‘এক আগুনে আম্মা, ভাই-বোনসহ পরিবারের ৯ জনকে হারাইছি। আছিল শুধু আব্বা। সেও গত মাসে রোড অ্যাকসিডেন্টে মরছে। এখন পরিবারে একমাত্র আমিই বাঁইচা আছি। আগুনে আমার পিঠ, দুই হাত, মুখ পুড়ছে। ডান হাতটা অচল হইয়া গেছে। এখনো সারা শরীলে ফোসকা। চিকিৎসার জন্য ম্যালা টাকা দরকার। আমার হাতটা যদি অপারেশন কইরা ভালো করা যাইত, যদি আবার ইস্কুলে যাইতে পারতাম...!’ অশ্রুসজল চোখে কথাগুলো বলছিল ফারজানা আক্তার (১৫)।
রাজধানীর পল্লবীর কালশীতে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে গত ১৪ জুন আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। অভিযোগ রয়েছে, বিহারি পল্লীবাসীকে উচ্ছেদ করে সম্পত্তি দখলের অসৎ উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিতভাবে ওই হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়। ভয়াবহ ওই আগুনে আহত হলেও ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যায় ফারজানা। কিন্তু সর্বনাশা ওই আগুন কেড়ে নেয় তার সব স্বজন। জীবন্ত পুড়ে মারা যান ওর মা বেবী বেগম, বড় বোন শাহানা আক্তার, বড় ভাই আশিক, মেজ বোন আফসানা, ভাবি শিখা, যমজ ছোট দুই ভাই লালু ও ভুলু, ছোট বোন রোকসানা ও ভাগ্নে মারুফ। আর ঘরের বাইরে থাকায় বেঁচে যান ফারজানার বাবা মো. ইয়াসিন।
স্থানীয় ইউসেপ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারজানা সবাইকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত কেবল বাবাকে অবলম্বন করেই বাঁচতে চেয়েছিল। আগুনে আহত হওয়ার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা শেষে সে ক্যাম্পে ফিরে আসে। কিন্তু গত ৬ সেপ্টেম্বর পল্লবীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মো. ইয়াসিন। সেলুন দোকানের কর্মচারী বাবা সেদিন মেয়েটির জন্য ওষুধ কিনতে যাচ্ছিলেন। আর এ ঘটনায় ফারজানা হারায় তার পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্যটিকে।
ফারজানার সঙ্গে কথা হয় গত মঙ্গলবার সকালে মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লার বিহারি ক্যাম্পের বস্তিতে। দুর্গন্ধময় বস্তিটিতে অসংখ্য সরু গলি। দুই পাশে সার সার এক কামরার ঘর। প্রতিটি ঘরে একটি করে বিহারি পরিবারের বাস। গলির নোংরা জল-কাদার ভেতরে এখানে-সেখানে উদোম গায়ে খেলছে কয়েকটি শিশু। ভেসে আসছে উর্দু ভাষায় সাংসারিক আলাপচারিতা আর কলরব। একের পর এক গলিপথ পেরিয়ে এ রকমই এক কামরার ঘুপচি ঘরে দেখা মেলে ফারজানার। সে এখন থাকে খালু মো. আসলামের (৪০) সঙ্গে। তিনি ধানমণ্ডিতে একটি সেলুনের দোকানে কাজ করেন। বস্তিঘরটিতেই স্কুলপড়ুয়া চার খালাতো ভাই-বোন, খালু-খালার সঙ্গে গাদাগাদি করে ফারজানার বাস। পিঠ আগুনে ঝলসে গেছে বলে জামা পড়ার উপায় নেই। তাই দেহটি কালো রঙের সুতি ওড়নায় ঢাকা। ওর পরিচর্যা করেন খালা শাহিদা বেগম। মাস চারেক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসার পর এখন ওই বাসায়ই কোনো রকমে চিকিৎসার চেষ্টা চলছে মেয়েটির। দেখা গেল, ঘরটির সামনে একচিলতে জায়গায় বড় চুলায় রান্না বসানো হয়েছে। আসলাম জানান, ফারজানার বাবার চল্লিশা উপলক্ষে এই সামান্য আয়োজন।
