পার্বত্য জেলা রাঙামাটির ঘাগড়ার দেবতাছড়ি গ্রামের কিশোরী সুমি তঞ্চঙ্গ্যা। দরিদ্র জুমচাষি মা-বাবার পঞ্চম সন্তান। অভাবের তাড়নায় অন্য ভাইবোনদের লেখাপড়া হয়নি। কিন্তু ব্যতিক্রম সুমি। লেখাপড়ায় তার প্রবল আগ্রহ। অগত্যা মা-বাবা তাকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন। কোনো রকমে মেয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিটুকু পার করাতে পেরেছেন। কিন্তু এরপর? চটপটে পাহাড়ি মেয়েটি এই লেখককে বলে, ‘আমি ভেবেছিলাম আমার লেখাপড়া এখানেই শেষ। এ সময় আমরা শুনতে পাই ‘মোনঘর শিশু সদন‘র কথা। সেখানে নাকি নামমাত্র বেতনে খুব ভালো লেখাপড়া হয়। এরপর আমি এই আবাসিক স্কুলে এসে ভর্তি হই। মোনঘরের হাত ধরে আমি আরো অনেক দূর এগোতে চাই।‘
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার দুর্গম বাঘাইছড়িমুখ গ্রামের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া কিরণ জ্যোতি চাকমার গল্পটি আবার অন্য রকম। বাবার অকালমৃত্যুতে কিরণের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়। এর মধ্যে ওর মা আবার বিয়ে করেন। ছোট্ট কিরণ এর পরও জুমের ক্ষেতে দিনমজুরি করে চেষ্টা করে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে সে চমকে দেয় গ্রামবাসীকে। সবার আগ্রহে অদম্য মেধাবী কিরণের ঠাঁই হয় রাঙামাটির উপকণ্ঠ রাঙাপানির মোনঘর শিশু সদনে। স্বেচ্ছাশ্রমের ব্যতিক্রমী এই আবাসিক বিদ্যালয়ে কিরণ নতুন করে স্বপ্ন দেখছে জীবন গড়ার।
শুধু দুর্গম গ্রামের গরীব শিশু সুমি তঞ্চঙ্গ্যা বা কিরণ চাকমাই নয়; ওদের মতো ভাগ্যহত হাজারো পাহাড়ি শিশুকে খুঁজে বের করে ‘মোনঘর শিশু সদন‘ করে দিয়েছে আবাসন আর দুবেলা খাবারের পাশাপাশি লেখাপড়ার সুযোগ। স্বেচ্ছাশ্রমের ব্যতিক্রমী এই বিদ্যাপীঠ খুদে শিক্ষার্থীদের ‘মোনঘর‘ নৈতিকতার পাশাপাশি জীবনের পাঠও দিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘মোনঘর‘ নামক চাকমা ভাষার কথাটির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে পাহাড়িদের হাজার বছরের জীবনচিত্র ও সংস্কৃতি। জুম চাষের জমিতে আবাদ পাহারা দেওয়ার জন্য অস্থায়ী যে মাচাং ঘর (বাঁশের কুঁড়েঘর) তৈরি করা হয় তাকেই বলে ‘মোনঘর‘। [দ্র. জুম চাষ : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা]
গত চার দশকে আবাসিক এই বিদ্যালয়টির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে রাঙামাটি ছাড়িয়ে পাহাড়ের বাইরে, এমনকি বিদেশেও। এটিই এখন পাহাড়ের সবচেয়ে বড় আবাসিক বিদ্যালয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ভাষাগত সংখ্যালঘু পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর শিশু শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি যেন নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকেও ধারণ করে বেড়ে উঠতে পারে, সে জন্য এই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সদা তৎপর। খেলাধুলা, হাতের কাজ, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান, বয়ন শিল্প ইত্যাদি প্রশিক্ষণেও পিছিয়ে নেই এই আনন্দ নিকেতন। আবার মোনঘরের’ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরাও ছুটিতে শিক্ষাঙ্গনটিতে ছুটে আসেন প্রাণের টানে। বিনা বেতনে তাঁরা খুদে শিক্ষার্থীদের লেখাপাড়ার পাশাপাশি মমতা আর ভালোবাসায় স্বপ্ন দেখান নতুন আগামীর।
এসব কারণে সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত স্কুলটির ফলাফল অন্যান্য নিয়মিত স্কুলের তুলনায় অনেক ভালো। প্রতি বছর এই প্রতিষ্ঠান থেকে জেএসসি পরীক্ষায় পাস করছে ৯০ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী। আর বরাবরই স্কুলটির মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যা থাকছে প্রায় ৮০ শতাংশ। জিপিএ, জিপিএ ৫ ও গোল্ডেন জিপিএপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়।
মোনঘরের ইতিকথা
