Monday, March 13, 2023

মা আর নেই!

 ১.

ঢাকার সেগুনবাগিচায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন কার্যক্রম কেন্দ্রের নিওন সাইনে শোল্ডার লাইনে কালো হরফে বেশ কাব্য করে লেখা, "মমতার পরশে শেষ বিদায়"! 

সেখানেই আমার সদ্য প্রয়াত  বৃদ্ধা মা, রেডিও অফিসের অবসরপ্রাপ্ত আপার ক্লার্ক সৈয়দা আজগারী সিরাজীর  (৮২) প্রাথমিক সৎকাজ, যাকে চলতি ভাষায় বলে 'লাশের গোসল' দেয়া হয়। 

মার দেহটি সাদা কাফনের কাপড়ে মুড়ে একটি সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা, স্টিলের স্ট্রেচারে বডি ঘিরে ৫-৬জন নারী সবুজ সালোয়ার-কামিজ-হিজাব পরা, তারাই লাশের গোসল দিয়েছেন। 

মার মৃত মুখটি দেখার জন্য কিছু ঘনিষ্ঠ হই, নাকের ফুটোয় তুলে গুঁজে দেয়ায় স্পষ্ট হয়, নিঃশ্বাস প্রবাহের ব্যবহার ফুরিয়েছে, চোখ আধবোজা, শান্ত মুখশ্রী, যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। 

মার স্ট্রেচার ঘিরে ধরেন আমার বোন, আত্মীয়-স্বজন, আরও অনেকে, যাদের অনেককেই আমার শৈশবে দেখা, স্বীকার করি, দীর্ঘ যোগাযোগহীনতায় বেশী ভাগকেই আমার অপিরিচিত মনে হয়। তবে সিরাজগঞ্জের আত্মীয়দের নাড়ির টানেই বেশ চিনে যাই। 

ছোট্ট কাঁচের কেবিনে, লাশ গোসলের কামরায় তীব্র আতর, ফিনাইল, এসির হাড় হিম করা বাতাস, নির্ঘুম রাতের পর মর্নিং ডিউটির ধকলে আমার মাথা ধরে যায়। সেখানের উজ্জ্বল আলো যেন মাইনাস সিক্স লেন্স ভেদ করে দুচোখের রেটিনা পুড়িয়ে দিতে চায়।  

আমি দরজা ঠেলে বাইরে এসে খোলা বাতাসের সন্ধানে এদিক-সেদিক তাকাই, চারপাশের সারি সারি সাদা রঙের লাশবাহী এম্বুলেন্স যেন আমাকে চেপে ধরে। আরেকটু এগিয়ে উঠোন পেরিয়ে আধো অন্ধকারে একটা শিল কড়ই গাছের নীচে দাঁড়াই, হা করে শ্বাস নেই, অফিসের ব্যাগ হাতড়ে ফ্লাক্স খুলে পানি খাই। কেউ একজন এক রত্তি কাগজের কাপে জিরো ক্যাল কফি ধরিয়ে দেয়, অতিরিক্ত চিনি দেয়া কফির স্বাদ কুৎসিত লাগলেও দু-এক চুমুকে কফি সবটুকু খেয়ে বিবমিষা নিয়ে মার মৃতদেহ বুঝে পাওয়ার অপেক্ষা করি। তখন মধ্য রাত গড়িয়েছে। 

মা, আজগারী সিরাজী মারা গেছেন ১৩ মার্চ, রাত পৌনে ৯টায়। আমি তখন এটিএন নিউজে অফিস ডিউটি সেরে মগবাজারের বাসায় ফেরার পথে কারওয়ান বাজারের মাছের বাজার ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। মাঝারি মাপের টুনার সন্ধান করেও পাই না। হরেক রকম চাষের মাছ, নদীর মাছ, হাওরের মাছ, সমুদ্রের মাছ এবং অনিবার্য রাশি রাশি রূপালি ইলিশ যেন বিভ্রম তৈরী করে। শুকনো গলায় জোড়া ইলিশের দাম জেনে গলা আরও শুকিয়ে আসে। 

