বলা ভাল, দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা বরাবরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি-অনিয়মের ওপর একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছিলেন।
খবরে প্রকাশ, রোজিনা ইসলাম গত ১৬ মে দুপুরের পর পেশাগত দায়িত্ব
পালনে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁকে একটি কক্ষে
আটকে রাখেন। প্রায় ছয় ঘণ্টা পর রাত সাড়ে আটটার দিকে রোজিনাকে শাহবাগ থানা-পুলিশের কাছে
হস্তান্তর করা হয়। তাঁকে রাত ৯টার দিকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
পরে রাত পৌনে ১২টার দিকে তাঁর বিরুদ্ধে
শাহবাগ থানায় ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেট্রেস অ্যাক্টের কয়েকটি ধারায় রোজিনার বিরুদ্ধে
মামলা করা হয়। মামলার বাদী হন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব
শিব্বির আহমেদ ওসমানী।
সেদিন যা হয়েছে সচিবালয়ে
পুলিশ রোজিনাকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরদিন ১৭ মে আদালতে হাজির করে। একই সঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। অন্যদিকে রোজিনার জামিনের আবেদন জানান তাঁর আইনজীবীরা। ওই দিন শুনানি নিয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম রিমান্ড আবেদন নাকচ করেন এবং রোজিনার জামিন আবেদনের ওপর অধিকতর শুনানির জন্য ২০ মে দিন ধার্য করেন। সেদিন আদালতের নির্দেশে রোজিনাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
ওইদিনই আদালত চত্বরে কড়া পুলিশ বেষ্টনীর ভেতরেই রোজিনা তার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে সংবাদ করায় তার ওপর অন্যায় করা হচ্ছে।
আমার সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে : রোজিনা
পরে ২০ মে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ভার্চ্যুয়ালি জামিন শুনানি হয়। ২৩ মে জামিন আদেশ দেওয়ার কথা জানায় আদালত। আবারো তাকে পাঠানো হয় কারাগারে। অর্থাৎ জামিনের তারিখের পর তারিখ ফেলে রোজিনাকে অন্তত সাড়ে ছয়দিন কারাবাস ভোগ করতে হচ্ছে।
আদালতের সামনে গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড়
করেন। ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি। অন্তত দুই প্লাটুন নারী-পুরুষের
পুলিশ সদস্য সার্বক্ষিণভাবে ঘিরে রাখেন রোজিনাকে।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধিতে করা এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব ১৯ মে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) দেওয়া হয়েছে।
ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা
রোজিনা গ্রেপ্তারের দিন রাতেই শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নিয়ে তার সাংবাদিক সহকর্মিরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরদিন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সাংবাদিকরা রোজিনার হয়রানীমূলক মিথ্যে মামলা প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রাজপথে নামেন। প্রচণ্ড খর রোদ ও ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে সাংবাদিক সংগঠনগুলো সারাদেশের জেলা প্রেসক্লাবগুলোর সামনে মানববন্ধন, পথসভা, বিক্ষোভ মিছিল করেন। এর পর থেকে প্রতিদিনই রোজিনা গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশজুড়ে চলা বিক্ষোভে সাংবাদিক সমাজের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন লেখক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীরাও। লন্ডনে প্রবাসী সাংবাদিকরাও রোজিনার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
বাংলাদেশে সাংবাদিক হেনস্থা ও গ্রেপ্তারের ওই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে খোদ জাতিসংঘ, অ্যামোনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স ইউদাউট বর্ডারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।
তবে সরকারের মন্ত্রীরা বোধহয় কানে তুলো দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিক গ্রেপ্তারের পরদিনই ১৭ মে সাংবাদিকদের বলেন, রোজিনাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি! তিনি নিজেই অসুস্থ্য হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের করোনা টিকা সংক্রান্ত গোপন নথি তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন, যা প্রকাশ হলে দেশের ক্ষতি হতে পারতো। একারণে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে – ইত্যাদি।
একদিন পর ১৮ মে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন একই কথা, রোজিনা “নন ডিসক্লোজেবল ডকুমেন্ট” নিয়ে যাচ্ছিলেন, এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিক নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন, পুলিশ হেফাজতে রোজিনা যেন সুচিবার পান, তা তারা নিশ্চিত করবেন।
সবশেষ ২০ মে সাংবাদিক রোজিনাকে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ‘দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। বিদেশে ভাবমূর্তির প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, গুটিকয় লোকের জন্য বদনামটা হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এটা ফেস করতে হবে। অনেকে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। সরকার এ ধরনের ঘটনা চায় না।
এরই মধ্যে সাংবাদিক নেতারা মন্ত্রীদের এসব কথার প্রতিবাদ করেছেন। মন্ত্রীরা দুর্নীতি আড়াল করতে গিয়ে সাংবাদিকতাকেই “চুরি” হিসেবে গণ্য করছেন! প্রশ্ন উঠেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কি পারমানবিক বোমা তৈরির ফর্মূলা পাওয়া যায়, যা রোজিনার মাধ্যমে গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে দেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব হুমিক মুখে পড়তো? তাছাড়া কোন ক্ষমতাবলে অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসার পিয়ন-চাপরাশিরা একজন সাংবাদিককে আটকে রেখে গলা টিপে ধরেন, প্রায় ছয় ঘন্টা ধরে আটকে রেখে জেরা-তল্লাসী-হেনস্থায় নাজেহাল করেন?
