তখনো বালক বেলা একেবারের ছেড়ে যায়নি, নবম কি দশম শ্রেণীতেই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অন্যপাঠ সর্ম্পকে আগ্রহ জন্মে। এ কারণে ১০ জানুয়ারি, ২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ, ২৫ মার্চ, ৭ নভেম্বর, ১৪ ডিসেম্বর, ১৬ ডিসেম্বর -- ইত্যাদি বিশেষ দিবসের কাগজগুলোর নিবিড় পাঠ করা হতো।
সে সময়ই নজরে আসে সাদা-কালো সংবাদপত্রের যুগে ঐতিহাসিক কিছু সাদাকালো ছবি, এর সব কয়েকটির আলোকচিত্রী ছিলেন রশীদ তালুকদার।
স্মরণ করা ভালো, একুশে ফ্রেব্রুয়ারিতে ইত্তেফাকের একটি লিড ফাইল ফটোতে দেখা হয়েছিল ১৯৭১ এর অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশের বেদনা বিধুর শহীদ মিনার। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ-লাইটে কামানের গোলায় পাকিস্তানি সেনারা গুড়িয়ে দিয়েছিল শহীদ মিনার। সে সময় ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করার জন্য ছাত্ররা একই স্থানে ইট দিয়ে ছোট্ট একটি স্তম্ভ নির্মাণ করে একটু কাগজে আঁকাবাঁকা হরফে 'শহীদ মিনার' লিখে স্তম্ভের গায়ে সেঁটে দিয়েছিল। ১৯৭১ এ সেখানেই শ্রদ্ধার্ঘ দিয়েছিল নিস্পেষিত, বিক্ষুব্ধ বাঙালি।
আবার ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের আরেক লিড ছবি ও ফাইল ফটোতে দেখা যায়, পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর ট্যাংঙ্ক হামলায় বিধ্বস্ত টিকাটুলির ইত্তেফাক ভবন। এই ছবিটির আলোকচিত্রীও ছিলেন রশীদ তালুকদার। অবশ্য সে সময় ২৫ মার্চের গণহত্যার ফাইল-ফটো নিয়ে যে একপাতার ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হতো, সেখানে তার তোলা বিধ্বস্ত প্রেসক্লাব ভবন থেকে শুরু করে হত্যাযজ্ঞের মর্মান্তিক একাধিক ছবিও স্থান পেতে।
৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যূত্থান দিবসে তার তোলা ইত্তেফাকের আরেকটি লিড ও ফাইল ফটো ছিল অনেকটা এ রকম, ওই ছবিতে দেখা যায়, একটি খোলা সামরিক ট্রাকে করে বিদ্রোহী সৈনিকরা অস্ত্র উঁচিয়ে কয়েকজন উর্দ্ধতন সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছেন, গ্রেফতারকৃতরা ট্রাকে হাঁটু মুড়ে বসে আছেন, তাদের প্রত্যেকের মুখ ও মাথা কাপড় দিয়ে ঢাকা। আর বিদ্রোহী সৈনিকরা ট্রাকটিতে দাঁড়িয়ে...তাদের চোখে-মুখে বিজয়ের উল্লাস।
আবার রশীদ তালুকদারের ৭ নভেম্বরের আরেকটি ফাইল ফটো ছিল এ রকম, বিদ্রোহী সৈনিকদের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান কালো রোদ চশমা পরে হাত উঁচিয়ে জনতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, তাকে ঘিরে রেখেছেন সামরিক-বেসামরিক বিদ্রোহীরা, পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে জিয়ার মাথায়।
আর ১৬ ডিসেম্বরের অনিবার্য ছবি ছিলো, খোলা ট্রাকে করে ফাঁকা গুলি ফোটাতে ফোটাতে বীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় প্রবেশ করছেন, তাদের অভিনন্দন জানাতে ট্রাকের পিছু নিয়েছে সদ্য স্বাধীন দেশের উল্লসিত মুক্তিকামী জনতার একাংশ।