তখনই মাছের বাজারে হট্টগোলে বুঝতে পারি, টানা ফোন বেজে যাচ্ছে। কিছু ফাঁকা জায়গায় এসে সব মিসড কল উপেক্ষা করে ছোট আপা সোমাকে বাটন ফোনে কল করি, কিরে? কেমন আছিস? সোমা আপা ভনিতা না করে স্পষ্ট গলায় বলেন, মা আর নেই! আমি বলি, নেই মানে কী? সোমা আপা বলেন, চলে গেছেন! আমি খুব চমকে গিয়ে হরবর করে কিছু বলি বা বলার চেষ্টা করি। আসলে কিছুই বলতে পারি না। 

আমি যথা দ্রুত রিকশা ও পরে সিএনজি (চালিত অটোরিকশা) ধরি, কাছেই মগবাজারে নিজের বাসায় পৌঁছে অফিস ব্যাগেই দুয়েকটা জামা-কাপড় গুছিয়ে নেই, মাকে মাটি দিতে সিরাজগঞ্জে যাবো, তারই প্রস্তুতি। 
তখনই বড় আপা তানিয়ার নয়া পল্টনের বাসায় যাই।  
২.

সপ্তাহ দুয়েক আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মাকে সিরাজগঞ্জের গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকার পপুলার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। বার্ধক্য জনিত কারণে নানান অসুখে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন তিনি। সেখানে আমার পুরনো বন্ধু, সাবেক ছাত্র - সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধা ডা. মনিরুল ইসলাম কচি ভাই মাকে দেখাশোনা করেন।

অন্তত বছর সাতেক ধরে গুরুতর আলঝেইমার্সে ভুগে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছিল মার। তার সার্বক্ষণিক সেবাদাত্রী সোমা আপাকে মা  কখনো চিনতে পারতেন, অল্প কিছু কথা বলতেন। বেশীর ভাগ সময় তা-ও পারতেন না। দিনের পর দিন নিশ্চুপ-নির্জিব হয়ে থাকতেন। শেষের দিকে বেড শোর হয়েছিল, আহার-নিদ্রা-প্রাতকৃত্য সবই অনেক দিন ধরে বিছানায়। না খাওয়ার কঠিন চেষ্টায় শুকিয়ে গিয়ে বিছানার সাথে মিশে গিয়েছিলেন। এভাবেই সেদিন রাতে নয়াপল্টনের বাসায় দেহ রাখেন তিনি। 

বার বার নিজেকে বোঝাই, আজীবন সারথি জয়ীকেও একই কথা বলি, মার মৃত্যুর জন্য ভেতরে ভেতরে আমরা প্রত্যেক ভাইবোন প্রস্তুত ছিলাম, জীবনের মতো মৃত্যুও অনিবার্য! তবু চোখ মুছলেও যেন কান্না মোছে না।...

বলা ভাল, জীবনের শেষ বছরগুলোতে মা  স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ায় একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে, ৫ বছর আগে প্রথমে আমার পক্ষাঘাতগ্রস্ত বড় ভাই, পপ সম্রাট আজম খানের গিটারিস্ট মেসবাহ রহমান, মানব যখন ঘুমের ভেতর হার্ট অ্যাটাকে মারা যান, এর একমাস পর সাবেক নকশাল নেতা, আমার বাবা আজিজ মেহের (৮৬) যখন একইভাবে ভোর রাতে হার্ট অ্যাটাকে চলে যান, মা এসব কিছুই টের পাননি। দিব্যি চেয়ার পেতে বসে সব দেখেছেন। কখনো হঠাৎ আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছেন, তুই কে রে? কবে আসছিস? এরা কারা? এতো মানুষ?... আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কি কি যেন সব বলেছিলাম, তা এখন মনে নেই। আন্দাজ করি, হয়তো গাল-গল্প হবে। 

৩.

