বিপ্লব রহমান ও আরিফুজ্জামান তুহিনঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার প্রাণ নেই। স্বাধীনতার পর গত চার দশকে বুড়িগঙ্গা তিলে তিলে দখল ও দূষণের কবলে পড়ে একটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। এ নদীর জায়গা দখল করে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গড়ে উঠছে স্থাপনা। কমছে নদীর প্রশস্ততা, কমছে প্রাণপ্রবাহ। প্রতি মুহূর্তে নদীর ভেতর ফেলা হচ্ছে পানিদূষণকারী ভয়ংকর সব বর্জ্য। বুড়িগঙ্গার বড় অংশেই নেই জলজ প্রাণী বা মাছ। এ নদীর পানি বহু আগেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়েছে। এমনকি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে শ্বাস নেওয়া যায় না। পানির দুর্গন্ধে আশপাশে টেকাই দায়।
পরিবেশবাদী সংগঠন ও নাগরিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, সরকার যদি বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয় তাহলে নদীটি আবার প্রাণ ফিরে পাবে। তেমনি ঢাকা ও কেরানীগঞ্জের ভেতর যোগাযোগ বাড়বে। একাধিক সেতু ও বুড়িগঙ্গার উভয় পাশে বড় রাস্তা হলে রাজধানীর ওপর যেমন চাপ কমবে তেমনি কেরানীগঞ্জে বেড়ে উঠবে আধুনিক ঢাকা। এসব পরিকল্পনা করা গেলে পৃথিবীর নিকৃষ্ট নগর হিসেবে ঢাকার দুর্নাম ঘুচবে বলেও তাঁরা মনে করছেন।
দখলে কমছে বুড়িগঙ্গা : সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে বুড়িগঙ্গা দখলের নানা চিত্র। নদীর দক্ষিণ পারের আটি, খোলামোড়া থেকে শুরু করে জিনজিরা, কালীগঞ্জ হয়ে পারগেণ্ডারিয়া, হাসনাবাদ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার বুড়িগঙ্গা দখল করে ৫০০-এর ওপর পাকা স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এভাবে দখলের পাশাপাশি আগানগর থেকে শুরু করে হাসনাবাদ পর্যন্ত একাধিক বালুমহাল দেখা গেছে। নদীর তীরে বালুমহাল হওয়ায় বাল্কহেড (বালুবাহী জাহাজ) থেকে বালু খালাস করার সময় নদী ভরাট হচ্ছে। এসব ভরাট জায়গায় পরে গড়ে উঠছে দোকানপাট, মার্কেট। সদরঘাটের উল্টো দিকে চৌধুরীনগরে রিফাত টাওয়ার, রফিক টাওয়ার, আহসানউল্লাহ মার্কেট ও আগানগরের আলম মার্কেটের ভেঙে ফেলা অংশ এভাবে আবার নির্মাণ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে আরো দেখা গেছে, কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা ফেরিঘাটসংলগ্ন বটতলা এলাকায় বেশ কিছু টংঘর নির্মাণের কাজ চলছে। বাবুবাজার ব্রিজের নিচের অংশের পুরোটাই দখলদারের কবলে চলে গেছে। তেলঘাট এলাকায় ওহাব নামের এক ব্যক্তি নদী দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। খেজুরবাগে বুড়িগঙ্গার দুই পাশের খাল দখল করে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। শ্যামপুরের পোস্তগোলা ব্রিজের নিচে ইটের খোলা ও বালুর গদি করে অবাধে ব্যবসা করছেন ওয়াহিদ মেম্বার।
পানি, না বিষ! : বুড়িগঙ্গার নদীর পানির দূষণ সম্পর্কে বুঝতে হলে এ নদীর একজন মাঝির বক্তব্য বাস্তবের অনেক চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। কেরানীগঞ্জের থানাঘাটের খেয়ামাঝি সরদার মো. বদরুদ্দীন (৫৫) বলেন, 'বুড়িগঙ্গা অহন পুরাই কেমিকেল! এইটা আর নদী নাই! ১০ বছর বয়স থিকা এই নদীতে নৌকা বাইছি, মাছ ধরছি। শত শত জাওল্যা (জেলে) বাঁইচ্যা আছিল নদীর মাছের ওপর। তহন পানি আছে টলটইল্যা পরিষ্কার। পরে ট্যানারিওয়ালারা কেমিকেল ফালাইতে ফালাইতে পুরা নদীই বিষাক্ত বানাইছে। মাছ তো দূরের কথা, এই নদীতে অহন কোনো পোকামাকড়ও নাই। পানির দুর্গন্ধে মানুষজন নদীর ধারেকাছেও ভিড়ে না।'
