যোগে আমি এই ইতিহাস লেখার উদ্যোগ নিয়েছি।"
ইতিহাসটি ইংরেজীতে লেখা হলেও পরে এটি একই সঙ্গে বম ভাষায় ও বাংলায় প্রকাশ করার পরিকল্পনাও রয়েছে বলে তিনি জানান।
পাহাড়ি নেতা জুমলিয়ান বলেন, "খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করার পর বমদের অনেক নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতিনীতির পরিবর্তন ঘটেছে। বিলুপ্ত হয়েছে আদিধর্ম প্রকৃতি পূজা, গো - হত্যা উৎসব, বিভিন্ন অলৌকিকে বিশ্বাসসহ নানা রকমের প্রাচীন ঐতিহ্য। বয়জ্যেষ্ঠদের স্মৃতিকথা থেকে সে সবও যুক্ত করা হবে এই ইতিহাস বইয়ে। ছোট ছোট পুরনো প্রবাদ - প্রবচনেও তুলে ধরা হবে আদি বম জীবন।"
তিনি আরও জানান, বম জাতির এই ইতিহাসটি প্রকাশের আগে বর্ষীয়ান পাহাড়ি বুদ্ধিজীবী ও গবেষকদের মতামতও নেওয়া হবে। এছাড়া তারা নতুন করে ড. লোফলারের বম ভাষার অভিধান প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
আদিবাসীদের জাতীয় সংগঠন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং বম জাতির এই ইতিহাস লেখার উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, "বম একটি প্রান্তিক ভাষাগত সংখ্যালঘু, অজানা ও উপেক্ষিত জাতিগোষ্ঠি। এই ইতিহাস শুধু আদিবাসীর ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করবে না, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসকেও সমৃদ্ধ করবে।"
তিনি বলেন, "বম সংস্কৃতি, রীতি - নীতি, ঐতিহ্য ছাড়াও এই ইতিহাসে পাহাড়ি আদিবাসী মানুষের বঞ্চনার কথাও যুক্ত করা প্রয়োজন। এই ইতিহাস গ্রন্থ যে শুধু গবেষকদেরই কাজে লাগবে, তা নয়, এটি হবে নতুন প্রজন্মের আদিবাসীদের জন্য শেকড়ের সন্ধান!"
আদিবাসী লেখক দীপায়ন খীসা জানান, বাংলাদেশে বসবাসকারী ৪৫টি আদিবাসীর প্রায় ২৫ লাখ জনগোষ্ঠি রয়েছে। এদের মধ্যে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই বাস করে ১৩ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠি। ৮০র দশকে রাঙামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট প্রকাশ করে 'চাকমা জাতির ইতিহাস'। তবে চাকমা ও মারমা জাতির একাধিক ইতিহাস অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে লিখেছেন।
বম স্যোশাল কাউন্সিলের ২০০৩ সালের জরীপ অনুযায়ী, বান্দরবানে ১,৯০০ পরিবারের ৯,৪৬১ জন বম জনগোষ্ঠির বসবাস। আর রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান -- এই তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে বিন্যস্ত ৫,০৯৩ বর্গমাইল এলাকার পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি - বাঙালি মিলিয়ে আনুমানিক প্রায় ১৫ লাখ লোক বাস করে। ।
No comments:
Post a Comment