Monday, November 21, 2011

বাঙাল বিপ্লব লঙ্ঘিল গিরি...


বান্দরবানের দূর্গম পাহাড়ে ডিসেম্বরের ভোরে হীম বাতাসের কামড় ও ধোঁয়াশার দাপট খানিকটা কমে এলে সহযাত্রী সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমাসহ পরিকল্পনা করা হবে আরো দূর যাত্রার। 

সে দফায় বর্ষিয়ান বম গ্রাম প্রধান সাংলিয়ান কারবারী গাইড করবেন মেঘপুঞ্জিঁ ভেদ করে খাড়া উঠে যাওয়া ক্রেওক্রাডং পর্বত-লঙ্খন পর্বে। এর আগেই সাংবাদিক কাম অভিযাত্রীদ্বয় কাটিয়ে উঠবেন  বগা লেকের অপার বিস্ময়


যাত্রার প্রাক-প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে সঙ্গে থাকবে হালকা ঝোলা ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর জলের বোতল, টর্চ (হঠাৎ রাত্রিবাসের প্রয়োজনে), প্যারাসিটামল ট্যাবলেট, ওরস্যালাইন, ডেটল-ব্যাণ্ডেজ, কয়েক প্যাকেট বিস্কুট, এক ছড়া পাহাড়ি কলা, সিগারেট-ম্যাচ ইত্যাদি।

এর আগে দুজনায় কারবারীদার কিশোরি কন্যা ময় মহাজনের আপ্যায়নে শাপলা লতা-সিঁদোলের ঝোল তরকারি ও খানিকটা গরম ভাতে সেরে ফেলা হবে সকালের প্রাতঃরাশ। খাবারের ফাঁকে 'ময়' কথাটির অর্থ জানতে চাওয়ায় লাজুক কিশোরির চতুর উত্তর হবে এ রকম:
যখন আপনারা ক্রেওক্রাডং-এর চূড়ায় পৌঁছাবেন, তখনই জানতে পারবেন এই নামের অর্থ!


ক্রেওক্রাডং-এর খাড়া পাহাড় ভেঙে পায়ে চলা শুরু পথ ধরে বিচিত্র পথযাত্রায় মুগ্ধ হতে হবে চারপাশের সুনশান প্রাকৃতিক নিরবতায়। চারপাশে পাহাড়ের পরে পাহাড়, মেঘের পরে মেঘ, অরণ্যর পরে অরণ্য, সবুজের পর আরো সবুজ...যেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফি টেলিভিশন বা ডিসকভারি চ্যানেলের 'ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড'।


মাঝে মাঝে যাত্রা বিরতির ফাঁকে সাংলিয়ান দা' বলবেন পাহাড়ের ভয়াবহ 'ইঁদুর বন্যা'র কথা। বাঁশের পাকা বীজ খেয়ে বেড়ে যায় পাহাড়ি ধেড়ে ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা, দ্রুত বংশ বিস্তার ঘটে বাহিনীর। এরপর বন্যার পানির মতো ধেয়ে আসা ইঁদুরের ঝাঁক পাহাড় জুড়ে আক্রমণ চালায় জুম ফসলের ক্ষেতে। নিমেষে ইঁদুর-উদর পূর্তিতে শুন্য হয় সাজানো বাগান। পাহাড় জুড়ে দেখা দেয় নিরব দুর্ভিক্ষ, হাহাকার। ...চাকমা ভাষায় এরই নাম 'ইঁদুর বন্যা', বম ভাষায় 'মাওথাম'।


পথের দুপাশের বনে বিমোহিত করে রাখা বুনো ফুলের ঝাঁক; চমক ভেঙে ফেলবে নির্ঘাত হঠাৎ দেখা ও কুশল বিনিময় একদল জুম চাষীর কথায়। তারা সকলেই সাংলিয়ান কারবারী দা'র আত্নীয়-স্বজন। নিকট পাহাড়ের জুম চাষী এইসব নারী-পুরুষ সর্বসান্ত হয়ে এখন দল বেঁধে পাড়ি জমিয়েছেন রুমা বাজারের উদ্দেশ্য-- যদি দিন-মজুরির কোনো একটা কাজ জুটে যায়!
 


চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে বুদ্ধ বা এই লেখক-- কারো মুখে আর বাক্য সরে না। ...

বিশাল বড় বড় বোল্ডারে ঘেরা জল কলকল উচ্ছল এক পাহাড়ি ঝর্ণার পাশে বসে বিস্কুট-কলা খেয়ে জলের বোতল ভরে নেওয়া হবে সত্যিকারের মিনারেল ওয়াটারে। এরপর অভিযাত্রী দ্বয় ধূমপানের ফাঁকে কারবারী দা'র কাছে শুনবেন এক আশ্চর্য গেরিলা নেতার নাম -- লাল ডেঙ্গা।

ক্রেওক্রাডং-এর কখনো সাবেক গেরিলা দল শান্তিবাহিনী ছিল না, এ কথা জানিয়ে স্মৃতি হাতড়ে সাংলিয়ান দা’ বলেন:

