পার্বত্য জেলা বান্দরবানের
রোয়াংছড়ির ক্রাইক্ষংপাড়া নামক মারমা জনগোষ্ঠি অধু্যষিত এলাকায় বিজিবি'র (বর্ডার
গার্ড অব বাংলাদেশের) ক্যাম্প নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিস্তৃর্ণ পাহাড়ি জনপদ উচ্ছেদ
হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এমন খবর আমরা ঢাকার সাংবাদিকরা আগেভাগেই কিছু টুকরো
খবরে জেনেছি। সরেজমিনে খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য এক সকালে দুই মাইক্রোবাস ভর্তি
বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি মিডিয়ার সাংবাদিকরা রওনা দেই ঘটনাস্থলের দিকে।
ওই রাতে আমরা নির্বিঘ্নে
বান্দরবান সদরের একটি হোটেলে রাত্রি যাপন করি।
সেখানে আমাদের পাহাড়ি বন্ধুরা ঘটনা সর্ম্পকে খানিকটা আলোকপাত করেন। তারা
জানান, রোয়াংছড়ির স্থানীয় মারমা জনগোষ্ঠির পাহাড়িরা বলছেন, প্রশাসনিক মতবিনিময়
ছাড়াই ক্যাম্প নির্মাণ করায় আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে বাইরের লোক সমাগম বাড়বে। এতে
ক্রমেই হারিয়ে যাবে বিস্তৃর্ণ পাহাড়ে তাদের স্বাধীন জীবন। ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে
দোকান-পাট ও অপাহাড়িদের জনবসতি গড়ে উঠবে বলে ধীরে ধীরে উচ্ছেদ হবে অন্তত পাঁচটি
পাহাড়ি গ্রাম। এছাড়া ক্যাম্প এলাকার ভেতরে রয়েছে তাদের জুমচাষের জমি এবং শত বছরের
প্রাচীন বেৌদ্ধ শ্মশান। তাদের পক্ষে চাষবাস বন্ধ করে অন্যত্র বসতি গড়ার পাশাপাশি
পৈত্রিক শ্মশানটির মায়া কাটানো খুবই কঠিন।
পরদিন ২১ অক্টোবর সকালে
আমরা রওনা দেই ঘটনাস্থলের দিকে। আমাদের দুটি ভাড়ার জীপে যুক্ত হযেছেন চট্টগ্রাম ও
বান্দরবানের বেশ কজন স্থানীয় সাংবাদিক। রোয়াংছড়ির ক্রাইক্ষং বিজিবি ক্যাম্প কমাণ্ডার
সুবেদার মো. কালামের অনুমতিক্রমে ক্যাম্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিজিবি'র সৈনিকরা
সেখানে অস্থায়ী কয়েকটি বাঁশের কুড়ে ঘরের পাশাপাশি ইটকাঠ দিয়ে পাকা অফিস বাড়ি
নির্মাণ করছেন। তার সঙ্গে আলাপ-চারিতার সময়ই একদল উত্তেজিত মারমা নারী-পুরুষ
লাঠিসোটা হাতে জোর করে ক্যাম্পের ভেতর প্রবেশ করার চষ্টো চালায়। ওই দলে নারীরাই অগ্রগ্রামী। সবাই উত্তেজিত হয়ে
একটি কথাই বলছিলেন, হ্লা! হ্লা! অর্থাত্, চলো! চলো! তাত্ক্ষণিকভাবে স্থানীয়
জনপ্রতিনিধিরা তাদের নিবৃত্ত করেন।
এর কারণ সর্ম্পকে জানতে
চাইলে সুবেদার কালাম আমাদের বলেন, এলাকাবাসীর বক্তব্য হচ্ছে, ক্যাম্পের পেছনে যে
শ্মশানটি আছে, সেটিতে যাওয়ার পথ আটকে নাকি ক্যাম্প করা হয়েছে। কিন্তু শ্মশানে
যাওয়ার জন্য রয়েছে বিকল্প রাস্তা। তিনি জানান, সদ্য গড়ে ওঠা ক্যাম্পটির এখনো
নামকরণ করা হয়নি। এই ক্যাম্পটিকেই পরে উন্নীত করা হবে বিজিবি'র সেক্টর সদর দপ্তরে।
পরে ক্যাম্প এলাকা ঘুরে
দেখা যায়, কাঁটাতাঁরের বেড়ার সীমানা বষ্টেনীর ভেতরে রয়েছে জুমের চাষের ধান ও
হলুদের ক্ষেত। সেখানে রয়েছে আম ও পেয়ারার বাগান। ক্যাম্পের একদম শেষ প্রানে্ত একটি
খালের পাড়ে ক্রাইক্ষং পাড়া মারমা মহাশ্মাশানের অবস্থান। খালপাড়ে কিছু পোড়া
ছাইমাটি বহন করছে শ্মশানের সাক্ষ্য।
রোয়াংছড়ি উপজেলা
চেয়ারম্যান ক্যাবা মারমা (৪০) আমাদের বলেন, শ্মশানটিতে যাওয়ার জন্য বিকল্প রাস্তা
থাকার কথা মোটেই ঠিক নয়। একমাত্র শুকনো মেৌসুমে খালটির পানি কমে গেলে গ্রামবাসী
