Monday, November 10, 2014

সংশপ্তকের জন্য বিপ্লব রহমানের সাক্ষাৎকার

মুখোমুখি: প্রখ্যাত সাংবাদিক বিপ্লব রহমান

সংশপ্তক: বিপ্লব আপনি মুক্তিযুদ্ধের লগ্নে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের একজন। সেই হিসেবে আপনার জীবন ও স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস; এই দুয়ের মধ্যে সমান্তরাল সম্পর্ক সূত্রটি ঠিক কি বলে মনে হয় আপনার?

বিপ্লব রহমান: আপনি ঠিকই বলেছেন, একদম অগ্নিগর্ভ মুক্তিযুদ্ধের কালে আমার জন্ম। ওই সময়ে আমরা যারা জন্মেছি, তারা নিজেদের প্রজন্ম '৭১ বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করি। আপনি জেনে খুশী হবেন, মুক্তির লড়াইয়ের কালে জন্ম নেওয়া সে সময় শত সহস্র সদ্যজাত শিশুর নাম রাখা হয়েছিল "বিপ্লব", "মুক্তি", "নিশান", "সবুজ", "আজাদ", "শিখা", "আগুন" ইত্যাদি। এইসব নামে আমাদের পূর্বসূরিরা স্বাধীনতার স্বপ্ন গেথেঁ দিয়েছেন। আর আমরা সেই চেতনার রক্তবীজ ধারণ করেই বেড়ে উঠেছি।

লক্ষ্যনীয়, সাতের দশকের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এপার বাংলাতেও। আমার বাবা আজিজ মেহের ছিলেন সাবেক নকশলাইট নেতা। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক জান্তা তাকে কারারুদ্ধ করে যাবজ্জীবন দিয়েছিল। তো বাবা জেলখানা থেকেই আমার নাম রেখেছিলেন। অর্থাৎ এই নামের ভেতর তিনি রাষ্ট্র বিপ্লবের আকাঙ্খাটির ছাপ রেখেছেন। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন তো বটেই।

সংশপ্তক: স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছরের দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র কতটা সমৃদ্ধ আজকে?

বিপ্লব রহমান: স্বাধীনতার পর পরই শেখ মুজিব এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানের দুঃশাসনে খুব দ্রুতই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন চুরমার হয়। অস্ত্র নির্ভর/ জনবিচ্ছিন্ন ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে নকশালাইটসহ অপরাপর মাওবাদী সশস্ত্র আন্দোলনও চোরাবালিতে পথ হারায়। পুরো দেশের স্বপ্নই যখন দিশেহারা, তখন প্রজন্ম '৭১ কিন্ত পথ হারায়নি। একারণেই ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ গণবিস্ফোরণে আমাদের প্রজন্ম বুঝিয়ে দিযেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর যেখানে ব্যর্থ, সেখানে প্রজন্ম '৭১ পুরো জাতিকে পথ দেখাতে সক্ষম।

তো মুজিব-জিয়ার পথ ধরেই এরপর জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সরকার মুক্তিযুদ্ধ চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করে দেশকে ইসলামীকরণের পাশাপাশি যথেচ্ছ রাজাকার তোষণ করেছেন। ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রীত্ব দিয়ে, রাষ্ট্রদূত বানিয়ে তারা পুনর্বাসন করেছেন। আবার খালেদা জিয়া-শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামকে সাথে নিয়ে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলন করে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে ঘাতকদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জিয়া, এরশাদ, খালেদা, হাসিনার সরকার যখনই ক্ষমতায় গেছেন, তখনই তাদের দলের রাঘব-বোয়াল নেতারা তো বটেই, এমনকি চুনোপুটি নেতারা পর্যন্ত হয়েছেন শূন্য থেকে কোটিপতি। বেড়েছে ধনী-গরীব বৈষম্য। আর দেশ বিরোধী ফারাক্কা চুক্তি, টিকফা চুক্তি, জ্বালানি চুক্তি, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র চুক্তিসহ সব গণবিরোধী চুক্তি হয়েছে তাদের আমলেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও তারা যথেচ্ছ লিখেছেন কারো পিতা বা কারো স্বামীর মহিমাকে আকাশচুম্বী করার স্বার্থে।