মোনঘর নিয়ে বিস্তারিত আলাপচারিতা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ঝিমিত ঝিমিত চাকমার সঙ্গে। আড়াই দশক ধরে তিনি এই শিক্ষাঙ্গনকে আগলে রেখেছেন। চার বছর ধরে পালন করছেন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। তাঁর কাছ থেকে জানা গেছে, রাঙামাটি শহরের উপকণ্ঠে ভেদভেদী ও রাঙাপানি নামে দুটি গ্রামের মাঝখানে ১৭ একর জমিতে মোনঘরের’ আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ১৯৭৪ সালে। এর আগে ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে প্রায় ৫৪ হাজার একর চাষের জমি কর্ণফুলী নদীর পানিতে তলিয়ে গেলে ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয় প্রায় এক লাখ পাহাড়ি। ১৯৬৩ সালে বৌদ্ধ পুরোহিত জ্ঞানশ্রী মহাথের খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় কিছু বিপন্ন শিক্ষার্থীকে পাঠদানের দায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে অসংখ্য পাহাড়ি শিশু অনাথ, অসহায় ও ছিন্নমূল হয়ে পড়ে।
জ্ঞানশ্রী মহাথেরের প্রেরণায় তাঁরই অনুসারী তিনজন ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাথের, ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথের ও ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথের এসব শিশুর শিক্ষার ভার গ্রহণ করেন। তিনি রাঙাপানির মিলন বৌদ্ধ বিহারে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মোনঘর‘। দুবেলা খাবার ও আবাসনের ব্যবস্থায় মাত্র ৩০ জন শিশু নিয়ে তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মের জ্ঞানদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দান করেন সাধারণ শিক্ষার পাঠও। তবে তখনো এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিল না। ১৯৮০ সালে শুভানুধ্যায়ীদের অনুদানে প্রতিষ্ঠা হয় স্কুল ভবন। সেই থেকে ‘মোনঘর শিশু সদন‘ যাত্রা শুরু করে আনুষ্ঠানিকভাবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে এটি উন্নীত হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগে পাহাড়ে অশান্ত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ভারতের ত্রিপুরায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় প্রায় ৭০ হাজার পাহাড়ি। সে সময় অনেক শিশু-কিশোর হয়ে পড়ে আশ্রয়হীন। এ সময় আবাসিক এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তখন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আবাসন ও পড়াশোনার জন্য ফি নেওয়া হতো না। ফরাসি ‘পারটেজ‘ নামে একটি উন্নয়ন সংস্থা এর একটি বড় অংশের ব্যয় বহন করতো। শান্তিচুক্তির পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের সময় পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড টানা সাত বছর বিদ্যালয়টির জন্য বছরে দুই কোটি টাকা করে ব্যয় করেছে।
এরপর স্কুল কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, বিদ্যালয়টিকে আর অনুদাননির্ভর রাখা যাবে না। একে নিজস্ব শক্তিতে দাঁড়াতে হবে। তখন থেকেই স্কুলে চালু হয় শিক্ষার্থীদের আবাসন ও লেখাপড়া বাবদ নামমাত্র বার্ষিক ফি প্রদান রীতি। প্রাথমিক শ্রেণির জন্য জনপ্রতি ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার ১০০ টাকা, আর মাধ্যমিকে দুই হাজার ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা করে এখন ফি নেওয়া হচ্ছে। হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেওয়া হয় না।
বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ২৫টি উপজেলার ২৪টি থেকেই নানা ভাষাভাষী পাহাড়ি শিশুরা এসে ভর্তি হচ্ছে স্কুলটিতে। অজ্ঞাত কারণে শুধু খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা থেকে শিক্ষার্থীরা তেমনভাবে স্কুলে আসছে না। এখন সেখানে ৭৫০ জন আবাসিক শিক্ষার্থীসহ ছাত্রছাত্রীর মোট সংখ্যা প্রায় এক হাজার ১০০ জন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই আবার কন্যাশিশু। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী সাফল্যের সঙ্গে পাস করেছে মোনঘর থেকে। আর এর আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ২৮ জন। এর মধ্যে ১৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা সরকারি এমপিওভুক্ত। প্রতিষ্ঠানের অধীনে এখন একটি দোতলা আবাসিক বিদ্যালয় এবং ১২টি আবাসিক ছাত্রাবাস রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৪৮ জন। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরিচর্যায় এখানে রয়েছে স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
মোনঘরের প্রাণ
মোনঘরের উদ্দেশ্য কী? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান শিক্ষক ঝিমিত ঝিমিত চাকমা হেসে বলেন, “দেশ গড়ার কারিগর তৈরি করাই আমাদের উদ্দেশ্য। দুস্থ শিশুদের শুধু শিক্ষিত করা নয়, তারা যেন পাহাড়, প্রকৃতি, নিজস্ব মাতৃভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসে, তারা যেন দেশপ্রেমিক সুনাগরিক হয়, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।“
কিভাবে যুক্ত হলেন এই স্বেচ্ছাশ্রমের মহান ব্রতে? জানতে চাইলে ঝিমিত ঝিমিত চাকমা বলেন, “আধুনিক সংস্কৃতির চোরা স্রোতে হারাতে বসা পাহাড়িদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আশির দশকে আমরা ছাত্রাবস্থায় প্রতিষ্ঠা করি জুম এস্থেটিক কাউন্সিল (জাক) নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। মঙ্গল কুমার চাকমা, পবিত্র চাকমা, মৃত্তিকা চাকমা, শিশির চাকমা, শান্তি চাকমা, প্রয়াত সুহৃদ চাকমা ছিলেন এর প্রধান উদ্যোক্তা। জাকের প্রেরণাতেই লেখাপড়া শেষে ১৯৮৫ সালে যুক্ত হই ‘মোনঘরের‘ কাজে। সব সময়ই তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম, তথা দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। তাই নামমাত্র সম্মানী আমাদের শিক্ষকতার কাজে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আজ দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে মোনঘরের কৃতী শিক্ষার্থীরা। এখন স্বপ্ন দেখি ‘মোনঘর‘ একদিন আবাসিক মহাবিদ্যালয় হবে। পরে হয়ে উঠবে এক অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়।“
—
ছবি : মোনঘর শিশু সদন, রাঙাপানি, রাঙামাটি, সত্রং চাকমা।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার দুর্গম বাঘাইছড়িমুখ গ্রামের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া কিরণ জ্যোতি চাকমার গল্পটি আবার অন্য রকম। বাবার অকালমৃত্যুতে কিরণের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়। এর মধ্যে ওর মা আবার বিয়ে করেন। ছোট্ট কিরণ এর পরও জুমের ক্ষেতে দিনমজুরি করে চেষ্টা করে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে সে চমকে দেয় গ্রামবাসীকে। সবার আগ্রহে অদম্য মেধাবী কিরণের ঠাঁই হয় রাঙামাটির উপকণ্ঠ রাঙাপানির মোনঘর শিশু সদনে। স্বেচ্ছাশ্রমের ব্যতিক্রমী এই আবাসিক বিদ্যালয়ে কিরণ নতুন করে স্বপ্ন দেখছে জীবন গড়ার।
শুধু দুর্গম গ্রামের গরীব শিশু সুমি তঞ্চঙ্গ্যা বা কিরণ চাকমাই নয়; ওদের মতো ভাগ্যহত হাজারো পাহাড়ি শিশুকে খুঁজে বের করে ‘মোনঘর শিশু সদন‘ করে দিয়েছে আবাসন আর দুবেলা খাবারের পাশাপাশি লেখাপড়ার সুযোগ। স্বেচ্ছাশ্রমের ব্যতিক্রমী এই বিদ্যাপীঠ খুদে শিক্ষার্থীদের ‘মোনঘর‘ নৈতিকতার পাশাপাশি জীবনের পাঠও দিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘মোনঘর‘ নামক চাকমা ভাষার কথাটির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে পাহাড়িদের হাজার বছরের জীবনচিত্র ও সংস্কৃতি। জুম চাষের জমিতে আবাদ পাহারা দেওয়ার জন্য অস্থায়ী যে মাচাং ঘর (বাঁশের কুঁড়েঘর) তৈরি করা হয় তাকেই বলে ‘মোনঘর‘। [দ্র. জুম চাষ : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা]