সেই ছোটবেলায় দেখছি, আমার রেডিও অফিসের কেরানী মা সৈয়দা আসগারী সিরাজী খুব ভোরে উঠে পাঁচটি ছেলেমেয়ের নাশতা, দুপুরের খাবার-- সব তৈরি করে ছুট লাগাতেন কর্মস্থলে। এরপর বিকেলে এসে আবার সবার জন্য দুই চুলায় বড় বড় হাঁড়িতে রান্নাবান্না। বালতি  বালতি কাপড় ধোয়া। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা ইত্যাদি। জ্ঞান হওয়া পরে বুঝেছি, আমার মা বাস ভাড়ার সামান্য পয়সা বাঁচানোর জন্য খর রোদের ভেতর হেঁটেই অফিস যাতায়ত করতেন। বাসায় ফেরার সময় বাজার করেও ফিরতেন। সে এক কঠিন লড়াই!

সিরাজগঞ্জে আমার মা’র পরিবারটি শিক্ষা-দীক্ষা, গান-বাজনায় খুব অগ্রসর। নানু সৈয়দ ইসাহাক সিরাজী ছিলেন  নামকরা স্কুল মাস্টার।  তার বড়ভাই-- কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। তিনি ছিলেন কাজী নজরুলের বন্ধু। আর আমার নানু বাড়ির নাম ‘বাণীকুঞ্জ’ নামটিও নজরুলের দেয়া। দুজনেই তুরস্ক যুদ্ধে একসাথে লড়েছিলেন। সে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য মুসলিম জাগরণের কবি ইসমাইল হোসেনকে তুরস্ক সরকার 'সিরাজ' (ঊষা)  খেতাব দেন। শুনতে পাই, তুরস্কের কেন্দ্রীয় জাদুঘরে ইসমাইল হোসেন সিরাজীর কীর্তি ছবিসহ সংক্ষিপ্ত লেখায় তুলে ধরা হয়েছে। 
 
নানু ইসমাইল সিরাজীর ছেলে, মা’র চাচাতো ভাই আসাদুল্লাহ সিরাজীও ছিলেন কবি, গীতিকার। অনেক সুন্দর গজল লিখেছেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তানপন্থার কারণে, শান্তি কমিটির নেতা হওয়ায় ১৯৭১ এ মুক্তিবাহিনী তাকে নিধন করে। 
 
আসাদুল্লাহ সিরাজীর লেখা একটি বিখ্যাত গান "ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশীদিন তোদের মাঝারে" এখনও লোকমুখে ফেরে। একদা এন্ড্রু কিশোর এই গান সিনেমায় গেয়ে জনপ্রিয় করেছেন। দুই বাংলার বাউলরাও বিভিন্ন আসরে এই গান  করেন, ইউটিউবে দেখেছি। তবে সম্ভবত সঠিক সুরে, তালে গানটি বাণীবদ্ধ করেছে গান-বাংলা টিভি চ্যানেল। 

বলা ভাল, আমার দুই খালা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা- সংগঠক। তাদের স্বামীরাও ছিলেন মুক্তিবাহিনীর নেতা। ছোট খালা, এলিজা সিরাজী (দু বছর আগে প্রয়াত) ছিলেন রীতিমতো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেত্রী, ১৯৬৯ এর ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের নেত্রী। আর একমাত্র আপন মামা মন্টু সিরাজী মুক্তিবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবক রাজাকারদের হাতে ১৯৭১ এ গুম খুন হন। তার দেহটুকুও খুঁজে পাওয়া যায়নি!
 