এই যখন দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা, তখন গণতন্ত্রের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমাদের জনবিরোধী সরকারগুলোর শাসনে গণতন্ত্র এখনো টবের গাছ। এর প্রাণ আছে, কিন্তু বাড় নেই।

সংশপ্তক: এবার একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক। ১৯৪৭-এর তথাকথিত যে স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতার ভিত্তি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত, যার ফলসরূপ দেশভাগ- সেই দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্বন্ধে আপনার মূল্যায়ণ কি?

বিপ্লব রহমান: ১৯৪৭ এর দেশভাগটি হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে। আর এতে নেহেরু-জিন্নার মতো সাম্রাজ্যবাদী দোসররা মেৌলবাদী কুপমণ্ডকতায় এটি বাস্তবায়ন করেছেন মাত্র। এ জন্য সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া হয়নি। গণভোটের তোয়াক্কা না করে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান ধর্মের জিকিরকে হাতিয়ার করে কোটি কোটি মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উস্কে দেওয়া হয়েছে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা।

ধর্ম, ভাষা, জাতি বা বর্ণ পরিচয়ে কোনো দেশভাগ হবে কি না, অথবা নতুন দেশ তৈরি হবে কি না, সেটি সাধারণ মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিৎ। এটি মোটেই গুটিকয় নেতার এখতিয়ারভূক্ত বিষয় হওয়া উচিৎ নয়।

দেশ বিভাগের যন্ত্রণা খুব কাছ থেকে টের পাই ১৯৯৯ সালে ঢাকা-কলকতা সরাসরি বাস চালু হলে। তথ্য-সাংবাদিকতার পেশাগত সূত্রে আমি ছিলাম ওই বাসের প্রথম ট্রিপের যাত্রী। এপার থেকে যশোর রোড ধরে বাসটি ওপার সীমান্তে পেৌঁছাতেই শত শত গ্রামের নারী-পুরুষ বাসটিকে ঘিরে ধরে। তারা ধূপ-ধুনো দিয়ে, উলু ধ্বনী দিয়ে বাসটিকে স্বাগত জানায়। বাসের জানালা দিয়ে আমি উকি মেরে দেখেছি, বর্ষিয়ান নারীরা বাসটিকে ছুয়েঁ ছুয়েঁ দেখছেন, অনেকেই শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। এখনো মনে আছে, এক বৃদ্ধা বাসের দিকে কয়েকটি গাদা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বেশ আর গর্ব করেই বললেন, আমাগো বাংলাদ্যাশের গাড়ি!

বলা ভালো, ওপার বাংলার এইসব মানুষজন '৪৭ এর দেশবিভাগের শিকার। কিন্তু এখনো তারা মনে মনে বাংলাদেশকেই নিজের দেশ মনে করেন, ভারতমাতা এখনো তাদের কাছে আপন নয়।

কৃষণ চন্দর তার "গাদ্দার" বইটিতে দেশ বিভাগের ভয়াল রূপ আরো চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

সংশপ্তক: এবং এই সূত্রেই খুব জানতে ইচ্ছে করছে, মাতৃভূমি স্বদেশ ও তার অখন্ডতার বিষয়টি আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন!