গত চার দশকে আবাসিক এই বিদ্যালয়টির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে রাঙামাটি ছাড়িয়ে পাহাড়ের বাইরে, এমনকি বিদেশেও। এটিই এখন পাহাড়ের সবচেয়ে বড় আবাসিক বিদ্যালয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ভাষাগত সংখ্যালঘু পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর শিশু শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি যেন নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকেও ধারণ করে বেড়ে উঠতে পারে, সে জন্য এই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সদা তৎপর। খেলাধুলা, হাতের কাজ, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান, বয়ন শিল্প ইত্যাদি প্রশিক্ষণেও পিছিয়ে নেই এই আনন্দ নিকেতন। আবার মোনঘরের’ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরাও ছুটিতে শিক্ষাঙ্গনটিতে ছুটে আসেন প্রাণের টানে। বিনা বেতনে তাঁরা খুদে শিক্ষার্থীদের লেখাপাড়ার পাশাপাশি মমতা আর ভালোবাসায় স্বপ্ন দেখান নতুন আগামীর।
এসব কারণে সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত স্কুলটির ফলাফল অন্যান্য নিয়মিত স্কুলের তুলনায় অনেক ভালো। প্রতি বছর এই প্রতিষ্ঠান থেকে জেএসসি পরীক্ষায় পাস করছে ৯০ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী। আর বরাবরই স্কুলটির মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যা থাকছে প্রায় ৮০ শতাংশ। জিপিএ, জিপিএ ৫ ও গোল্ডেন জিপিএপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়।
মোনঘরের ইতিকথা
মোনঘর নিয়ে বিস্তারিত আলাপচারিতা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ঝিমিত ঝিমিত চাকমার সঙ্গে। আড়াই দশক ধরে তিনি এই শিক্ষাঙ্গনকে আগলে রেখেছেন। চার বছর ধরে পালন করছেন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব। তাঁর কাছ থেকে জানা গেছে, রাঙামাটি শহরের উপকণ্ঠে ভেদভেদী ও রাঙাপানি নামে দুটি গ্রামের মাঝখানে ১৭ একর জমিতে মোনঘরের’ আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ১৯৭৪ সালে। এর আগে ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে প্রায় ৫৪ হাজার একর চাষের জমি কর্ণফুলী নদীর পানিতে তলিয়ে গেলে ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয় প্রায় এক লাখ পাহাড়ি। ১৯৬৩ সালে বৌদ্ধ পুরোহিত জ্ঞানশ্রী মহাথের খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় কিছু বিপন্ন শিক্ষার্থীকে পাঠদানের দায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে অসংখ্য পাহাড়ি শিশু অনাথ, অসহায় ও ছিন্নমূল হয়ে পড়ে।
জ্ঞানশ্রী মহাথেরের প্রেরণায় তাঁরই অনুসারী তিনজন ভদন্ত বিমল তিষ্য মহাথের, ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথের ও ভদন্ত শ্রদ্ধালংকার মহাথের এসব শিশুর শিক্ষার ভার গ্রহণ করেন। তিনি রাঙাপানির মিলন বৌদ্ধ বিহারে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মোনঘর‘। দুবেলা খাবার ও আবাসনের ব্যবস্থায় মাত্র ৩০ জন শিশু নিয়ে তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মের জ্ঞানদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দান করেন সাধারণ শিক্ষার পাঠও। তবে তখনো এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিল না। ১৯৮০ সালে শুভানুধ্যায়ীদের অনুদানে প্রতিষ্ঠা হয় স্কুল ভবন। সেই থেকে ‘মোনঘর শিশু সদন‘ যাত্রা শুরু করে আনুষ্ঠানিকভাবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে এটি উন্নীত হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগে পাহাড়ে অশান্ত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ভারতের ত্রিপুরায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় প্রায় ৭০ হাজার পাহাড়ি। সে সময় অনেক শিশু-কিশোর হয়ে পড়ে আশ্রয়হীন। এ সময় আবাসিক এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তখন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আবাসন ও পড়াশোনার জন্য ফি নেওয়া হতো না। ফরাসি ‘পারটেজ‘ নামে একটি উন্নয়ন সংস্থা এর একটি বড় অংশের ব্যয় বহন করতো। শান্তিচুক্তির পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের সময় পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড টানা সাত বছর বিদ্যালয়টির জন্য বছরে দুই কোটি টাকা করে ব্যয় করেছে।