আমাদের এখানে শান্তিবাহিনী কখনো স্থায়ীভাবে ছিলো না। তবে এখানে তাদের যাতায়ত ছিলো। আমাদের এখানে অনেক বছর ছিলো মিজো বাহিনী। কেওক্রাডং এর এই পথটি ধরেই মিজো নেতা লাল ডেঙা চলাচল করতেন।
কেমন দেখতে ছিলেন উনি? — শিশুসুলভ এমন কৌতুহলের জবাবে তিনি বলে চলেন:
লাল ডেঙা ছিলেন খুব লম্বা – চওড়া বলশালী মানুষ। বয়স প্রায় ৫০ বছর। পরনে সাদা শাট আর নীল প্যান্ট। সব সময় ওনার নিরাপত্তায় থাকতো ৫০ – ৬০ জনের একটি গেরিলা বাহিনী। ওদের পরনে ছিলো পাতা – সবুজ পোষাক। নানা রকম ভাড়ি অস্ত্র – শস্ত্র সবার হাতে হাতে। মিজো দলে অনেক মহিলা যোদ্ধাও ছিলো। কিন্তু মিজো বাহিনী খুব খারাপ।…
কেনো? তার উত্তর:
১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মিজো বাহিনী আমাদের এখানে ছিলো। তারা দিনের পর দিন আমাদের গ্রামে আস্তানা গেড়ে বাস করতো। আমরা তাদের খাওয়াতাম, আবার চাঁদার টাকাও দিতাম। তাদের ছাগল, মুরগী, শুকর কেটে ভাত দিতে হতো। আমাদের কোনো মেয়েকে তাদের পছন্দ হলে জোর করে ওরা বিয়ে করতো। আমাদের দিয়ে ওরা এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে বিনে পয়সায় বোঝা টানাতো।

একবার আমাদের গ্রামের একজন বম মেয়েকে মিজো বাহিনী বিয়ে করে ওপারে মিজোরামে নিয়ে যেতে চায়। আমি বাধা দিলে ওরা আমাদের তিনজনকে গুলি করে মারার জন্য এক সারিতে দাঁড় করিয়েছিলো। পাহাড় – জঙ্গল ভেঙে আমরা দৌড়ে পালিয়ে সেবার বাঁচি।

...আমি শুনেছি, মিজোরাম দেশটি নাকি খুব সুন্দর। মিজো বাহিনী জয়লাভের পর ওখানে নাকি এখন খুব শান্তি। জিনিষপত্রের দাম খুব শস্তা, জুম করা যায়, ঘন বনে শিকারও মেলে প্রচুর। কিন্তু আমি কখনো মিজেরামে যাবো না। মিজো বাহিনী খুব খারাপ।…

সাংবাদিকরা জানতে চান, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সঙ্গে মিজো বাহিনীর কখনো বন্দুক যুদ্ধ হয়নি? সাংলিয়ান দা বলেন:

আরে না! পাকিস্তান আর্মি আর বাংলাদেশ আর্মিই তো মিজো বাহিনীকে এপাড়ে আশ্রয় দিয়েছে। ওরা মিলেমিশে থাকতো। কেউ কাউকে ঘাঁটাতো না। মাঝে মাঝে এ – ওর ক্যাম্পে বসে চা – বিস্কুটও খেতো!…





পরে ইতিহাস ঘেঁটে জানা যাবে, পাক সেনারা ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনী দমনে লাল ডেঙ্গার মিজো বাহিনীকে ব্যবহার করেছিল! সে আরেক ইতিহাস।

এই সব আলাপ-চারিতা শেষে পাহাড়ের পর খাড়া পাহাড় ডিঙিয়ে ক্রেওক্রাডং-এর চূড়ায় উঠে যাওয়ারকালে কথা হবে কিশোর মুদি দোকানী সাহিত বম-এর সঙ্গে দার্জিলিং পাড়া নামক গ্রামে। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সব্জি-ভাতের ব্যবস্থা হবে দুপুরের আহার হিসেবে।

আরো পরে একদল হাসিখুশী বম শিশু-কিশোর অভিযাত্রীদের অভ্যর্থনা জানাবে ক্রেওক্রাডং-এর চূড়ায়। বড়দিনের প্রস্তুতি হিসেবে গিটার বাজিয়ে গান চর্চার ফাঁকে তারা ঝটপট আগুন জ্বেলে চূলা বানিয়ে তৈরি করবে লাল চা। খুব মিষ্টি সেই চা তারা পরিবেশন করবে কাঁচা বাঁশের চোঙ দিয়ে বানানো কাপে। ...



ক্রেওক্রাডং-এর সিঁড়িতে শিশু-কিশোরের দল স্মার্টলি বসে পোজও দেবে ছবির জন্য। পর্বত শিখরে বুদ্ধ-সাংলিয়ান দা'র যখন পৃথক ছবি তোলা হবে, তখন পাতলা কুয়াশার মতো হঠাৎ মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে পোষাক-আশাক, চশমার কাঁচ, খানিকটা চেতনা ও সর্বস্ব। দূরের তাজিনডং পর্বত শিখর দেখে মনে পড়বে কাজী নজরুল: 

আকাশে হেলান দিয়ে
পাহাড় ঘুমায় ওই...

___

ছবি  (c) : [ক্রমানুসারে] বগা লেক, ক্রেওক্রাডং-এর চূড়া,  জুম চাষের মোনঘর (মাচাং ঘর),পাহাড়ের পথে বুনো ফুলের ঝাঁক, ক্রেওক্রাডং এর সিঁড়িতে হাসিখুশী বম শিশুর দল, বুদ্ধজ্যোতি ও লেখক।

No comments:

Post a Comment