খালটির ভেতর দিয়ে শ্মশানে আসতে পারেন। তবে বর্ষা মেৌসুমে পাহাড়ি খালটি হয়ে ওঠে
ভয়ংকর বিপদজনক। তখন এই খাল ধরে শ্মশানে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া এটি অনেক
ঘুর পথ। আর এ কারণেই পাহাড়িদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ ও অসনে্তাষ।
বলা ভালো, ক্যাবা মারমা'র
সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ১৯৯৫-৯৬ সালে, অখণ্ড পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) আমলে।
অনেক বছর পরে দেখা হলেও সে আমাকে ঠিক সনাক্ত করে। কাজের ফাঁকে দুজনা সামান্য
ব্যক্তিগত কুশল বিনিময়ও সেরে নেই।
ঘটনা স্থলে উপস্থিত
ক্রাইক্যং মো পাড়ার চাংগ্যা প্রু কারবারী (গ্রাম প্রধান) (৫৫) বলেন, বিজিবি
যেখানে ক্যাম্প গড়ে তুলেছে, সেখানের খাস জমিতেও এক সময় পাহাড়ি গ্রাম ছিল। জনবসতি
বাড়তে থাকায় এরশাদ সরকারের আমলে গ্রামগুলোকে একদফা সরানো হয়েছে। এখন বিজিবি'র
ক্যাম্প গড়ে ওঠার পর প্রাচীন জনপদগুলোকে হয়তো দ্বিতীয়বারের মতো স্থানান্তরিত
করতে হবে। কিন্তু লোকসংখ্যা বেড়ে চলায় পাহাড়ে চাষবাসের জমি
ক্রমেই কমে আসছে।
ক্রাইক্ষং পাড়া গ্রামের মনু
সা (৪৫) নামের একজন জুমচাষী অভিযোগ করে বলেন, Èশানি্তচুক্তির আগে আমরা প্রায়
আড়াইদশক ধরে ছিলাম বন্দুক যুদ্ধের মুখে। আর এখনো পাহাড়ে শানি্ত হয়নি।'
একই এলাকার রামজাদি বেৌদ্ধ
বিহারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুরোহিত (ভানে্ত) জানান, গত মার্চ-এপ্রিলে
বিজিবি তাদের বিহারের জমিতে ক্যাম্প স্থাপন করতে চেয়ে লাল পতাকা দিয়ে সীমানা
নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু তারা শত শত ভানে্ত বান্দরবান সদরে গিয়ে লাগাতার বিক্ষোভ
করায় ওই সদ্ধিান্ত বাতিল হয়েছে।
ফেরার পথে আমরা খবর পাই,
বাঙালি সেটেলার অধু্যষিত বড়ুয়াটেক নামক এলাকায় আমাদের গাড়ির বহরদুটিকে আটকে দিতে
নাকি ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে! এই খবরে খুব চমকাই না। কারণ কিছুদিন আগেই সিএইচটি
কমিশনের হানা শামসের ওপর বান্দরবানের সেটেলাররা হামলা চালিয়েছিল। এর আগে খাগড়াছড়ি
ও রাঙামাটিতেও অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের উপস্থিতিতে কমিশনের গাড়ির বহরে দফায়
দফায় হামলা হযেছে। দৃশ্যতই এসব হামলার নেপথ্যে রয়েছে প্রত্যক্ষ সেনা মদদ। আর
রোয়াংছড়ির বিজিবি'র স্বার্থের নেপথ্যেও রয়েছে সেনা স্বার্থ রক্ষা। তো একই সূত্রে
আমরা বিজিবি'র প্রতিপক্ষ ধরে নিলে আমাদের ওপর সেটেলার হামলা হওয়া বিচিত্র নয়।
এদিকে বিজিবি ক্যাম্প
পরিদর্শন করে ফিরছিলেন সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। আমরা
টেলিফোনে তাকে ধরে ঘটনা জানাই। ওসিও বলেন, তিনিও ব্যারিকেডের কথা শুনেছেন। আমরা
তাকে অনুরোধ করি, পুলিশের গাড়ির প্রহরায় সবগুলো গাড়ি যেনো একই সময় ফিরতে পারে।
তিনি রাজী হলে আমাদের দুটি ভাড়ার জীপ তার গাড়িকে অনুসরণ করে বান্দরবান সদরে ফেরে।
পথে অবশ্য কোনো ব্যরিকেড আর দেখিনি। তবে খবর পাই বড়ুয়াটেকে ঠিকই সেটেলাররা
ব্যরিকেড দিয়েছিল। কিন্তু পরে তারা জানতে পেরেছে যে, এই গাড়ি দুটি সিএইচটি কমিশনের
নয়, এটি সাংবাদিকদের। তখন তারা ব্যারিকেড তুলে নেয়।
ভাবতে অবাক লাগে, পাহাড়িদের