আসলে ওই ঐতিহাসিক ছবিগুলো ছাড়াই এমনি করে ছবির পাঠ হয়তো খানিকটা অস্পষ্টতাই বাড়িয়ে দেয়। তবে ব্লগাড্ডার এই পর্বে এইটুকু নাম ভূমিকার হয়তো দরকারি; আর ওই ছবিগুলোর যখন অন্তর্জাল সংস্করণই নেই। এর বাইরে এই লেখায় প্রদর্শিত ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, ৭ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসমূদ্রে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রায়ের বাজার বধ্যভূমির দৃশ্য, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের কালে ডামি রাইফেল নিয়ে ঢাকার রাজপথে ছাত্রীদের মার্চপাস্টসহ ১৯৭১ এর আরো অসংখ্য ছবি তো ছিলই।
আর ১৬ ডিসেম্বরের অনিবার্য ছবি ছিলো, খোলা ট্রাকে করে ফাঁকা গুলি ফোটাতে ফোটাতে বীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় প্রবেশ করছেন, তাদের অভিনন্দন জানাতে ট্রাকের পিছু নিয়েছে সদ্য স্বাধীন দেশের উল্লসিত মুক্তিকামী জনতার একাংশ।
আসলে ওই ঐতিহাসিক ছবিগুলো ছাড়াই এমনি করে ছবির পাঠ হয়তো খানিকটা অস্পষ্টতাই বাড়িয়ে দেয়। তবে ব্লগাড্ডার এই পর্বে এইটুকু নাম ভূমিকার হয়তো দরকারি; আর ওই ছবিগুলোর যখন অন্তর্জাল সংস্করণই নেই। এর বাইরে এই লেখায় প্রদর্শিত ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, ৭ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসমূদ্রে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রায়ের বাজার বধ্যভূমির দৃশ্য, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের কালে ডামি রাইফেল নিয়ে ঢাকার রাজপথে ছাত্রীদের মার্চপাস্টসহ ১৯৭১ এর আরো অসংখ্য ছবি তো ছিলই।
তবে এই লেখককে চমকে দিয়েছিল, সব ছবি ছাপিয়ে ছিল এই লেখার সূচনা ছবিটি। সেখানে দেখা যায়, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানেরকালে ঢাকার রাজপথে বের হয়েছে ছাত্র-জনতার এক বিশাল মিছিল। সেখানে খালি গায়ে, খালি পায়ে একটি ঢোলা হাফট্যান্ট পরা এক টোকাই বালক ডান হাত উঁচিয়ে জোর শ্লোগান দিচ্ছে, তার জামাটি গুটিয়ে কোমড়ে বাঁধা।...
আটের দশকে ছাত্র অবস্থাতেই প্রচ্ছদ ছবি হিসেবে ওই ছবিসহ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত এক ফটো-অ্যালবাম লেখকের হাতে আসে। সেখানে শুধু আলোকচিত্রী হিসেবে রশীদ তালুকদারের নামটুকু ছাড়া তেমন কোনো তথ্য না থাকায় ছবিটি আরো কৌতুহল আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আরো পরে ছাত্র জীবন শেষে তথ্য সাংবাদিকতার পেশাগত সূত্রে ২০০২ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে কর্মরত অবস্থায় খবর পাওয়া গিয়েছিল, পুরনো ঢাকায় একটি শিশুর লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের। ওই খবর সংগ্রহ শেষে পুলিশের ভাষ্য নিতে যাওয়া হয়েছিল কোতয়ালী থানায়। ব্রিটিশ আমলের থানা ভবনটিতে বসে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার (ওসি)ভাষ্য নেওয়ার কালে সেখানে এসে উপস্থিত হন আরেক সহকর্মি কাজী হাফিজ, তিনি তখন দৈনিক মানবজমিনে কাজ করতেন, এখন কালের কণ্ঠে একই সঙ্গে কর্মরত। দুপুর গড়িয়ে আসছে প্রায়।