সেদিনের ঘটনা জানতে চাইলে কিশোরী মেয়েটি চোখ-মুখ কুঁচকে বেদনাহত স্বরে কালের কণ্ঠকে বলে, ‘শবেবরাতের রাইতে আমরা সবাই কোরআন শরিফ পড়তে ছিলাম। ভোর রাইতে ক্যাম্পের বাইরে কিছু পুলাপান পটকা ফোটায়। এ নিয়া পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-ধাওয়ি ও ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি হইতে থাকে। পুলিশ ক্যাম্পের ভিতর টিয়ার শেল মারে। পরে তারা বাইরে থিকা কিছু সন্ত্রাসীসহ ক্যাম্পের ভিতরে ঢোকে। অবস্থা খারাপ দেইখা আমরা সবাই ঘরের ভিতর আশ্রয় লই। এ সময় আমাগো ঘরে সন্ত্রাসীরা আগুন দেয়। কিন্তু বাইরে থিকা গেট লাগানো থাকায় আমরা কেউ বাইর হইতে পারতাছিলাম না। বাঁচার জন্য আমরা চিৎকার-চেঁচামেচি করতেছিলাম। আমি ঘরের এক কোণে পইড়া আছি। আমার কাপড়েও আগুন ধরছে। ওই অবস্থায় শরীলে আগুন নিয়া পুইড়া যাওয়া বেড়ার একটা ফাঁক দিয়া কিভাবে যে আমি বাইর হইছি কইতে পারি না। পরে আমার জ্ঞান হইছে ঢাকা মেডিক্যালে। ডাক্তাররা কইছে, আমার শরীলের ১৭ ভাগ পুইড়া গেছে।’
মেয়েটির বর্তমান অভিভাবক আসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সহায়তায় এত দিন ফারজানার চিকিৎসা চলেছে। কিন্তু বাসায় ফেরার পর চিকিৎসা পরিস্থিতি সঙ্গিন। তিনি বলেন, ‘আমরা ফারজানার উন্নত চিকিৎসা চাই। প্রতি মাসে ওর চিকিৎসা খরচ সাত-আট হাজার টাকা। ছোট এক টিউব মলমের দামই সাড়ে তিন হাজার টাকা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আগুনে পুড়ে অচল হয়ে যাওয়া ডান হাতটিতে জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করা প্রয়োজন। এ জন্য কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা দরকার। আর মেয়েটির জন্য দুধ-ডিমসহ পুষ্টিকর খাবারও প্রয়োজন। আমরা আত্মীয়স্বজন মিলে কোনো রকমে এত দিন সব কিছু করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সবাই অতি ছোট চাকুরে, নিতান্তই গরিব মানুষ। এখন আমরা একদম দিশেহারা। মা-বাবা, ভাই-বোনহীন অসহায় ফারজানার দায়িত্ব যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিতেন! তার পরিবারকে যারা এভাবে আগুনে পুড়িয়ে খুন করেছে, আমরা তারও বিচার চাই!’
ফিরে আসার সময় কিশোরীটি আগুনে পোড়া এক হাত দেখিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে, ‘ভাই, আমার কথা এট্টু ভালো কইরা লেইখেন। আমার ডান হাতটা যদি ভালো হয়, তাইলে আবার আমি লেখতে পারব। আমি অনেক লেখাপড়া করতে চাই। বড় হইয়া স্কুল মাস্টারি করতে চাই।’
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2014/10/18/140694#sthash.xkWQ2d1Q.PmnOucTM.dpuf
Read more at http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2014/10/18/140694#7zpxZd06CqY7lgmA.99
No comments:
Post a Comment