বিপ্লব রহমান: আগেই বলেছি, ধর্ম, ভাষা, জাতি বা বর্ণ পরিচয়ে কোনো দেশভাগ হবে কি না, অথবা নতুন দেশ তৈরি হবে কি না, সেটি সাধারণ মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিৎ। এটি মোটেই গুটিকয় নেতার এখতিয়ারভূক্ত বিষয় হওয়া উচিৎ নয়।

কোনো জনগোষ্ঠি নিপীড়িত বোধ করলে তারা সশস্ত্র সংগ্রাম করতে পারে। সেটি ভারতের নাগাল্যান্ড বা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠি একারণেই সশস্ত্র সংগ্রাম করেছেন। তবে তাদের দাবি ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন। এখন ওই দুই অঞ্চলের জনগোষ্ঠি আরো এক দফা এগিয়ে যদি স্বাধীনতার সংগ্রামই শুরু করতেন, আমি তো মনে করি, ১৯৭১ এর অভিজ্ঞতার কারণে মুক্তচিন্তার মানুষ মাত্রই তাকে সমর্থন করা উচিৎ হতো। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র নিজস্ব সংকীর্ণ দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে বা অখণ্ডতা মুখস্ত বুলি আউড়ানোর অর্থ হচ্ছে, সরাসরি নিপীড়নের পক্ষ নেওয়া। এটি হওয়া একদম উচিৎ নয়।

সংশপ্তক: এইবার একটু সরাসরিই জানতে চাইব, এই যে বিগত সাত দশক ব্যাপি আমাদের বাংলা দেশটা দু-টুকরো হয়ে পড়ে আছে, এই বিচ্ছিন্নতা আপনাকে কতটা কষ্ট দেয়, বা আদৌ দেয় কিনা?

বিপ্লব রহমান: আমার মনে হয়, দেশবিভাগের বিষয়ে মনে হয়, এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে। তবু সংক্ষেপে বলি, বাংলা ভাষাভাষীর বুকের ওপর দিয়ে টেনে দেওয়া কাঁটাতারটি খুব কষ্টের। এই কষ্টবোধ এপার বাংলার বাঙালির যতো না বেশী, ভাষাগত নিপীড়নের কারণে ওপার বাংলার বাঙালির কষ্টটি বোধহয় আরো বেশী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসলে কোনো কাঁটাতারেঁই ভাষা, জাতীয়তাবোধ, মমত্ব, মুক্তচিন্তা বাধা যায় না। আর আমি নিশ্চিতভাবে বিস্বাস করি, সভ্য মানুষ একদিন বিশ্বের সমস্ত কাঁটাতার/ দেশ সীমান্ত উপড়ে ফেলবেন।

সংশপ্তক: এবারে ফিরে আসি বর্তমান প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের জন্মলগ্নে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জাগরণ ঘটেছিলো; যার ফলসরূপ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সংবিধানের কথা বলা হয়েছিল; বর্তমানে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় তার প্রাসঙ্গিকতা কতটা অবশিষ্ট আছে বলে আপনার ধারণা?

বিপ্লব রহমান: এই প্রশ্নটির বেশখানিকটা জবাবও বোধহয় দেওয়া হয়েছে। ভোটের বাক্স ভর্তি করতে খালেদা-হাসিনা-এরশাদ-নিজামীর দল বরাবরই ধর্মের ঈমানী দণ্ডটিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। তারা মেৌলবাদী অপরাপর দলগুলোর কাছেও নতজানু। এ কারণেই শাহবাগ গণবিস্ফোরণের কালে হেফাজতে ইসলামের আব্দার মেনে হাসিনা সরকর চারজন "নাস্তিক" ব্লগারকে গ্রেফতার করেছিল। আর এই সূত্রেই লেখিকা তসলিমা নাসরিন বা কবি দাউদ হায়দার বহু বছর দেশ ছাড়া।

হাসিনার পর পর দুইদফার শাসনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুবাস আছে, সারবস্তু তেমন নেই। ১৯৭১ এখন তাদের কাছে একটি বিজ্ঞাপন বটিকা মাত্র, যে বটিকা ব্যবহারে ভোটের কদর বাড়ে, কিন্তু দেশ যাত্রা করে মেৌলবাদী আচকানে পেছনের দিকে।

একটি নিজস্ব ব্যক্তিগত গল্প বলে বিষয়টি আরো খোলাসা করতে চাই। আমার মা সৈয়দা আজগারী সিরাজী। সরকারি চাকুরে ছিলেন, অবসর নিয়েছেন সেও বহু বছর হলো। তার বয়স এখন ৭২। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন দেখে পাকিস্তান আমলেই মঞ্চ নাটক করেছেন, গান গেয়েছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