জায়গা-জমি কেড়ে নিয়ে বিজিবি ক্যাম্প বানাচ্ছে, এতে বাঙালি সেটেলারদের কি ক্ষতি বা
উপকার হচ্ছে? তাদের ব্যারিকেড ইত্যাদি দিয়ে শোষণের পক্ষে দাঁড়াতে হবে কেনো? অথচ
গ্যারিসনের মক্তবগুলো বহু বছর ধরেই পাহাড়ে বেশ সফলভাবেই চালছে এই Èনারায়ে তাকবির'
কূটচাল। দেশপ্রেম কাম ঈমানী বটিকার বাজারো বেশ ভালো। আর এর নিয়মিত ভোক্তা
হচ্ছেন সেখানের কিছু স্থানীয় সাংবাদিক, এনজিও কর্মী, বিএনপি-জামায়াত, মাদ্রাসা,
হেফাজতসহ আরো নানান কিসিমের মানুষ।
পরে আমরা সাক্ষাত্ করি জেলা
প্রশাসক একে তারিকুল ইসলামের সাথে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, বিজিবি'র নিরাপত্তার
কাজ সুষ্ঠু করতে রোয়াংছড়ির ক্রাইক্ষংপাড়ায় মোট ৩৪ একর জমিতে সেক্টর সদর দপ্তর
নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ১৩ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন
পড়বে। অধিগ্রহণের কাজ এখনো শেষ হয়নি ঠিকই, কিন্তু বিজিবি যেহেতু প্রতাশী সংস্থা,
সেহেতু তাদের জমিটিতে সতর্ক অবস্থান, তথা অস্থায়ী ক্যাম্প করার অনুমতি দেওয়া
হয়েছে। আর পুরো কাজটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলায় ও পার্বত্য জেলা পরিষদের অনুমোদন
রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি
বলেন, দেশের কথা চিন্তা করে, বৃহত্তর স্বার্থে স্থানীয়দের কিছুটা ক্ষতি স্বীকার
করে নিতেই হবে। এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হবে জমি অধিগ্রহণের সব প্রক্রিয়া। ক্যাম্পের
ভেতর ফসলী জমির মালিকরা যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর অধিগ্রহণ আইন মেনেই শ্মশানটি থাকবে
অধিগ্রহণের বাইরে।
বরাবরই তিনি আইন মেনে চলার
কথা বলছিলেন। কিন্তু তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, বিজিবি'র ক্যাম্প অধিগ্রহণের জন্য
তিনি ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি মেনে আঞ্চলিক পরিষদ, মং রাজা এবং
হেডম্যান (মেৌজা প্রধান) এর মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী
রীতিনীতি এবং জনমত। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমাদের মনে হয়েছে, এক
তরফাভাবে বিজিবি সেখানে দখল প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বে। খাগড়াছড়ির দিঘীনালার বাবুছড়ায়
তারা যে কায়দায় বন্দুকের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে, রোয়াংছড়ির ক্রাইক্ষং পাড়াতেও একই
কায়দায় দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা হবে।
জানিয়ে রাখি, ১৯৯৭ সালের ২
ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত শানি্তচুক্তির শর্ত অনুযায়ী পার্বত্যাঞ্চল থেকে অস্থায়ী
নিরাপত্তা ছাউনি প্রত্যাহার করার কথা। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য গেৌতম কুমার
চাকমা এবং কে এস মং গত ২৮ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটির কাছে
লিখিত অভিযোগে বলেছেন, সরকার ওই শর্ত লঙ্খন করে একের পর নিরাপত্তা ছাউনি বৃদ্ধি ও
স্থানান্তর করে চলেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটিতে উপেক্ষা করা
হচ্ছে জনমত।
--
সংযুক্ত:
#Video: http://fb.me/3CjJdG7zs
#Video: http://fb.me/79nUHb39e
#News: http://fb.me/7Qv8l1auR
No comments:
Post a Comment