এরপর স্কুল কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, বিদ্যালয়টিকে আর অনুদাননির্ভর রাখা যাবে না। একে নিজস্ব শক্তিতে দাঁড়াতে হবে। তখন থেকেই স্কুলে চালু হয় শিক্ষার্থীদের আবাসন ও লেখাপড়া বাবদ নামমাত্র বার্ষিক ফি প্রদান রীতি। প্রাথমিক শ্রেণির জন্য জনপ্রতি ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার ১০০ টাকা, আর মাধ্যমিকে দুই হাজার ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা করে এখন ফি নেওয়া হচ্ছে। হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেওয়া হয় না।
বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ২৫টি উপজেলার ২৪টি থেকেই নানা ভাষাভাষী পাহাড়ি শিশুরা এসে ভর্তি হচ্ছে স্কুলটিতে। অজ্ঞাত কারণে শুধু খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা থেকে শিক্ষার্থীরা তেমনভাবে স্কুলে আসছে না। এখন সেখানে ৭৫০ জন আবাসিক শিক্ষার্থীসহ ছাত্রছাত্রীর মোট সংখ্যা প্রায় এক হাজার ১০০ জন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই আবার কন্যাশিশু। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী সাফল্যের সঙ্গে পাস করেছে মোনঘর থেকে। আর এর আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ২৮ জন। এর মধ্যে ১৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা সরকারি এমপিওভুক্ত। প্রতিষ্ঠানের অধীনে এখন একটি দোতলা আবাসিক বিদ্যালয় এবং ১২টি আবাসিক ছাত্রাবাস রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৪৮ জন। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরিচর্যায় এখানে রয়েছে স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
মোনঘরের প্রাণ
মোনঘরের উদ্দেশ্য কী? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান শিক্ষক ঝিমিত ঝিমিত চাকমা হেসে বলেন, “দেশ গড়ার কারিগর তৈরি করাই আমাদের উদ্দেশ্য। দুস্থ শিশুদের শুধু শিক্ষিত করা নয়, তারা যেন পাহাড়, প্রকৃতি, নিজস্ব মাতৃভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসে, তারা যেন দেশপ্রেমিক সুনাগরিক হয়, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।“
কিভাবে যুক্ত হলেন এই স্বেচ্ছাশ্রমের মহান ব্রতে? জানতে চাইলে ঝিমিত ঝিমিত চাকমা বলেন, “আধুনিক সংস্কৃতির চোরা স্রোতে হারাতে বসা পাহাড়িদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আশির দশকে আমরা ছাত্রাবস্থায় প্রতিষ্ঠা করি জুম এস্থেটিক কাউন্সিল (জাক) নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। মঙ্গল কুমার চাকমা, পবিত্র চাকমা, মৃত্তিকা চাকমা, শিশির চাকমা, শান্তি চাকমা, প্রয়াত সুহৃদ চাকমা ছিলেন এর প্রধান উদ্যোক্তা। জাকের প্রেরণাতেই লেখাপড়া শেষে ১৯৮৫ সালে যুক্ত হই ‘মোনঘরের‘ কাজে। সব সময়ই তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম, তথা দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। তাই নামমাত্র সম্মানী আমাদের শিক্ষকতার কাজে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আজ দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে মোনঘরের কৃতী শিক্ষার্থীরা। এখন স্বপ্ন দেখি ‘মোনঘর‘ একদিন আবাসিক মহাবিদ্যালয় হবে। পরে হয়ে উঠবে এক অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়।“
—
ছবি : মোনঘর শিশু সদন, রাঙাপানি, রাঙামাটি, সত্রং চাকমা।
No comments:
Post a Comment