Friday, August 13, 2021

'পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ' নিয়ে লিখলেন সাংবাদিক সহকর্মী রাজিব নূর

"আমরা যখন পাহাড়ে বেড়াতে যাই, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই, ওই তিন জেলার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রোসহ অন্য আদিবাসীদের জীবন জানার জন্য উঁকিঝুকি মারি, তখন আমাদেরই বন্ধু বিপ্লব রহমান পৌঁছে গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার হাইড আউটে। আমি এই 'আমাদের' বলতে নিজেকেসহ আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের কথা বলছি, যাঁরা তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পাড়ি দিতে পারিনি। তবে 'টুকটাক' সাংবাদিকতা করি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অস্থিরতা বুঝতে চেষ্টা করছি। সেটা ১৯৯৪ সালের কথা, যখন বিপ্লব গিয়েছিলেন সন্তু লারমার সাক্ষাৎকার নিতে। এর আরও তিন বছর পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা শান্তিচুক্তি বলে পরিচিত।



১৯৯৪ সালের ওই সময়টা কেমন ছিল, যখন বাঙালি বিপ্লব লঙ্ঘিল গিরি- 'পার্বত্য চট্টগ্রাম তখন দারুণ যুদ্ধ-বিক্ষুব্ধ। সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাহাড়ি বিদ্রোহী গ্রুপ শান্তিবাহিনীর রক্তক্ষয়ী লড়াই লেগেই আছে। সেনাবাহিনী তখন অপরেশন চালাচ্ছে দিনের বেলা, আর রাতের বেলা হানা দিচ্ছে গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনী। তাদের যুদ্ধ কৌশল: হিট অ্যান্ড রান!'

বিপ্লব রহমানের 'পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ' গ্রন্থটি নিয়ে একটু আলাপ করতে চাই। আলাপের শুরুতেই সন্তু লারমার ওই সাক্ষাৎকার গ্রহণে বিপ্লবের দুর্গম যাত্রার কথা মনে এল। অবশ্য বইটির প্রথম লেখাও এ নিয়ে, 'গেরিলা নেতা সন্তু লারমার হাইড আউটে'

পড়তে গিয়ে পাঠক মাত্রই রোমাঞ্চিত হবেন, মনে হবে কোনো অ্যাডভেঞ্চারের গল্প পড়ছেন। তবে ওই সময়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও এই রহস্য-রোমাঞ্চসন্ধানী অভিযাত্রীর ছিল না। বিপ্লব গিয়েছিলেন সেই সময় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের 'নাম্বার ওয়ান ওয়ান্টেড পার্সনের' কাছে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি গিয়ে গড়াছড়ির পাহাড়ি গ্রাম প্যারাছাড়ায় আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে 'ক্লিয়ারেন্স' পাওয়ার পর পানছড়ি কলেজের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কয়েকজন কর্মী হাঁটা পথে কিছুদূর এগিয়ে দেওয়ার পর ছাতা বগলে, আধ-ময়লা শার্ট ও লুঙ্গিপরা একজন ত্রিপুরাভাষি যুবক ওঁর গাইড হলেন। তারপর কষ্টকর যাত্রার পুরোটা সময় ছাতা দিয়ে মাথা ঢেকে তাঁকে ক্যামোফ্ল্যাজ করতে হয়; যেন পাহাড়ের ওপর বসানো বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ও সেনাবাহিনীর ওয়াচ টাওয়ার থেকে দূরবিনে কোনো আগন্তুকের অস্তিত্ব ধরা না পড়ে।

এ যাত্রা ছিল আক্ষরিক অর্থেই জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। বিপ্লব ওই 'হাইড আউট' থেকে ফেরার বর্ণনায় লিখছেন, 'দুপুরে ভাত খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবারো পানছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে যাত্রা। সন্তু লারমা কিছুটা পথ এগিয়ে দেন। বিদায় বেলায় বলেন, 'পারলে আমাদের কথা লিখবেন। কেউ আমাদের কথা বলে না!'

বিপ্লবের বর্ণনা থেকে জানতে পাই, 'সে সময় দৈনিক আজকের কাগজে ছবিসহ সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশিত হয়। ভারতীয় ইংরেজি সাপ্তাহিক 'ইন্ডিয়া টুডে'ও সাক্ষাৎকারটি ছবিসহ ফলাও করে প্রকাশ করে। সাপ্তাহিক খবরের কাগজে দুই পর্বে ছাপা হয় গণমাধ্যমে দেওয়া গেরিলা নেতা সন্তু লারমার প্রথম সাক্ষাৎকারটির ইতিবৃত্ত। ফরাসী বার্তা সংস্থা এএফপি'র তৎকালীন বিশেষ সংবাদদাতা নাদিম কাদির সংস্থার পক্ষে সন্তু লারমার দুটি আলোকচিত্র চড়া দামে কিনে নেন।'

এরপর কেটে গেছে, দুই যুগের বেশি। বিপ্লবের কাজ আরও প্রসারিত হয়েছে। পাহাড় থেকে সমতল সর্বত্রই আদিবাসীদের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তবে 'পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ' বইটি সাংবাদিকের জবানবন্দিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অকথিত অধ্যায়। তিনি কখনও তথাকথিত নিরপেক্ষ সাংবাদিক হওয়ার চেষ্টা করেননি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বারবার আমি অনুভব করেছি, পাহাড়ে আসলে রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম সবাই মিলে একটি বাঙালিপক্ষ রয়েছে, যারা পাহাড়িদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। বিপরীতে পাহাড়িদের মধ্যে রয়েছে অনৈক্য।

পাহাড়িদের এই অনৈক্য পীড়িত করে পাহাড়িদের একান্ত আপনজন বিপ্লব রহমানকে। যে মমতা নিয়ে তিনি ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের কথা লিখেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি-মুসলমানের দলে নিজের জন্ম বলে যে অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়েছেন, তা তাঁর লেখাকে নিছক সাংবাদিকতার সীমা ছাড়িয়ে মানবিক দলিলে উত্তীর্ণ করেছে।

'পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ' বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। তখন অবশ্য নাম ছিল 'রিপোর্টারের ডায়রি : পাহাড়ের পথে পথে'। পরে 'পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ' নামে প্রথম সংহতি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। প্রকাশের চার বছর পর নতুন কলেবরে দ্বিতীয় সংস্করণ এসেছে আবার এবছর ২০২১ সালের বইমেলায়। বেশ কিছু টিকা-টিপ্পনী ও তথ্যসূত্রের সংযোজন আরও সমৃদ্ধ করেছে এ সংস্করণটিকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের সর্বজনমান্য এমএন লারমার ঐতিহাসিক চিঠি, জুম্ম জনগোষ্ঠীর বিপন্নতা, লোগাংসহ অনেকগুলো গণহত্যার বিবরণ, ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরে উদ্বাস্তু পাহাড়ি মানুষজনের জীবনচিত্র, কল্পনা চাকমাকে অপহরণ, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর বসতি স্থাপনকারীদের আগ্রাসনসহ পার্বত্য জীবনের অনেকগুলো দিক উঠে এসেছে এই বইয়ে। যা পাঠকেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জীবনের গভীর অন্তর্দহনকে নতুন আলোয় অবলোকন করতে সহায়তা করবে।"

 
https://samakal.com/tp-kaler-kheya/article/2108114540/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8-%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A6%AA%E0%A6%A6-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B2

.

 


 

 

No comments:

Post a Comment