Tuesday, September 11, 2007

আদিবাসী সম্পর্কে ভুলে ভরা বাংলাপিডিয়া


এক. ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা হয়েছে 'উপজাতি' হিসাবে। তাদের খাদ্যাভাস, জীবন প্রণালী, ভাষা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য --সব কিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে।

এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে আদিবাসী সম্পর্কে অসংখ্য বিকৃতি এবং ভুল তথ্যের সমাবেশ ধরা পড়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণে। আদিবাসী নেতারা বলছেন, এই জ্ঞানকোষ পড়লে যে কেউ আদিবাসী সম্পর্কে বিকৃত ও ভুল ধারণা পাবে।
জ্ঞানকোষটির প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম এসব ভুলের কথা অকপটে স্বীকার করে বলেছেন, পরবর্তী সংস্করেণেই আদিবাসী সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য প্রত্যাহার করে তা নতুন করে প্রকাশ করা হবে। এ কাজের দায়িত্বও দেওয়া হবে আদিবাসী গবেষকদেরই।

বাংলাপিডিয়ায় দেওয়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্যের বেশিরভাগই বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কবিহীন।

আদিবাসীরা স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হলেও বাংলাপিডিয়ায় তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে 'উপজাতি' হিসাবে। সেখানে এমন অনেক তথ্য আছে যা ১০০ বছরের পুরনো, বর্তমান সময়ের আদিবাসী জীবনাচারের সঙ্গে যার কোনোই মিল নেই।

এতে মারমা ও রাখাইনদের 'মগ', টিপরা বা ত্রিপুরাদের 'তিপরা', ম্রোদের 'মুরং' - ইত্যাদি বিকৃত অভিধায় চিহ্নিত করা হয়েছে।

বলা হয়েছে, ত্রিপুরাসহ অনেক আদিবাসী নিজেদের ভাষা ভুলে গিয়ে এখন বাংলায় কথা বলে। যা আদৌ সঠিক নয়।

এতে 'উপজাতি' সম্পর্কে বলা হচ্ছে, "বাংলাদেশের বেশকিছু উপজাতি এখন নিজস্ব ভাষা বিস্মৃত হয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলে। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের তিপরাদের (?) অনেকের ভাষা বাংলা।... অনেক উপজাতি আছে বহুভাষী। গারো ও খাসিয়ারা দ্বিভাষী। বাংলা ও নিজেদের ভাষায় যুগপৎ কথা বলতে পারে। .... দু'একটি ছাড়া সব উপজাতীয় ভাষাই অলিখিত, অর্থাৎ সে সবের কোনো লিখিত রূপ নেই। চাকমা ও মগ (?) ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষার নিজস্ব বর্ণমালাও নেই।" (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯)

''খ্রিস্টান মিশনারিরা গারো ভাষায় রোমান অর প্রচলন করেন। পরে তারা চীনা চিত্রলিপির ন্যায় এক ধরনের লিপিমালাও আবিষ্কার ও প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু কোনটাই স্থায়ী হয়নি। বাংলা হরফে গারো ভাষা স্বচ্ছন্দে লেখা যায়। বর্তমানে গারোদের পারিবারিক ভাষা গারো, কিন্তু পোষাকী ভাষা বাংলা।" (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০)

"উপজাতীয়রা তাদের টোটেম ছাড়া সবই খায়। বিড়াল গারোদের টোটেম। তাই তারা বিড়াল খায় না। মগ, চাকমা ও খাসিয়ারা গোমাংস ও গারোরা গোদুদ্ধ খায় না। মগ ও চাকমা নরনারী ধূমপানে অভ্যস্ত। টক ও পঁচা চিংড়ির প্রস্তুত খাদ্য তাদের প্রিয়। ওঁরাওরা ইঁদুর, বাইনমাছ, আলু, খেসারীর ডাল ইত্যাদি খায়। ভাত পচাঁনো মদ সব উপজাতিরই প্রিয় পানীয়।" (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫)

''মগরা বাড়ি করে সমতলে।" (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬)

পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে বাংলাপিডিয়া বলছে,"পাহাড়ি ভূমি চাষাবাদের অনুপযুক্ত। তবে প্রাকৃতিক উদ্ভিদাদি প্রচুর জন্মে। পাহাড়ি ঢালে জুম চাষের প্রয়াস চলছে। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপতক্যার সমতল ভূমিতে তুলা, ধান, চা ও তৈলবীজের চাষ হচ্ছে।" (পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭১)

"কাপ্তাই হ্রদের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ যে বিপুল তির সম্মুখীন হয়, তা তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই হ্রদের জন্য তাদের মূল ভূখণ্ডের ৪০ ভাগ ভূমি হারাতে হয়। ফলে প্রায় এক লাখ লোক গৃহহারা হয়ে পড়ে। এদের অনেকে ভারতের অরুনাচলে গিয়ে বসতি স্থাপন করে বলে শোনা যায়।....১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যেমে প্রায় দুই দশকে সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান হয়।" (পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭৬)

বাংলাপিডিয়ার ইন্টারনেট সংস্করণে বলা হচ্ছে, "গারোদের প্রধান আয়ের উৎস হলো পাহাড়ের ঢালে জুম চাষ, পশু পালন ও শিকার। হস্তশিল্প ও কুটিরশিল্প এখন তাদের আয়ের আরেকটি উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।"

"স্বামী নপুংসক হলে খাসিয়া মেয়েরা একাধিক স্বামী রাখতে পারে।"

''চাকমা বর্ণমালার সাথে ত্রিপুরা বর্ণমালার মিল রয়েছে; তবে দুই ভাষার উচ্চারণ ভিন্ন।"

''মুরংদের (?) অধিকাংশই খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। অধুনা ক্রামা ধর্মের প্রচলন হয়েছে।"

দুই. আদিবাসী নেতা ও গবেষকরা বাংলাপিডিয়ার বিভিন্ন অধ্যায় পাঠ করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, বাংলাপিডিয়া পাঠ করলে যে কারো ধারণা হতে পারে, এ দেশের আদিবাসীরা আদিম, জংলী ও নরমাংসভোজী, বাংলাদেশে বাস করলেও তারা সবাই বহিরাগত। ...

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও লেখক সঞ্জিব দ্রং এই প্রতিবেদককে বলেন, "আদিবাসী সম্পর্কে বাংলাপিডিয়ার কোনো তথ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে নানান বিকৃত তথ্য দিয়ে বাংলাদেশর প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসীকে অপমান করা হয়েছে। পাশাপাশি শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়নি তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। এই গ্রন্থের দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে -- আদিবাসীরা অসভ্য, জংলী ও নরমাংসভোজী!"

পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য ও জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতা রূপায়ণ দেওয়ান বলেন, "বাংলাপিডিয়ায় 'আদিবাসী'র পরিবর্তে 'উপজাতি' শব্দটি ব্যবহার করে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার প্রতি অবজ্ঞা ও উদাসীনতা দেখানো হয়েছে।"

তিনি বলেন, "এতে অনেক ভুল, দুর্বল ও অপমানজনক তথ্য দেওয়া হয়েছে। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসও যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়নি। বংশপরম্পরায় যুদ্ধবিধ্বস্ত পাহাড়ের রক্তাক্ত স্মৃতি বহনকারী আদিবাসী মানুষের কথা উল্লেখ নেই। প্রায় ৭০ হাজার পাহাড়ি শরণার্থীর গ্ল্লানিময় জীবনের কথাও নেই গ্রন্থটিতে। কাপ্তাই লেকের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক পরিবর্তন ও জনজীবনের দুর্ভোগের কথাও নেই সেখানে।''

সাবেক গেরিলা নেতা রূপায়ণ দেওয়ান বলেন, ''শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের নয় বছর পরও এর বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্যাঞ্চলের জনজীবন যে আরো সংকুচিত হয়ে পড়েছে, বাংলাপিডিয়া পাঠ করলে তার কিছুই জানা যাবে না।"