তো সেদিন গুমট গরমের দুপুরে বাসায় টিভির নিউজ দেখছিলাম। রিপোর্টারের প্রশ্নের জবাবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিজাব পরিহিতা ছাত্রী ইংরেজী-বাংলা মিশিয়ে খুব স্মার্টলি উত্তর দিচ্ছেন। হঠাৎ পাশ থেকে আমার মা বলে উঠলেন, "এরা গরমের ভেতর এসব কি জোব্বা পড়েছে!" আমি বললাম, "মা, আমরা তো আবার পাকিস্তানে ফেরত যাচ্ছি, তাই হিজাবই এখন ফ্যাশন। আর ফ্যাশনের কোনো গরম-ঠাণ্ডা বোধ নেই।" মা বললেন, "পাকিস্তান আমলে তো আমরা হাতাকাটা ব্লাউজ পড়েছি। তখনো তো এতো হিজাব-বোরখার বাড়াবাড়ি দেখিনি। আমরা বোধহয় পাকিস্তানে নয়, সেৌদি আরবের দিকে যাচ্ছি।"...

সংশপ্তক: কাঁটাতারের এপাড় থেকে ওপাড়ের কোলাহলে কান পাতলে মনে হয়, বাংলাদেশ আসলেই দুটি জনগোষ্ঠীর দেশ। একদল আগে বাংলাদেশী পরে মুসলিম, অন্যদল আগে মুসলিম পরে বাংলাদেশী। এবং এই দুই জনগোষ্ঠীর প্রবল চাপে, বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখী। এই পরিস্থিতিতে দেশের ভবিষ্যত অভিমুখ কোনদিকে বলে আপনার মনে হয়?

বিপ্লব রহমান: আপনি ঠিকই বলেছেন, এপার বাংলার বাঙালিদের ধর্ম নিয়ে কোনো কালে বাড়াবাড়ি ছিল না, ভাতৃবোধ, সেৌহার্দবোধ, অপরাপর ধর্ম ও জাতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল বিস্ময়কর। কিন্তু শাসকগোষ্ঠি নিজেদের শোষণ-শাসন টিকিয়ে রাখতে সামন্তবাদী ধর্মের উস্কানিকে কাজে লাগায়। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমূলে উৎপাটনটি তাদের কাছে জরুরি। কারণে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে, সব মানুষের সমান অধিকার, আত্নমর্যাদা নিয়ে বাঁচার কথা বলা হয়েছে।

এরই ধারবাহিকতায় ১৯৭১ এ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সব ধরণের চরম আত্নত্যাগ স্বীকার করা আদিবাসী মানুষজনকে তারই স্বাধীন করা দেশে প্রতি পদে পদে নিগৃহিত হতে হয়। জমি কেড়ে নিতে পাহাড় ও সমতলে আদিবাসী জনপদে চালানো হয়েছে একের পর এক গণহত্যা, গণধর্ষন, জ্বালাও-পোড়াও নিপীড়ন। ভাবতে অবাক লাগে, জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে ১৯৭১ এর রুখে দাঁড়ানো বাঙালি জাতি এখন স্বাধীন দেশে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির কায়দায় আদিবাসী মানুষদের ওপর একই রকম জাতিগত নিপীড়ন করে কি করে!

সংশপ্তক: বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আপনি খুব কাছ থেকে দেখছেন। তাদের জীবন ভাষা সংস্কৃতি যা এই বাংলারই জলবায়ুর মতই স্বতঃসিদ্ধ; সেইসবকে সুরক্ষিত করার জন্যে কোনো সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন কতটা? কেননা, বৃতত্তর জনগোষ্ঠীর থেকে বিচ্ছিন্নতা তাদের একদিকে যেমন প্রান্তিক করে রাখে, আবার ঠিক তেমনই ক্রমাগত নগরায়ণের শিকার হওয়া তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা রক্ষার পথে প্রধান অন্তরায়। এই দুই বিপ্রতীপ ধারার মধ্যে কাম্য সমন্বয় সাধন সামাজিক আন্দোলন ছাড়া কি সম্ভব?

