যতবারই দূর পাহাড়ে যাওয়া হয়, আদিবাসী পাহাড়ি জনপদের আনন্দ-হাসি-গান, দুঃখ-বেদনা, সীমাহীন নিপীড়ন ও সংগ্রামের ভেতরের অন্তর্দশন এবং তথ্য সাংবাদিকতার বাইরেও খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয় পাহাড়ি শিশুদের মনছবি।
গণহত্যা, যুদ্ধ, শান্তি, ভাতৃঘাতি সন্ত্রাস, সেনা-সেটেলার সহিংস আক্রমণ, এমন কী হালের আদিবাসী বিতর্ক-- এমন রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত পাহাড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বেড়ে ওঠা পাহাড়ি শিশু মনের প্রতিক্রিয়া কী, তা বুঝতে চেষ্টা করা হয়। জাতিগত নিস্পেষন ও হিংসার দাবনল দেখতে দেখতে এই সব শিশুও কি আগামী দিনে হিংসার আগুন বুকে নিয়েই বড় হচ্ছে? তারাও কি একদিন ফিরিয়ে দেবে পাল্টা প্রতিটি আঘাত?
বছর দেড়েক আগে খাগড়াছড়ির খবংপুইজ্জা গ্রামে নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়া হয় প্রথম যৌবনের এক বন্ধুর বাসায়। বিন্নি চালের ভাত, শশা খুর্বো,চোঙ মাছসহ নানান ধরণের ঐতিহ্যবাহি চাকমা ব্যঞ্জনের আয়োজন। তখনও দুপুর বেলার আযোজনটি শেষ হয়নি। তাই একাই গ্রামের পথে বেড়িয়ে পড়া গেল।
পথে দেখা এই একদল স্কুল ফেরতা ক্ষুদে শিক্ষার্থীর। তারা সকলেই স্থানীয় স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। সামান্য চাকমা ভাষা ভরসা করে আলাপ-চারিতায় জানা গেলো, প্রথম প্রথম বাংলা ভাষা বুঝতে না পারার কারণে স্কুলের পাঠে তাদের খুব কষ্ট হয়েছে। স্কুলে যেনো মার খেতে না হয়, এ জন্য বাসায় তাদের বাবা-মা প্রথমে পাঠের অংশটুকু বাংলা থেকে প্রথমে তাদের চাকমা ভাষায় বুঝিয়েছেন। পড়ে আবার তা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বুঝিয়েছেন। এভাবে বার বার পড়া বুঝে নিতে নিতে এখন তারা নিজেরাই পাঠ তৈরিতে অনেকটা পটু হয়ে পড়েছে।...
স্কুল ড্রেস বিহীন নাম বিস্তৃত ছোট্ট মেয়েটির কাছে আলাদা করে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সে বাংলা ভাষা কতোটা জানে? জবাবে মেয়েটি মাথা নীচু করে ভাঙা বাংলায় অস্ফুট স্বরে বলে, বাংলা ভাষা খুব কষ্ট!
পরে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-চারিতায় জানা গেল, পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সমতলের চেয়ে পাহাড়ে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার অনেক বেশী। এর একটি প্রধান কারণ, শিশু শিক্ষায় ভাষাগত বাধা। তবে এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি জরিপ চালানো হয়নি বলে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন।
রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, আদিবাসী শিশু বাসায় যে ভাষায় কথা বলছে, স্কুলে সে ভাষায় লেখাপড়া করছে না। বাংলা বুঝতে না পারার কারণে শিশুমনে পাঠ্যবই কোনো দাগ কাটছে না, স্কুলের পাঠ গ্রহণ করাও তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। …তাই আমরা অন্তত প্রাথমিক শিক্ষায় আদিবাসী শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের দাবি জানিয়ে আসছি। আমরা চাই, মাতৃভাষায় বর্ণপরিচয়, ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোট-খাট অংক, নিজ জাতির ও বাংলাদেশের ইতিহাস শিক্ষার পাশাপাশি যেনো আদিবাসী শিশু বাংলাতেও অন্যান্য পাঠগ্রহণ করতে পারে। এটি শিশুর মনোস্তাত্ত্বিক বিকাশের জন্যও জরুরি।
তিনি খানিকটা দুঃখ করেই বলেন, চার-পাঁচ দশক আগেও আদিবাসী ভাষা চর্চার এতোটা বেহাল দশা ছিলো না।…আমি ছোট-বেলায় দেখেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক গুরুজনই চাকমা ভাষায় নিজেদের মধ্যে চিঠিপত্র লেখালেখি করতেন। মারমা ভাষাতেও সে সময় লিখিতভাবে ব্যক্তিগত ভাববিনিময় ও লেখালেখি চলতো। কিন্তু প্রতিযোগিতার যুগে ব্যবহারিক উপযোগিতা না থাকায় এখন ওই চর্চাটুকুর সবই হারিয়ে গেছে।…
আদিবাসী শিশু শিক্ষা সম্পর্কে আরো জানতে যোগাযোগ করা হয় রাঙামাটির শিশু সদন 'মোনঘর' এর সহযোগি শিশু নিকেতন 'বনফুল' এর সাবেক শিক্ষিকা তন্দ্রা চাকমার সঙ্গে। তন্দ্রা দি নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, বনফুলে একবর দেখেছি, একটি ম্রো ছেলে কিছুতেই প্রথম শ্রেণীর শিক্ষায় বাংলা বর্ণমালা বুঝে বাক্য গঠন করতে পারছিল না। দিন দিন ছেলেটি তার অধিকাংশ চাকমা সহপাঠিদের চেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিল। ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে সে কিছুতেই পড়াশোনাই বুঝে উঠতে পারছিল না।
তিনি বলেন, পরে একটু উঁচু ক্লাসের একজন ম্রো ছাত্রের সন্ধান পেয়ে তার তত্বাবধনে দুর্বল ছাত্রটিকে দেওয়া হলে সে দ্রুত পড়ালেখায় ভাল করতে থাকে। আরো পরে সে খানিকটা চাকমা ভাষা শিখে ফেলে বলে তার বাংলা ভাষায় পাঠগ্রহণ কিছুটা সহজ হয়। ...পড়াশোনার জন্য ওই ছোট্ট ছেলেটিকে কি ভীষণ সংগ্রামই না করতে হয়েছে!
তন্দ্রা দি, দীর্ঘশ্বাস চেপে বলেন, তাই মাতৃভাষায় শিশু শিক্ষার বিকল্প তো হতে পারে না।... বুকের রক্ত দিয়ে এই দেশ ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে সারা বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ এ দেশেই ভাষাগত সংখ্যালঘু জাতিগুলোর মাতৃভাষা কি নির্মমভাবেই না ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে!...
___
ছবি: আদিবাসী শিক্ষার্থী, খবংপুইজ্জা, খাগড়াছড়ি এবং চাকমা বর্ণমালা, লেখক, উইকিপিডিয়া।
No comments:
Post a Comment