৪. 
একসময় আমার মা ছিলেন ডাক সাইটের সুন্দরী। তখনকার সিনেমা নায়িকা মধুমালা’র সঙ্গে মিলিয়ে মা’র নাম রাখা হয় "মধু"। আমার নানি আদর করে মা’কে "সিরাজী বিটি" (সিরাজীর মেয়ে) বলে ডাকতেন। নানু’র উৎসাহে আমার মা স্কুল-কলেজে পড়ার সময় গান-বাজনা করতেন। পাকিস্তান আমলে মঞ্চ নাটকও করেছেন। এই করতে গিয়েই আমার বাবার সঙ্গে তার পরিচয়। আমার বাবা বিয়ের পর কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে মা’কে মডেল করে অনেক সাদাকালো ছবি তুলেছিলেন।

আমার প্রয়াত বাবা আজিজ মেহের (৮৪) সব সময় কৃষক রাজনীতি নিয়ে কাটিয়েছেন ব্যস্ত সময়। বহু বছর জেল খেটেছেন। এক সময় বিখ্যাত নকশাল নেতা ছিলেন। সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। সংসারে কখনো মন দেননি। আর পুরো সংসারের ঘানি টেনেছেন মা একাই। বাবা জীবনের শেষ ২০ বছর বই পড়ে অবসর জীবন কাটিয়েছেন। ওই বয়সেও তার মাথা ছিল খুব পরিস্কার। তার মতো এত আধুনিক,  এতো জ্ঞানী মানুষ আর একজনও দেখি না।... তার মৃত্যুতে "আমার বাবা আজিজ মেহের" শিরোনামে একটি ব্লগ নোট লিখেছিলাম, গুগল করলে সেই লেখাটি বোধহয় পাওয়া যাবে। আমার বাবার মতো বাবা আর হবে না। মা-ও আর হবে না! 

ছোটবেলায় দুষ্টুমীর জন্য, পড়ায় ফাঁকি দেয়ার জন্য, এমনই সব বিবিধ কারণে মা’র কাছে অনেক বেতের বাড়ি খেয়েছি। কখনো হাত পাখার বাড়ি। আবার কখনো ভাত রান্নার কাঠের হাতা’র বাড়িও (স্থানীয় ভাষায় – নাকড়)।  
প্রথমে স্লেট -চকে মার কাছে অক্ষর জ্ঞান হওয়ার পর, কাঠ পেন্সিলে উন্নতি হয়েছিল আমাদের। অভাবের সংসারে লেখাপড়া চালানোর জন্য রেডিও অফিসের বাতিল সাইকোস্টাইল কাগজের উল্টো সাদা পাতার খাতা বানিয়ে দিতেন। সেই সব খাতায় আমরা ভাইবোনরা পেন্সিল ঘষে লেখাপড়া করেছি। 

আমার মা তার জীবন উৎসর্গ করেছেন ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠা করার  জন্য। সততার আদর্শ ছাড়া বাবা-মা কেউই কোনো স্থাবর-অস্থাবর কোনো সম্পদই রেখে যাননি। 

আমার মা হয়তো শেষ জীবনে আরেকটু সন্মান, পারিবারিক স্নেহ, কোয়ান্টামের ভাষায় "মমতার পরশ" পেতে পারতেন, স্বীকার করি, যন্ত্র জীবনে এর কিছুই তিনি আমাদের কাছ থেকে পাননি। এক ব্যতিক্রম ছোট আপা সোমা ছাড়া। 

...আসলে মায়েরা বোধহয় এমনই হন। আর যুগ যুগ ধরে তার ছেলেমেয়েরাও।... 
৫. 
লেখার শিরোনাম "মা আর নেই" কথাটি ওপারের দৈনিক আনন্দবাজারের ব্যানার হেডলাইন নিউজ থেকে নেওয়া। মাদার তেরেসা যেদিন মারা যান (৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭), সেদিন আনন্দবাজার পত্রিকা এই শিরোনামে তেরেসার করজোড়ে প্রনামের ভংগিমার ছবিসহ কাভার ছেপেছিল। প্রথম পাতায় শুধু সাদাকালো ছবি ও ব্যানার হেড ছিল, সংবাদ ছিল ভেতরের পাতায়।...

No comments:

Post a Comment