বিপ্লব রহমান: আদিবাসী অধিকারের প্রশ্নে আমার মনে হয়, উগ্র বাঙালি জাত্যাভিমান নামক বিষফোঁড়ার জরুরী অস্ত্রপচার প্রয়োজন। নইলে বিষফোঁড়ার বিষাক্ত রক্ত ও পুঁজ শুধু আদিবাসী সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ঐতিহ্যকেই নয়, এটি দুষিত করবে বাঙালি মূল সংস্কৃতিকেও। আরও চাই, রাষ্ট্র যেন আদিবাসীর প্রতি মানবিক আচরণ করে।

তবে শুধুমাত্র শুভ আকাঙ্কার ওপরেই এই সব চাওয়ার বাস্তবায়ন নির্ভর করে না। আবার আবেদন নিবেদনেও আদিবাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। এ জন্য দরকার পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীর যুথবদ্ধতা। সিঁধু, কানহু, বিরসা মুণ্ডা, কুমুদিনী হাজং, এমএন লারমা, কল্পনা চাকমা, আলফ্রেড সরেন, পিরেন স্নাল, চলেশ রিছিল প্রমুখর দেখানো রক্তে পিচ্ছিল দীর্ঘ পথটিই আদিবাসীর মুক্তির পথ। লড়াই-সংগ্রামের এই পথে অগ্রগামী হবেন আদিবাসীরাই। তবে সহযোগি হিসেবে প্রগতিশীল বাঙালি বন্ধুদেরও তার পাশে চাই। নইলে অন্য কোনো পথেই আদিবাসীর মুক্তি নেই। আর এনজিও বা চার্চ প্রদর্শিত পথে তো নয়ই। ...

সংশপ্তক: এবার একটু আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গে দৃষ্টি ফেরানো যাক। বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ একটি বহুল চর্চিত বিষয়। বিগত শতকের ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসানের পর, একমেরু ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের আগ্রসনের জন্যে সন্ত্রাসবাদের চাষ খুবই জরুরী একটি বিষয়। আর এর সুফল ফলতে দেখছি আমরা বিগত দুইদশক ব্যাপিই! এখন প্রশ্ন হল আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলি, কি ভাবে এই সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে পারে, যেখানে তথাকথিত দেশনেতারা খুব সহজেই বিকিয়ে যেতে পারেন যখন তখন?

বিপ্লব রহমান: বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস বাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সরকারি আস্কারায়। বিএনপি সরকারের শাসনামলে বাংলা ভাই নামক জেএমবি ভযংকর জঙ্গি গোষ্ঠির উত্থান। সে সময় সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর বলেছিলেন, তিনি নাকি বাংলা ভাই, ইংলিশ ভাই কাউকে খুজেঁ পাচ্ছেন না। তাদেরই আরেক মন্ত্রী, জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধী নিজামী বলেছিলেন, বাংলা ভাই নাকি মিডিয়ার সৃষ্টি। এরকম কোনো জঙ্গি নাকি দেশে নেই।

১/১১ তে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জং্গি অভিযানে একের পর এক সন্ত্রাসী আড্ডাস্থল থেকে উদ্ধার হতে থাকে বিপুল পরিমান গোলা-বারুদ, অস্ত্র-শস্ত্র, তুমুল যুদ্ধর পর ধরা পড়েন বাংলা ভাই চক্র। ওই সরকারের সময় শীর্ষ জং্গি নেতাদের অসংখ্য হত্যা ও অস্ত্র মামলায় ফাসিতেঁ চড়ানো হয়। ফাঁস হয়ে পড়ে বিএনপি-জামায়াতের থলের বেড়াল।