গারো আদিবাসী নেতা ও লেখক বাঁধন আরেং বলেন, "গারোদের সম্পর্কে ওই গ্রন্থে ব্যাপক তথ্য বিকৃতি রয়েছে। গারোদের খাদ্যাভাস, বর্ণমালা, জীবনাচার সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে, তার অধিকাংশই ভুল।"

তিনি বলেন, "বন উজার হওয়ার কারণে প্রায় ২০ বছর আগেই গারোরা জুম চাষ বন্ধ করেছে। বন না থাকায় শিকারও এখন হয় না। শিক্ষিত - অশিক্ষিত সব গারোই পেশা পরিবর্তন করেছে। এছাড়া শুধু গারো বা খাসিয়ারা নন, এ দেশের সব আদিবাসীই দ্বিভাষী, তাদের পোষাকি ভাষা হচ্ছে বাংলা।"

খাসিয়া আদিবাসী নেতা অনিল ইয়াং ইউম বলেন, "খাসি নারীর বহুপতি সম্পর্কিত তথ্য একেবারেই ভুল। বন ও বনভূমি সংকুচিত হওয়ায় আদিবাসী জীবনে সৃষ্ট দুর্ভোগের কোনো কথাই ওই গ্রন্থে বলা হয়নি।"

ত্রিপুরা নেতা বিনতাময় ধামাই বলেন,"ত্রিপুরা ভাষা মোটেই বিলুপ্ত হয়নি। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা ও কর্মজীবনের প্রয়োজনে আমরা কেবল বাংলা ব্যবহার করছি।"

তিনি বলেন,"ত্রিপুরাদের ব্যবহারিক বর্ণমালার সঙ্গে চাকমা বর্ণমালার কোনো মিলই নেই। নিজস্ব বর্ণমালা না থাকায় বহু বছর ধরে আমরা রোমান বা ইংরেজি হরফে নিজস্ব ভাষা চর্চা করছি।"

ম্রো আদিবাসী নেতা রাংলাই ম্রো বলেন, "বাংলাপিডিয়ায় আমাদের 'মুরং' বলে হেয় করা হয়েছে। ম্রোদের 'ক্রামা' নামে নিজস্ব ধর্ম ও বর্ণমালা আছে। আমরা ম্রো বর্ণমালার কম্পিউটার সফটওয়ারও তৈরির চেষ্টা করছি।"

তিনি বলেন, "ম্রো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে যেসব তথ্য বাংলাপিডিয়ায় আছে - সেগুলো হয় বিভ্রান্তিকর, নয়ত ১০০ বছরের পুরনো জনজীবনের কথা।"

তিন. আদিবাসী সম্পর্কে বাংলাপিডিয়ায় এসব তথ্যবিভ্রান্তির কথা অকপটে স্বীকার করেছেন এর প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, "আদিবাসী নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা এরই মধ্যে এই বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন।"

নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতা তথ্য বিকৃতির একটি কারণ স্বীকার করে তিনি বলেন, "আমরা যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি, তারা মনে করি অন্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তা মানেই অনগ্রসর, আদিম ও অসভ্য। এ কারণে বাংলাপিডিয়ার মতো একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থে এসব মারাত্মক ত্রুটি রয়ে গেছে।"

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন,"একটি জাতিসত্তা যতোই ছোট হোক না কেনো, তাদের ভাষা, বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যাভাস, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ঐতিহ্য-- সবই শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে। বাংলাপিডিয়ার নানা খণ্ডে এই দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ ঘটেনি।"

তিনি জানান, জ্ঞানকোষের দ্বিতীয় সংস্করণে আদিবাসী সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য বাদ দিয়ে তা নতুন করে সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবার আদিবাসী লেখক ও গবেষকদের দেওয়া হবে এই কাজ। আর তা সম্পাদনা করবেন নৃতত্ত্বের একজন গবেষক। বিভ্রান্তি ও তথ্য বিকৃতি এড়াতে তথ্যগুলা প্রকাশের আগে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নেতাদের মতামতও নেওয়া হবে।

_______
ছবি: কাপ্তাই লেকে ডুবন্ত পুরনো চাকমা রাজবাড়ি, রাঙামাটি, ১৯৬০।

No comments:

Post a Comment