প্রতি এক লিটার নদীর পানিতে ৫ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন না থাকলে সেখানে মাছসহ কোনো জলজ প্রাণীই বাঁচতে পারে না। অথচ বুড়িগঙ্গা নদীর কোথাও আদর্শ মাত্রার দ্রবীভূত অক্সিজেন তো নেই-ই, কোথাও কোথাও এর পরিমাণ শূন্যের কোঠায়। পরিবেশ আন্দোলনের (পবা) সর্বশেষ পরীক্ষায় দেখা গেছে, চাঁদনী ঘাট, সদরঘাট টার্মিনাল, সোয়ারীঘাট, ধোলাইখাল, পাগলা বাজারসহ ৯টি স্থানের বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ লিটারে এক মিলিগ্রামের নিচে। পবার পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, সদরঘাট এলাকার পানিতে লিটারপ্রতি দশমিক ৪০ মিলিগ্রাম, ধোলাইখালে দশমিক ৩৮ মিলিগ্রাম, পোস্তগোলা-শ্মশানঘাটে দশমিক ৫৫ মিলিগ্রাম, শ্যামপুর খালের ভাটিতে দশমিক ৬২ মিলিগ্রাম, পাগলা ওয়াসা ট্রিটমেন্ট প্লান্টের নির্গমন ড্রেনের ভাটিতে দশমিক ৩৩ মিলিগ্রাম, পাগলা বাজার এলাকায় মাত্র দশমিক ৩০ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) রয়েছে। অন্যদিকে নদীতে পড়া নালার পানিতে পিএইচের মাত্রা ১০ দশমিক ৩২ ও খালের মুখে ৯ দশমিক ৯৯ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ এই পানিতে এসিডের মাত্রা অত্যন্ত বেশি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হাজারীবাগের ট্যানারিশিল্প থেকে দৈনিক ২১ হাজার কিউবিক মিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। এসব বর্জ্যে ক্রোমিয়াম, সিসা, সালফিউরিক এসিড, পশুর পচা মাংসসহ ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে। ট্যানারি থেকে নির্গত এসব বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানি তো বটেই, নদীর তলদেশ, তীরের মাটি ও বাতাসকেও বিষিয়ে তুলেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকায় পয়ঃবর্জ্যের পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ১৩ লাখ ঘনমিটার। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের পাগলায় ওয়াসার শোধনাগারে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য শোধন হচ্ছে। বাকি বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে।
জানা গেছে, সদরঘাট, কেরানীগঞ্জ, লালবাগ, সোয়ারীঘাট, কামরাঙ্গীরচর, শহীদনগর, আমলীপাড়া, চাঁদনীঘাট- এসব এলাকার পানি যেন 'তরল ছাই'। ওয়াসার বর্জ্য ও ট্যানারি বর্জ্য ছাড়াও তীরের শিল্প-কারখানার বর্জ্য, কাঁচাবাজারের প্রতিদিনের আবর্জনা, স্টিমার-লঞ্চ ও অন্যান্য নৌযান থেকে নিঃসৃত বর্জ্য নদীর পানি প্রতিনিয়ত দূষণ করছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবহেলায় বুড়িগঙ্গার দুই পাশে অসংখ্য পাইপ দিয়ে স্যুয়ারেজের ময়লা সরাসরি নদীতে পড়ে। সদরঘাট থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত এ রকম দূষণের উৎসমুখ ১০৭টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গাবতলী গরুর হাট, আপেল এন্টারপ্রাইজ, বেসটেক লিমিটেড, এনডিএ, পূর্বাশা কাঁচাবাজার, ট্যানারি, ঢাকা ওয়াসা ও মিটফোর্ড হাসপাতাল। সদরঘাট থেকে ফতুল্লা বিজি মাউথ পর্যন্ত ৫৭টি উৎসমুখ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা ২২টি উৎসমুখ থেকে পানি ও বর্জ্য ফেলছে। টেক্সটাইল, ডাইং, প্রিন্টিং ও ওয়াশিং কারখানাগুলো প্রতিদিন ৬০ হাজার লিটার তরল বর্জ্য নদীতে ফেলছে।