আর বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার জঙ্গি তোষণ না করলেও মেৌলবাদ তোষণ করছেন, হেফাজতে ইসলামীর কাছে তারা পুরোপুরি আত্নসমর্পন করেছেন। এই মেৌলবাদী গোষ্ঠিই যে পরে জেহাদী শক্তিতে পরিনত হবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এরই মধ্যে চট্টগ্রামে হেফাজতের মাদ্রাসায় আবিস্কৃত হয়েছে বোমা তৈরির কারখানা। সেখানে বোমা বানানোর সময় দুর্ঘটনা বশত মারাত্নক বিস্ফোরণে দুই মাদ্রাসার ছাত্র গুরুতর আহত হয়েছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় ভবনের একাংশ উড়ে গেছে বলেও খবরে প্রকাশ।

তো এই অবস্থায় সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল সত্যিই খুব কঠিন বিষয়। আর সাধারণ মানুষ কতোই না অসহায়।...

সংশপ্তক: এবং এই প্রসঙ্গেই, বাংলাদেশের বর্তমান স্বাধীনতা কতটা সুরক্ষিত আজকে?

বিপ্লব রহমান: জংগিবাদ স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্বাস করে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশে তো নয়ই। তারা তালেবান শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। তাই তারা দেশকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান বানাতে চায়। এদের কাছে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা, নারী মুক্তি, আদিবাসী অধিকার, বিজ্ঞান মনস্কতা -- কোনোটিই নিরাপদ নয়। তবে আশার কথা, দেশের সাধারণ মানুষ জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী নন। তারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না। ধর্মকে মনে করেন ব্যক্তিগত আচারমাত্র। এটিকে বাজারিকরণে তারা মোটেই সাচ্ছন্দ বোধ করেন না। তাই জং্গিদের শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষই আইন-শৃং্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তুলে দেন।
 

সংশপ্তক: ভারতে বর্তমানে যে সাম্প্রদয়িক শক্তি ক্ষমতার কেন্দ্রে আসীন, তার প্রভাব বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে কতটা উৎসাহিত করবে বলে আপনার ধারণা?

বিপ্লব রহমান: ভারতে ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক মেৌলবাদী গোষ্ঠি যে এদেশেও একই রাজনীতি উস্কে দেবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। বরং চোরে চোরে মাসতুত ভাই হওয়াটিই স্বভাব ধর্ম। শোষন -শাসন টিকিয়ে রাখতেই মেৌলবাদী গোষ্ঠির দলভাড়ি করা প্রয়োজন। এ জন্য ভারতের হিন্দু মেৌলবাদ বাংলাদেশে ইসলামী মেৌলবাদকে সমর্থন যুগিয়ে চলবে, এ আর নতুন কি? শুভ চিন্তার মানুষের উচিৎ হবে দেশে দেশে সংগঠিত হয়ে যত্রতত্র এদের প্রতিহত করা, নির্মূল করা।
 

সংশপ্তক: বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের হাতে জাতির ভবিষ্যত অভিমুখ কোনদিকে বলে মনে করছেন?

বিপ্লব রহমান: বাংলাদেশ তৈরি পোষাক শিল্প, নারী শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি খাতসহ বিভিন্ন খাতে খুবই সম্ভাবনাময় একটি দেশ। গুটি কয়েক দুষ্টচক্রের হাতে এসব সম্ভাবনা নষ্ট হতে পারে না। দেশ যদি পথ হারাতে বসে প্রজন্ম '৭১ ই দিক-দর্শন হিসেবে কাজ করবে, এটিই সবচেয়ে আশার কথা। আরো আশার কথা, এরাই একদিন একে একে ব্যর্থ রাজনীতিক, দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারীকে উপড়ে ফেলবে, আগামীতে হাল ধরবে এরাই। ...আমি নিশ্চিত সেই সুন্দরের প্রতীক্ষায় আছি।

__
লিংক: http://songsoptokkblog.blogspot.com/2014/11/blog-post_58.html

No comments:

Post a Comment