আটের দশকে ছাত্র অবস্থাতেই প্রচ্ছদ ছবি হিসেবে ওই ছবিসহ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত এক ফটো-অ্যালবাম লেখকের হাতে আসে। সেখানে শুধু আলোকচিত্রী হিসেবে রশীদ তালুকদারের নামটুকু ছাড়া তেমন কোনো তথ্য না থাকায় ছবিটি আরো কৌতুহল আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আরো পরে ছাত্র জীবন শেষে তথ্য সাংবাদিকতার পেশাগত সূত্রে ২০০২ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে কর্মরত অবস্থায় খবর পাওয়া গিয়েছিল, পুরনো ঢাকায় একটি শিশুর লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের। ওই খবর সংগ্রহ শেষে পুলিশের ভাষ্য নিতে যাওয়া হয়েছিল কোতয়ালী থানায়। ব্রিটিশ আমলের থানা ভবনটিতে বসে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার (ওসি)ভাষ্য নেওয়ার কালে সেখানে এসে উপস্থিত হন আরেক সহকর্মি কাজী হাফিজ, তিনি তখন দৈনিক মানবজমিনে কাজ করতেন, এখন কালের কণ্ঠে একই সঙ্গে কর্মরত। দুপুর গড়িয়ে আসছে প্রায়।
এই সময় বড় ফ্রেমের চশমা পরা, কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ ঝুলিয়ে খুবই সাদাসিধে পোষাকের একজন ফটো-সাংবাদিক এসে ওসির রুমে প্রবেশ করেন। রিপোর্টার দুজনই একসঙ্গে চমকে উঠেন-- ইনি রশীদ তালুকদার!
দ্রুত সালাম দিয়ে তাকে চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হয়, ওসির সঙ্গে ওনার পরিচয় করিয়ে দিতে পুলিশ কর্মকর্তা নিজেও তটস্থ হয়ে ওঠেন: স্যার, বলুন, আপনার কী খেদমত করতে পারি। আপনি কী লাঞ্চ করেছেন? আপনার জন্য আমাদের পুরনো ঢাকার বিখ্যাত বিরিয়ানি আনতে বলি?
রশীদ ভাই মৃদু হেসে তাকে নিবৃত্ত করেন। বিনয় করে রিপোর্টার দুজনকে বলেন, আপনারা কাজ শেষ করুন প্লিজ। আমি আপনাদের কাজে ব্যঘাত ঘটাতে চাই না।
ততক্ষণে সরকারি চা এসে গেছে। ওসির সঙ্গে আলাপ-চারিতার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ খেয়াল করা হয়, থানার ওই ছোট্ট ঘরের ভেতরেই মুক্তিযোদ্ধা আলোকচিত্রীর মটরস্পিডের এনালগ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠছে বার বার। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে বোঝা যায়, রশীদ ভাইয়ের ছবির বিষয় থানার দেওয়ালের একদিন জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে পড়া বট-পাকুড় গাছের শেকড়ের বিচিত্র নকশা। পুরনো থানা ভবনটির ছাদে তখন জন্মেছিল ওইসব গাছ, এর শেকড় ইট-সিমেন্ট ভেদ করে থানার দেওয়াল দখল করে ফেলেছিল।
সহকর্মী হাফিজ ভাই কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন, দেখলেন তো রশীদ তালুকদারের চোখ! আমরা এতোক্ষণ ধরে থানায় বসে আছি, অথচ বিষয়টি এতোক্ষণ খেয়ালই করিনি!