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বুড়িগঙ্গা দূষণের প্রধান কারণ হচ্ছে কয়েক দশক ধরে প্রকাশ্যে শ দেড়েক ট্যানারি কারখানার সব রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা। এর বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের বহু বছরের রাজপথের আন্দোলন, জনসাধারণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আদালতের নির্দেশ- কোনোটিকেই মালিকপক্ষ আমলে নেয়নি। চামড়া শিল্প জাতীয় রাজস্ব আয়ের একটি বড় খাত হওয়ায় সরকারগুলোও তাদের বিরুদ্ধে রাতারাতি ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এ অবস্থায় হাজারিবাগের ট্যানারি কারখানাগুলো সাভারের চামড়া শিল্প নগরে স্থানান্তর বিলম্বিত হওয়ায় পরিবেশ দূষণ অব্যাহত রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশি-বিদেশি চাপের মুখে বহু দেন-দরবারের পর ট্যানারি মালিকরা ২০১৫ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে অধিকাংশ বড় কারখানাগুলো সাভারে স্থানান্তরে উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ না দেওয়া হলে রাজস্ব আয়ের একটি বড় শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পাকা চামড়া, চামড়া পণ্য ও জুতা রপ্তানিকারক সমিতির (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি আবু তাহের কালের কণ্ঠকে জানান, পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য তৈরি করতে তাদের ওপর বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ নানা দেশের ক্রেতা গোষ্ঠীর চাপ রয়েছে। এরই মধ্যে তারা হুমকি দিয়ে বলেছে, অন্যথায় ২০১৫ সাল থেকে তারা বাংলাদেশের কোনো চামড়া, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য কিনবে না।
বুড়িগঙ্গা বাঁচলে বদলে যাবে ঢাকা : দেশের পরিবেশবাদী ও নাগরিক সংগঠনগুলো বলছে, বুড়িগঙ্গা বাঁচিয়ে এ নদীকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করলে ঢাকা বদলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যস্ত শহর নিউ ইয়র্কের ওপর চাপ কমাতে ম্যানহাটন ও লং আইল্যান্ডের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ইস্ট রিভারের ওপর সেতু নির্মাণ করেছে সে দেশের কর্তৃপক্ষ। এ কারণে নিউ ইয়র্কের পাশাপাশি ম্যানহাটন ও লং আইল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। এর আদলে বুড়িগঙ্গার ওপর সেতু করা গেলে গোটা ঢাকার চেহারা বদলে যাবে।
এ বিষয়ে নাগরিক সংগঠন দুর্নিবার বাংলাদেশের সভাপতি মাসুদ পারভেজ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে উন্নত দেশের মতো করে হাতিরঝিল যদি করা যায় তাহলে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরেও এ রকম প্রকল্প করা সম্ভব। সরকার যদি বুড়িগঙ্গার দুই তীরে প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করে, নদীর ওপর একাধিক সেতু করে তাহলে বদলে যাবে ঢাকা ও কেরানীগঞ্জ। ঢাকা তখন বর্ধিত হবে। এটা করা গেলে শুধু ঢাকার ওপর চাপ কমবে তাই-ই নয়, কেরানীগঞ্জকে কেন্দ্র করে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হবে তা দেশের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/01/03/170886/print
No comments:
Post a Comment