Monday, September 17, 2007

অবাক জলপান


ভোর পাঁচটার দিকে লুঙ লেই পাড়া জেগে উঠতে শুরু করেছে মাত্র। তখনো আলো ফোটেনি। মাত্র গোটা বিশেক ঘর নিয়ে এই বম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গ্রাম বা পাড়াটি গড়ে উঠেছে সেই ব্রিটিশ আমলে। উচুঁ পাহাড়ের ওপর স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর ছোট্ট গ্রাম। বান্দরবান-মায়ানমারের সীমান্তে গহিন জঙ্গল ঘেরা এক অন্য জনপদ।


আমার গাইড বম নেতা জুমলিয়ান আমলাই। দুজনের হাতেই তিন ব্যাটারির লম্বা টর্চ। গাছপালা, পাহাড় আর কুয়াশার জন্য প্রায় কিছুই ভাল করে নজরে পড়ে না। অনেকটা অন্ধের মতো অনুসরণ করছি জুমলিয়ান দা'কে।

জুমলিয়ান আমলাই একজন পরিশ্রমী মানুষ। বয়স ৫৫ প্রায়। সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তখন ওনার গেরিলা পদ মর্যাদা ছিলো করপোরাল। উনি আমার খুব ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন।

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে, পাহাড়ের পর পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে হঠাৎ শুনতে পাই ছম ছম ছমমম্ অবিরাম শব্দ। থমকে জিজ্ঞেস করি ‘সিয়ান কি দা ?’ জুমলিয়ান দা মুচকি হাসেন।
ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো শীতে পা জমে আসতে চায়। জঙ্গলের ভেতর অজানা পাখি ডানা ঝাপটায়। কুয়াশা জমে শিশির হয়ে গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়ে। শীতকাল বলে রক্ষা। নইলে বর্ষায় নাকি গাছ থেকে বিষাক্ত সাপও গায়ের ওপর এসে পড়ে!

এবার দুজনে ছোট একটা পাহাড় থেকে নীচে নামতে থাকি। ছম ছম শব্দ এখন আরো প্রকট হচ্ছে। হঠাৎ টর্চের আলোয় এক বিস্ময়ের খানিকটা দেখে জুমলিয়ান দা’র বাহু আকড়ে ধরি। ‘ও দা, ও দা, মুই মরি যেম।’

দেখি আমার সামনে ধারণার চেয়েও উচুঁ এক খাড়া পর্বত। সেটার প্রায় পুরো শরীর কুয়াশায় ঘেরা। পর্বতে চূড়া থেকে ফিনকি দিয়ে নেমে আসছে সাদা সিল্কের ফিতার মতো বিশাল এক ঝর্ণা। সেই ছম ছম ছমমমম্ এখন হুম হুম হুমমমমম্ শব্দে পরিনত হয়েছে।

বহুবছর ধরে নেমে আসতে থাকা ঝর্ণার জলের আঘাতে নীচের পাথর ক্ষয়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট্ট এক পাথুরে কূপের। সেখান থেকে আবার একেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ছড়া।

জুমলিয়ানদা নিজস্ব তাঁতে বোনা ঝোলা ব্যাগ থেকে বের করেন দুটি বড় বড় তাঁতের গামছা। দুজনের কারো মুখে কোনো কথা নেই। চুপচাপ জামা কাপড় খুলে গামছা পড়ে নেমে পড়ি ঝর্ণার জলে। হিম শীতল একটা বৈদ্যুতিক শক কাঁপিয়ে দেয় আমার অন্তর্আত্না! সম্ভবত: দুসেকেন্ডের জন্য আমি চেতনা হারিয়ে ফেলি।

পরে টের পাই আমার ভেতর থেকে নিমেষে উবে যাচ্ছে ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান, বান্দরবান থেকে লক্কড়-ঝক্কর জিপে চেপে রোয়াঙছড়ি, রোয়াঙছড়ি থেকে পায়ে হেঁটে ব্যাঙছড়ি, ব্যাঙছড়ি থেকে ১০ মাইল নন স্টপ পাহাড়ের পর পাহাড় ভাঙার শরীরী বেদনা, আর না পাওয়ার সব বঞ্চনাসমূহ...

হঠাৎ সূর্যদেব উঁকি মারেন পাহাড়ের চূড়ায়। ঝর্ণার জল তখন সাদা থেকে সোনালী রূপ নিয়েছে। আমার জন্য তখন অপেক্ষা করছিলো আরেক বিস্ময়! মাথা একেবারে পেছনে হেলিয়ে দেখি পাহাড়ের চূড়ায়, ঝর্ণার উৎসে দেখা দিয়েছে আধখানা এক রঙধনু!...

আমি আজলায় পানি খাই। মনে মনে বলি, ও পাহাড়, তোমায় প্রনাম।
--
ছবি: (c) দুর্গম পাহাড়, জুয়েল চাকমা পরান

No comments:

Post a Comment