তনু হত্যার বিচারের দাবিতে ঢাকা-কুমিল্লা ছাড়াও দেশজুড়ে হচ্ছে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানববন্ধন।
তনুর জন্য তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিক্টোরিয়া কলেজ তো বটেই, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ জেলা সদরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছেন, সাধারণ মানুষ যোগ দিচ্ছেন তাদের প্রতিবাদে, শিক্ষক-অভিভাবকরাও সমর্থন জানাচ্ছেন তাদের বিক্ষোভে। হয়েছে ঢাকা-কুমিল্লা সড়ক অবরোধ; কান্দিরপাড়ের সমাবেশের ছাত্র-জনতা জানিয়ে দিয়েছেন, তনু ধর্ষণ ও হত্যার বিচার না হলে তারা ঘরে ফিরবেন না।
অন্যদিকে, তনুর জন্য গণজাগরণ মঞ্চ ঢাকা-কুমিল্লা রোডমার্চ করেছে, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক ঘন্টা ক্লাস বর্জন করে যুক্ত হয়েছে মানববন্ধনে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একযোগে হয়েছে শিক্ষা ধর্মঘট, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক গড়ে তুলেছেন রাজপথের আন্দোলন।
০২. এছাড়া অনেকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তো বটেই, মূল ধারার মিডিয়ায় এখন অনেকটা কাভারেজ তনু হত্যা। তাকে নিয়ে লেখাজোকা-টক শো-আলোচনাও হচ্ছে বিস্তর।
বলা ভালো, মিডিয়ায় তনু হত্যার বিষয়টি ফলাও করে প্রকাশ হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে কুমিল্লাবাসী। তনুর সহপাঠী, তার নাট্যসহকর্মীরা, তার সতীর্থরা রাজপথের আন্দোলন গড়ে তুলে প্রথম বিষয়টি মিডিয়ার নজরে আনে। তারপর এটি দেশজুড়ে তো বটেই, এথন আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও নিয়মিত খবর।
সবশেষ ‘জস্টিস ফর তনু’ হ্যাশট্যাগের পর সোশ্যাল মিডিয়া এখন ছেয়ে গেছে ‘নো ওয়ান কিলড তনু’ হ্যাশট্যাগে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তনুর হিজাবে ঢাকা কচি মুখায়বসহ বেদনাবিধুর ছোট ছোট স্টিকার।
এর কারণ আর কিছুই নয়, তনুর জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা (এসবি), গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআিই) ও র্যা ব যেসব ছায়া তদন্ত করেছে, তদন্ত প্রক্রিয়ার প্রথম ময়নাতদন্ত রিপোর্টে তনুকে ধর্ষণের আলমত পাওয়া যায়নি। এতেই নতুন করে ঘি ঢালা হয়েছে চলমান ক্ষোভে।
০৩. লক্ষ্যণীয়, খবরে প্রকাশ, কুমিল্লা ময়নমতি সেনা নিবাসের ভেতর ২০ মার্চ রাতে একটি ঝোপের ভেতর তনুর অর্ধ নগ্ন মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তার মাথা ছিল থেতলানো। তনুদের আবাস সেনানিবাসের ভেতর। তাকে উতক্তকারী হিসেবে সেনা বাহিনীর একজন নিম্নপদের কর্মকর্তার ছেলের নামও গণমাধ্যমে এসেছে। ছেলেটি ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। অবশ্য তার মানে আবার এই নয় যে, এই ছেলেটিই তনুর ধর্ষক ও খুনি।
বরং তনু ইস্যুতে জনমনে ক্ষোভের কারণ এই যে, সেনা নিবাসের ভেতর একটি সংরক্ষিত অঞ্চলে অমন বিভৎস্য খুন হয় কী করে? সেখানে রয়েছে বিস্তর মিলিটিরি পুলিশের (এমপি) সার্বক্ষণিক প্রহরা, অসংখ্য সিসি ক্যামেরা, চেকপোস্ট ইত্যাদি। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে হত্যা-ধর্ষনের আলামত নষ্ট করার খবরও প্রকাশিত হয়েছে।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান তো ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আগেই আগাম আশঙ্কা করেছিলেন, এ হত্যার আলামত নষ্ট করা হতে পারে। এটিও নতুন করে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে সাধারণের মনে।
০৪. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, আইজিপিসহ উদ্ধর্তন পুলিশ কর্মকর্তার পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ পরিদপ্তরও (আইএসপিআর) শেষমেষ মুখ খুলেছে, তারা বিবৃতিতে বলেছেন, সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে তনু হত্যার বিষয়ে পুলিশি তদন্তে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
অথচ আইএসপিআর’এর বিবৃতিতে তো সেনা নিবাসের নিরাপত্তার দায়িত্বে অবহেলার জন্য নিরাপত্তা রক্ষীদের চাকরিচ্যুত বা জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা নেই। তাদের বিচারের মুখোমুখি বা বন্দি করা তো দূরের কথা! বিবৃতিতে নেই সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত পরিচালনা করার কথা! সেনা নিবাসের সিসি ক্যামেরার ফুটেজেরও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিও তো তদন্তকারী পুলিশবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার কথা নেই।