এই ফাঁকে বেশ খানিকটা বিচলিত ওসি বলে চলেছেন, পুরনো ভবনটির নানা দুরাবস্থার কথা। সামান্য বৃষ্টিতেই থানার ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে, নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ওপর মহলে অনেক লেখালেখি করেও ফল হয়নি-- ইত্যাদি।
এর আগে '৯০ এর ছাত্র-গণআন্দোলনে লেখক নিজেও জড়িয়ে পড়লে এরশাদ বিরোধী একের পর এক হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও -- ইত্যাদি রাজপথের কর্মসূচিতে রশীদ তালুকদারের ক্যামেরাবাজি চোখে পড়েছে। পরে নিজস্ব সাংবাদিকতার জীবনেও প্রেস ক্লাবে তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কুশল বিনিময় হয়েছে, তবে সামনা-সামনি গুনিজনকে একান্তে পাওয়া ওই প্রথম। সুযোগটিকে কাজে লাগাতে হঠাৎ আলাপের মোড় ঘুরিয়ে জানতে চাওয়া হয়, ১৯৬৯ এর বিদ্রোহী টোকাই ছবিটির ইতিবৃত্ত। ...
রশীদ ভাই সে সময় সামান্য হেসে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যা বলেছিলেন, তা অনেকটা এরকম:
রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে সেই শেষ বারের মতো একান্তে আলাপ। এরপর তার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার দেখা হলেও কুশল বিনিময় ও হ্যান্ডশেক ছাড়া আর তেমন কথা হয়নি।
আজ যখন এই মহান ইতিহাসের বিদায় বেলায় তারই স্মৃতিকথা বলা হচ্ছে, তখন গভীর বেদনা ভাড়ি হয়ে আসছে বুক। শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসছে মাথা। রশীদ তালুকদার, আপনি সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করুন।।
___
দ্রুত সালাম দিয়ে তাকে চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হয়, ওসির সঙ্গে ওনার পরিচয় করিয়ে দিতে পুলিশ কর্মকর্তা নিজেও তটস্থ হয়ে ওঠেন: স্যার, বলুন, আপনার কী খেদমত করতে পারি। আপনি কী লাঞ্চ করেছেন? আপনার জন্য আমাদের পুরনো ঢাকার বিখ্যাত বিরিয়ানি আনতে বলি?
রশীদ ভাই মৃদু হেসে তাকে নিবৃত্ত করেন। বিনয় করে রিপোর্টার দুজনকে বলেন, আপনারা কাজ শেষ করুন প্লিজ। আমি আপনাদের কাজে ব্যঘাত ঘটাতে চাই না।
ততক্ষণে সরকারি চা এসে গেছে। ওসির সঙ্গে আলাপ-চারিতার শেষ পর্যায়ে হঠাৎ খেয়াল করা হয়, থানার ওই ছোট্ট ঘরের ভেতরেই মুক্তিযোদ্ধা আলোকচিত্রীর মটরস্পিডের এনালগ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠছে বার বার। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে বোঝা যায়, রশীদ ভাইয়ের ছবির বিষয় থানার দেওয়ালের একদিন জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে পড়া বট-পাকুড় গাছের শেকড়ের বিচিত্র নকশা। পুরনো থানা ভবনটির ছাদে তখন জন্মেছিল ওইসব গাছ, এর শেকড় ইট-সিমেন্ট ভেদ করে থানার দেওয়াল দখল করে ফেলেছিল।
সহকর্মী হাফিজ ভাই কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন, দেখলেন তো রশীদ তালুকদারের চোখ! আমরা এতোক্ষণ ধরে থানায় বসে আছি, অথচ বিষয়টি এতোক্ষণ খেয়ালই করিনি!
এই ফাঁকে বেশ খানিকটা বিচলিত ওসি বলে চলেছেন, পুরনো ভবনটির নানা দুরাবস্থার কথা। সামান্য বৃষ্টিতেই থানার ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে, নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ওপর মহলে অনেক লেখালেখি করেও ফল হয়নি-- ইত্যাদি।
এর আগে '৯০ এর ছাত্র-গণআন্দোলনে লেখক নিজেও জড়িয়ে পড়লে এরশাদ বিরোধী একের পর এক হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও -- ইত্যাদি রাজপথের কর্মসূচিতে রশীদ তালুকদারের ক্যামেরাবাজি চোখে পড়েছে। পরে নিজস্ব সাংবাদিকতার জীবনেও প্রেস ক্লাবে তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কুশল বিনিময় হয়েছে, তবে সামনা-সামনি গুনিজনকে একান্তে পাওয়া ওই প্রথম। সুযোগটিকে কাজে লাগাতে হঠাৎ আলাপের মোড় ঘুরিয়ে জানতে চাওয়া হয়, ১৯৬৯ এর বিদ্রোহী টোকাই ছবিটির ইতিবৃত্ত। ...
