বিপ্লব রহমান, ঢাকা: জিহাদী মিশনে জঙ্গিরা মুক্তমনা লেখক, ব্লগার ও সংগঠক হত্যায় ক্রমেই হয়ে উঠছে বেপরোয়া।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকার জঙ্গিদের শক্তিমত্তাকে খাটো করে দেখছে; আর এই সুযোগে তারা অস্ত্র-শস্ত্রসহ হত্যা অভিযানে বলবান হয়ে চলেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিও জঙ্গিদের উৎসাহিত করছে।
অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে চাপাতির কোপে খুন (২৩ এপ্রিল, শনিবার) করার দুদিনের মাথায় সোমবারই সন্ধ্যায় জঙ্গিরা ঢাকার কলাবাগানের বাসায় ঢুকে কুপিয়ে খুন করে জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু তনয়কে। জুলহাজ সমকামী ও হিজড়াদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, পাশাপাশি সম্পাদনা করতেন ‘রূপবান’ নামক সমকামীদের একটি পত্রিকা। এছাড়া তিনি ছিলেন মার্কিন দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা।
পর্যবেক্ষণ বলছে, গত দেড় বছরে জঙ্গিরা রাজপথে মুক্তমনাদের চাপাতির কোপে খুন করার ধারাবাহিকতায় ক্রমেই ধীরে ধীরে আরো সাহস ও কৌশল অর্জন করে চলেছেন। চাপাতির পাশাপাশি এখন তারা আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করছেন। রাজপথে ওত পেতে খুন করার পাশাপাশি ঘরে ঢুকে হত্যার মতো সাহসও দেখাচ্ছেন।
এছাড়া জিহাদী হত্যায় অংশ নেয়া জঙ্গিরা এখন দাড়ি-টুপি-পাঞ্জাবি লেবাস বদলে পোষাক-আশাকে হয়ে উঠছেন স্মার্ট। এমনকি হত্যার পর তারা প্রকাশ্যেই ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনী দিয়ে অনেকটা নির্ভয়েই যেন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছেন।
২০১৫ সালের শুরুতেই ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে বিজ্ঞানলেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায়কে। একইসঙ্গে গুরুতর জখম হন অভিজিতের স্ত্রী, মুক্তমনা ব্লগার বন্যা আহমেদ। পরদিনই এর দায় স্বীকার করে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’।
৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পালানোর সময় কয়েকজন শিখণ্ডি (হিজড়া) হাতেনাতে দুই হত্যাকারীকে আটক করে পুলিশে দেয়।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’।
১২ মে সিলেটে খুন হন মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস। পুলিশ জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ড আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলের কাজ।
লক্ষ্যনীয়, এই তিনটি হত্যাকাণ্ডেই অংশ নেয়া জঙ্গিরা খুনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে চাপাতি। প্রতিটি খুনই সংগঠিত হয়েছে রাজপথে অতর্কিত হামলায়। ওয়াশিকুর হত্যায় হাতেনাতে গ্রেফতারকৃত দাড়িওয়ালা দুই যুবকের পরনে ছিল পাঞ্জাবি-পায়জামা। তারা পুলিশকে জানিয়েছে, চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলাম পরিচালিত মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন তারা।
অভিজিৎ ও অনন্ত বিজয়কে যারা খুন করেছে, তারাও দাড়িওয়ালা বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
কিন্তু এরপরেই বদলে যায় হত্যার ধরণ। চাপাতির সঙ্গে যোগ হয় পিস্তল-রিভালবারের মতো সহজে বহনযোগ্য আগ্নেয়াস্ত্র। বাসায়-অফিস কক্ষে ঢুকে সশস্ত্র হামলা চালাতে থাকে জিহাদীরা।
৭ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণ গোড়ানে বাসায় ঢুকে সন্ত্রাসীরা চাপাতির কোপে খুন করে আরেক মুক্তমনা ব্লগার নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়কে (২৭)। এবার জঙ্গিরা পিস্তলের মুখে জিম্মী করে রেখেছিল নীলাদ্রীর স্ত্রী আশামনিকে।