পাশাপাশি পুলিশি তদন্তে নিরাপত্তা রক্ষী মিলিটারি পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তাদের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ (অক্ষুন্ন আছে তো?) জব্দ করার কথাও জানা যায়নি।
সেনা নিবাসের ভেতর ছাত্রী হত্যা ও ধর্ষণের বিষয়ে আইএসপিআর যখন ‘তদন্তে সহযোগিতা’র কথা বলে দায় সারে, তথন ধরেই নিতে হবে এই তনুর জন্য দেশে-বিদেশে যতো আন্দোলন-বিক্ষোভই হোক না কেনো, যতোই তদন্ত কীর্তি ইত্যাদি হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সবই হবে নিস্ফল, কালক্ষেপন মাত্র।
অর্থাৎ, শেষ বিচারে এ হত্যার বিচার আরো কোনোদিনই হবে না, এ ধর্ষন ও হত্যা রহস্যের উন্মোচনও হবে না। কারণ সেনা বাহিনী স্পষ্টতই নিজের দায় এড়িয়ে সব দায় পুলিশি তদন্তের ওপর চাপাতে চাইছে। আর কে না জানে, সেনা বাহিনী হচ্ছে রাষ্ট্রের সেই হোলি কাউ, যাদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার কোনো প্রক্রিয়া সাধারণ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নেই।
০৫. ঠিক একই কারণে ২০ বছর আগে (১২ জুন, ১৯৯৬ সাল) সেনা বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে পাহাড়ে অপহৃত হিল ইউমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের সুবিচার আজো হয়নি। তিনি রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ির বাঘাইহাটের নিউ লাইল্যাঘোনা গ্রামে নিজ বাসা থেকে অপহৃত হয়েছিলেন।
আর গত ২০ বছরে এ অপহরণের রহস্য উন্মোচন তো দূরের কথা, অপহরণের জন্য অভিযুক্ত বাঘাইহাট সেনা নিবাসের লেফটেনেন্ট ফেরদৌস ও তার সহযোগি ভিডিপি সদস্যদের কোনো পুলিশি তদন্তেই জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হয়নি। বরং এ মামলাটির তদন্ত পুলিশ কর্মকর্তা বছর বছর পাল্টেছে, কল্পনা চাকমার গ্রামের নদী কাচালং-এ গড়িয়েছে অনেক জল।
ওই অপহরণের তথ্য-সংবাদ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সে সময়ও আইএসপিআর’র বদলে দৃশ্যমান হয়েছে সেনা বাহিনীর ২৪ ডিভিশন, পদাতিক। পাহাড় ও সমতলে পাহাড়ি-বাঙালিদের অব্যহত আন্দোলনের মুখে তারা হেলিকপ্টার থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে লিফলেট বিলি করে কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, যদিও অপহরণের এসব ফৌজদারী ঘটনায় পুরস্কার দেয়া সেনা বাহিনীর এখতিয়ারভূক্ত নয়।
আর ওই অপহরণের সময় সে সময় তাদের বিবৃতিতে উল্টো সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনী সদস্যদের ওপর প্রচ্ছন্ন দায় চাপানোর চেষ্টা চলেছিল। অন্যদিকে, কল্পনা চাকমা, তথা আদিবাসী ইস্যুতে কর্মরত কয়েক ডজন মানবাধিকার সংস্থার কেউই স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে, আলোচিত এই অপহরণের মামলাটিকে রাঙামাটি জেলা আদালত থেকে ঢাকার হাইকোর্টে স্থানান্তর পর্যন্ত করেনি। কল্পনার জুম চাষী (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ চাষাবাদ) হত-দরিদ্র পরিবারকে সাহায্য-সহযোগিতা তো দূরের কথা।
তারা দায় সেরেছে, শুধুমাত্র মামলার শুনানীর দিনে ঢাকা থেকে উড়ে গিয়ে মিডিয়ার মুখোমুখি ফটো-সেশন করে বা দু-একটি বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে।
অর্থাৎ অনেক বছর ধরেই দাতাগোষ্ঠির সুবাদে আদিবাসী/মানবাধিকার/নারী অধিকার ইত্যাদিও বেশ ভাল একটি ব্যবসায়িক উপকরণ, সেখানে আত্মোন্নয়ন যথেচ্ছ হলেও মানবাধিকারের উন্নয়নের ধারা চুঁইয়ে নীচের দিকে গড়িয়েছে সামান্যই।
০৬. বটম লাইনে: সেনা নিবাস বা হিজাব— নিরাপত্তার কথিত এই দুই প্রতীক আসলে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্খ, এটি তনু ইস্যুতে দিন দিন মূর্ত হচ্ছে। কল্পনা বা তনুর সুবিচারও রাষ্ট্র দিতে ব্যর্থ, কারণ এর নেপধ্য শক্তি সামরিক জান্তার কেশাগ্র স্পর্শের সাহসও কারো নেই; আসলে তারাই আরেকটি রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের নেপথ্য রাষ্ট্র, বলা ভাল— দৃশ্যমান রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতা ও দেশের তারাই অদৃশ্যমান ভাগ্য বিধাতা এবং নিয়ন্ত্রক।
__
লেখক: সাংবাদিক ও ব্লগার
- See more at: http://bangla.newsnextbd.com/article228852.nnbd/#sthash.Qgns2PK1.dpuf
No comments:
Post a Comment