রশীদ ভাই সে সময় সামান্য হেসে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যা বলেছিলেন, তা অনেকটা এরকম:
তখন তো ঢাকা জুড়ে প্রতিদিনই বিশাল সব মিছিল-মিটিং হচ্ছে। শ্লোগান উঠেছে: ছাত্র-জনতা ভাই, ভাই/ আইয়ুব শাহীর রক্ষা নাই! ছাত্রমিছিলগুলোতে শ্রমিক, কর্মচারি, পেশাজীবী নানা মানুষ নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। পুলিশ-ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, সীমান্তরক্ষি আধা-সামরিক বাহিনী) এখানে-সেখানে গুলি চালাচ্ছে। ২০ জানুয়ারি ছাত্র নেতা আসাদ গুলিতে শহীদ হওয়ার পর ঢাকাসহ পুরো দেশ বিক্ষোভে একেবারে ফেটে পড়েছে। ...
এরকমই একদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-জনতার বিশাল একটি মিছিল রাজপথে বের হয়েছে। মিছিলটি নীলক্ষেত হয়ে ঢাকা কলেজের দিকে যাচ্ছে। আমি মিছিলের সামনে থেকে একের পর এক ছবি তুলছি। কিন্তু আমরা সঙ্গে ওয়াইড লেন্স না থাকায় মিছিলের সামনের চওড়া সারিটি কিছুতেই একই ফ্রেমে আসছিল না। মিছিলটি বলাকা বিল্ডিং (বলাকা সিনেমা হল) ছাড়িয়ে আরেকটু সামনে আসতে, এখন যেখানে ওভার ব্রিজ হয়েছে (গাউছিয়া মার্কেটের সামনে) সেখানে দেখি কোথা থেকে একজন টোকাই মিছিলের আগে আগে যাচ্ছে। সেও মিছিলের সঙ্গে হাত উঁচিয়ে খুব শ্লোগান দিচ্ছে।
ওয়াইড লেন্সের অভাব পূরণ করতে আমি মিছিলের সামনের সারিটি বেশ কয়েকটি ফ্রেমে ক্যামেরা বন্দি করতে থাকি। আমার চিন্তা ছিল, পরে সবগুলো ছবি জোড়া দিয়ে একটি পুরো ছবি তৈরি করবো যেখানে মিছিলের সবটাই ধরা পড়বে।...
হঠাৎ সেখানে ওত পেতে থাকা পুলিশ-ইপিআর একসঙ্গে গুলি করতে শুরু করলো। আমি ছবি তোলার পর পরই দেখি গুলিতে টোকাই শিশুটি ছিটকে পড়লো। সবাই প্রাণ বাঁচাতে ছুটোছুটি শুরু করে দিল। আমিও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দৌড় লাগালাম। পরে জেনেছি, পুলিশের গুলিতে শিশুটি ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ...
রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে সেই শেষ বারের মতো একান্তে আলাপ। এরপর তার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার দেখা হলেও কুশল বিনিময় ও হ্যান্ডশেক ছাড়া আর তেমন কথা হয়নি।
আজ যখন এই মহান ইতিহাসের বিদায় বেলায় তারই স্মৃতিকথা বলা হচ্ছে, তখন গভীর বেদনা ভাড়ি হয়ে আসছে বুক। শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসছে মাথা। রশীদ তালুকদার, আপনি সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করুন।।
___
ছবি: ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থান, রশীদ তালুকদার, আন্তর্জাল।
No comments:
Post a Comment