রোজিনা গোপন নথি নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাকে নির্যাতন করা হয়নি
একটি ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরি ও মহান সাংবাদিকতা
সাংবাদিকতার বিষয়ে উৎসাহীরা অনেকেই
১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘পেন্টাগন পেপার্স’ বিষয়ে
অবহিত আছেন। তবু মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন সরকারের প্রতিরক্ষা
দফতর একটি সমীক্ষা করে ১৯৬৭ সালে, সে সমীক্ষা যারা করেন তাদের একজন ড্যানিয়েল এলসবার্গ,
এই গোপন দলিলগুলো নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকের হাতে তুলে দেন ১৯৭১ সালে কেননা তিনি
সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তার বক্তব্য ছিল এগুলো মার্কিন নাগরিক, যাদের
অর্থে ভিয়েতনামে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে, তাদের জানার অধিকার আছে। তিনি মনে করেছেন যে,
সরকার মিথ্যাচার করছে। একই সময় ওয়াশিংটন পোস্টের হাতেও এই দলিলগুলো পৌঁছে। দুই পত্রিকাই
এগুলো ছাপার উদ্যোগ নেয়।
নিউইয়র্ক টাইমস ১৩ জুন থেকে ধারাবাহিকভাবে এই বিষয়ে প্রতিবেদন এবং দলিল ছাপতে শুরু করার পরে তিন দিনের মাথায় আইন মন্ত্রণালয় আদালতের কাছ থেকে সাময়িক রেস্ট্রেইনিং অর্ডার লাভ করে। এর আগে হোয়াইট হাউস এগুলো না ছাপতে অনুরোধ করেছিল, পরে হুমকি দিয়েছিল যে, তাদের রিপোর্টারদের হোয়াইট হাউসে প্রবেশাধিকার থাকবে না।
মার্কিন সরকারের বক্তব্য ছিল, এগুলো
প্রকাশিত হলে “জাতীয় নিরাপত্তা” বিঘ্নিত হবে। নিউইয়র্ক টাইমস এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে
যায়।
সেই সময়ে নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে যোগ দেয় ওয়াশিংটন পোস্ট; দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্র একত্রে সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছিল, তাদের যুক্তি ছিল, যে নাগরিকের জানার অধিকার রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ৬-৩ ভোটে রায় দিয়েছিল যে, সরকার প্রমানে ব্যর্থ হয়েছে যে কেনো এইসব দলিল প্রকাশের ফলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এরপরে বোস্টন গ্লোব এবং অন্যান্য কাগজেও এইসব গোপন দলিল প্রকাশিত হয়।
এক পর্যায়ে এসে সিনেটের এক সাব-কমিটির শুনানিতে সিনেটর মাইক গ্রাভেল এই সব দলিলের অংশবিশেষ জোরে জোরে পড়ে শুনিয়েছিলেন, যাতে করে এই দলিলগুলো প্রকাশ্য হয়ে পড়ে।
পরে নিক্সন প্রশাসন এলসবার্গ আর তার
সহযোগি এন্থনিও রুশোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, গোয়েন্দাবৃত্তি এবং সরকারি সম্পত্তি চুরির
মামলা করেছিল, সে মামলায়ও সরকার পরাজিত হয়েছিল।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতাকে “তথ্যচুরি” বলা হচ্ছে
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ এর আওতায় আনা মামলার প্রসঙ্গে নতুন করে আবার ওই ঐতিহাসিক “রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির” ঘটনাটি আবারো সামনে আসছে।
আর প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলের ওই নির্যাতনমূলক মান্ধাতা আইন পাকিস্তান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরেও স্বমহিমায় টিকে থাকাই বিস্ময়কর। সব আমলেই সরকার বাহাদুর সাংবাদিকদের গলা টিপে ধরতে কালো আইনটি অবিকল বহাল রেখেছেন, সংস্কার করারও প্রয়োজন মনে করেননি।
“ভয় পাস ক্যান? আমরা কী অন্যায় কিছু করেছি?”
সাংবাদিক রোজিনা নিশ্চয়ই বীরের বেশে বেরিয়ে এসে আবারো নির্ভিকভাবে ঝড় তুলবেন কি-বোর্ডে, একের পর এক চোখা সব প্রতিবেদনে উন্মোচন করবেন দুর্নীতিবাজদের মাস্কের আড়ালের কুৎসিত মুখ। পেশাগত কারণে দেশজুড়ে তিনি যেমন অনেক সহকর্মী-শুভানুধ্যায়ী ও পাঠককে বন্ধু হিসেবে পাশে পাচ্ছেন, তেমনি শত্রুও তো কম তৈরি করেননি। এ ঘটনায় রাষ্ট্র যেন “ঝিকে মেরে বৌকে শিক্ষা” দেওয়ার পন্থাই নিল, যে গণমাধ্যম আসলে গণতন্ত্রেরই স্তম্ভ!
নতুন করে আবারো মনে পড়ছে, সম্প্রতি পুলিশ হেফাজতে নিহত লেখক মুশতাক আহমেদের কথা।
ব্যাঙ্গচিত্র আঁকার অভিযোগে কিছুদিন আগেই কার্টুনিস্ট কিশোর অপহরণ, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন হওয়ার কথা। তারও কিছুদিন আগে নির্যাতনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে লেখক মুশতাক কারাবন্দী অবস্থায় মারা যান। ফেসবুকে লেখালেখির দায়ে তাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, হৃদরোগে মারা গেছেন তিনি।
জামিনে মুক্ত কার্টুনিস্ট সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তিনি যখন ডিবি পুলিশের রিমান্ডে ছিলেন, সেখানে রিমান্ডের আসামি লেখক মুশতাকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। তখন সম্পূর্ণ উলঙ্গ মুশতাকের সারা শরীর ছিল মলমূত্র মাখানো। সে অবস্থাতেই সুযোগ বুঝে তিনি একফাঁকে কার্টুনিষ্ট কিশোরের কাছে এসে বলেছিলেন, “ভয় পাস ক্যান বেটা? আমরা কী অন্যায় কিছু করেছি?”
No comments:
Post a Comment