৩১ অক্টোবর বিকেলে ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের কার্যালয়ে ঢুকে ‘জাগৃতি’ প্রকাশনার স্বত্ত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
একই দিন সকালে সন্ত্রাসীরা লালমাটিয়ার কার্যালয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে ‘শুদ্ধস্বর’ এর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার রণদীপম বসু ও ব্লগার তারেক রহিমকে। এই ‘জিহাদী মিশন’ শেষে চলে যাওয়ার আগে জঙ্গিগোষ্ঠী পিস্তল থেকে পর পর দুটি গুলি করে তারেককে। সৌভাগ্যক্রমে চিকিৎসায় তারা তিনজনই প্রাণে বেঁচে যান।
এ বছর ৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে। হত্যাযজ্ঞে চাপাতি ব্যবহার করার পাশাপাশি খুনি নাজিমের মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এক রাউন্ড গুলি করে বলে নিহতের সঙ্গী ও প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশকে জানিয়েছে।
ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় জিহাদীরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনী দিয়েছিল।
আর সবশেষে সোমবার (২৫ এপ্রিল) আবারো বাসায় ঢুকে ‘রূপবান’ এর সম্পাদক জুলহাজ ও তার বন্ধু তনয়কে কুপিয়ে খুন করে জঙ্গিগোষ্ঠি।
প্রত্যক্ষদর্শিরা জানিয়েছেন, পাঁচ-সাতজন যুবকের পরনে এবার ছিল জিন্সের প্যান্ট-টি শর্ট ও কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ। আর তাদের কারো কারো হাতে ছিল পিস্তলও।
এবারও ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনী দেয় তারা।
এদিকে সোমবারই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছাদুজ্জামান খাঁন কামাল জাতীয় সংসদে বলেন, ‘দেশে কোনো আইএসের অস্তিত্ব নেই যা আছে দেশের মধ্যে গড়ে উঠা জঙ্গিগোষ্ঠী। দেশীয় জঙ্গিরা মাঝে মাঝে এ ঘটনা ঘটাচ্ছে—আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে জঙ্গিদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।’
অন্যদিকে, একের পর এক হত্যাকাণ্ডে মুক্তমনা লেখক ও ব্লগাররা ফেসবুকে জানিয়েছেন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।
জঙ্গি হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া প্রকাশক-লেখক আহমেদুর রশীদ টুটুল ফেবুতে লেখেন, ‘আবার!!!!!!!!! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি দায়িত্ব নিতে পারবেন না বলার পর আজ (সোমবার) রূপবান গোষ্ঠীর তনয় ও জুলহাজকে হত্যা করা হলো। ইচ্ছে করে না আর আপনাকে সম্বোধন করে কিছু বলি। কিন্তু দেশতো আমাদেরও। তাই বাধ্য হয়েই বলতে হয়। আপনার কাছে বিচার চাই না। আপনি শুধু রাষ্ট্রের অধিকর্তা হিসাবে সব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। এটা করতে আপনি সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন লেখেন, ‘আমরা আমাদের চোখ আপাতত রাষ্ট্রের কাছে জমা দিয়েছি। আমরা কোনো খুনখারাবি দেখব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাষ্ট্র যা দেখাবে দেখব। রাষ্ট্রের তরফে মিডিয়া যা শোনাবে শুনব।’
চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ফেবুতে বলেন, ‘তবে অন্ধ হওয়াই শ্রেয়। প্রলয় থামানো তো আর আমাদের হাতে নাই।(এই হলো গত কিছুদিনে আমার উপলব্ধির সারাংশ)’
লেখক ও গবেষক কল্লোল মুস্তফা বলেন, ‘চাপাতির কোপের আওতা বাড়ছেই। ভিক্টিমের ‘অপরাধ’ খোঁজা বাদ দিয়ে, অপরাধীকে খুঁজুন, বিচারের আওতায় আনুন। দেশটা যে এভাবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে সেটা কি কেউ বুঝতে পারছেন না!’
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/বিআর/এফআর
মূল লেখাটি এখানে: http://bangla.newsnextbd.com/article233522.nnbd/
No comments:
Post a Comment