আমার বন্ধু উমা কথাবার্তায় খুব চৌকশ, দেখতে সুন্দর, আর খুব হাসিখুশী। ও একটা লিটল ম্যাগাজিন চালাতো। সেই সুবাদে পরিচয়। একদিন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দূর্গা পূজার মেলায় উমাকে দেখি এক যুবকের হাত ধরে ঘুরতে। ও আমাকে দেখে ডেকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়। বলেন, আমার বন্ধু, পেশায় লেখক।
আমি ভাবলাম, দুজনেরই যখন লেখালেখির প্রতি এতো ঝোঁক, তাহলে ওদের মানাবে ভালই। উমার লেখক বন্ধু চাপ দাড়িতে সুদর্শন।
ছাত্র অবস্থায় শাহবাগের 'সিনোরিটা'য় চায়ের নিয়মিত আড্ডা ছিলো। এক পড়ন্ত বিকালে কী মনে করে যেনো সিনোরিটায় ঢুকে যাই। দেখি উমা আর তার লেখক বন্ধু। দুজনেই খুব বিষন্ন, ঝড়ো বিদ্ধস্ত। আমি কথা বাড়াই না। দ্রুত চা শেষ করে উঠে পড়ি। বুঝি, এখন ওদের একান্ত সময় প্রয়োজন।
শুনতে পাই, উমা পুরনো ঢাকায় একটা কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। পরিবারের অমতে বিয়ে করেছেন ওর সেই লেখককে। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন স্বামীর ঘরে। ওর লিটল ম্যাগাজিনটা উঠে গেছে অনেক আগে -- ইত্যাদি ইত্যাদি।
*
আরেকদিন বসুন্ধরা শপিং মলের সামনে উমার সঙ্গে দেখা। ও আমাকে দেখে চমকে যায়।
আমি জিগেষ করি, কেমন আছেন? উমা খুব বিষন্ন গলায় বলেন, ভালো। চোখের কোনায় জ্বলে উঠে অশ্রু কনা।
আমার অনুরোধে সে বসুন্ধরার টপফ্লোরে কফি শপে বসেন। ধুমায়িত কফির কাপ ঠান্ডা হতে থাকে।... উমা নিশ্চুপ।
এক সময় নিজে থেকেই বলতে শুরু করেন, ওর প্রেম, বিয়ে, সংসারের কথা। বলেন, বাবা - মার অমতে বিয়ে করে স্বামীর ঘরে এসে বুঝলাম, ওর কোনো নির্দিষ্ট আয় নেই। পত্র - পত্রিকায় লেখালেখি করে দু'চার হাজার টাকার অনিয়মিত রোজগারই ওর ভরসা। অথচ বিয়ের আগে আমাকে বলেছিলো, ও একটা বিখ্যাত দৈনিকে চাকরী করে! এখন সব জেনেও আমি সবকিছু মেনে নিয়েছি, কারণ আমার তো চাকরী আছে। ... এরপর ও কোনো রকম নিরোধক ছাড়াই আদর করতো। আর গর্ভবতী হলে আমার বাচ্চাকে নষ্ট করতে চাপ দিতে শুরু করে। খুব মানসিক চাপের মধ্যে আমি প্রথম বাচ্চাটিকে নষ্ট করি। পরের বার আবারো একই রকম চাপ আসলে আমি রুখে দাঁড়াই। আর না, এবার আমি বাচ্চাটাকে বাঁচাবোই।...
তো এর পর আমার লেখক স্বামী শুরু করে, আরেক অত্যাচার। কথায় কথায় বলে, তোমাকে বিয়ে করে কী পেলাম বলতো? পারিবারিকভাবে বিয়ে হলে আমি কতো টাকা যৌতুক পেতাম! আর ও বাড়িতেও ফেরে না ঠিকমত। প্রায়ই মোবাইলে ফোন করলে দেখি ফোন বন্ধ। হঠাৎ হঠাৎ আবার নিজেই ফোন করে বলবে, এই শোনো, আমি এখন ফরিদপুর। একটা সাহিত্য সম্মেলনে এসেছি। আমার ফিরতে দেরী হবে।...
*
উমা বসুন্ধরার কফি শপ, চারপাশের ঝাঁ চকচকে পরিবেশ, সব কিছু ভুলে গিয়ে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়েন। আমি তাকে থামাই না।
একটু পরে বলি, বাবা-মার কাছে ফিরলে হয় না?
উমা বলেন, এখন সেখানেই উঠেছি। কারণ বাচ্চাটার জন্যই আমাকে এখন বাঁচতে হবে; আর সে জন্য আমার পারিবারিক যত্ন প্রয়োজন।
-- বাড়ির সবাই সবকিছু মেনে নিয়েছে তো?
-- বিপ্লব, বাবা-মা আসলে কখনোই ছেলেমেয়েদের ফেলে দেন না। আমি মা হতে চলেছি, তাই এই সব এখন আমি খুব ভাল বুঝি। শুধু আমার সব কথা শুনে ঠাকুমা একটাই কথা বলেছেন, উমা রে, তুই এখন গর্তে পড়েছিস!....
*
এর বেশ কিছুদিন পরে আমার সাবেক কর্মস্থলের কেন্টিনে চা খেতে খেতে আলাপ করছিলেন সাহিত্য পাতার কয়েকজন সাংবাদিক-লেখক। আমি চুপ করে শুনছিলাম তাদের কথা।
একজন বললেন, তার শিশুর নাম রাখবেন, চর্যা। আরেকজন বললেন, এই নাম তো রাখা হয়ে গেছে। অমুক লেখক (উমার স্বামী) তার মেয়ের নাম রেখেছে, চর্যা।
এইভাবে আমি অকস্মাৎ উমার সন্তানের খবর পেয়ে যাই।
*
এরপর অনেকদিন উমাকে দেখি না। এখনো যেনো চোখ বুজলে দেখতে পাই, আগের সেই লিটল ম্যাগাজিন করা হাসিখুশী উমার মুখ। আমাকে দেখলেই বলে উঠবেন, এই বিপ্লব, এই...জলদি জলদি কিছু চাঁদা ছাড়ুন তো। আমাদের পত্রিকা বেরুবে শিগগিরই!...
*
এই লেখাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হঠাৎ সেদিন আবার উমার সঙ্গে দেখা। ১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা উৎসবের সংবাদ সংগ্রহ করে ধানমণ্ডির বাস ধরে অফিসে ফিরছি, বাসে একেবারে পেছনের সারি থেকে উমা আমাকে ডাকেন, বিপ্লব, এই বিপ্লব, এই যে এ দিকে...।
আমি ওর পাশের ফাঁকা সিটটিতে বসে পড়ি। মনে মনে চমকে যাই, একি চেহারা হয়েছে ওর! ঠিক যেনো একটি বাসি গোলাপ, যার পাঁপড়ি এখন খসে পড়ছে একে একে।...
এক নিঃশ্বাসে উমা নিজের খবর জানিয়ে বলেন, বিপ্লব, আমি এখনো মা - বাবার সঙ্গে আছি। আমার কন্যার বয়স এবার তিন বছর হলো। ওকে স্কুলের প্লে গ্রুপে দিয়েছি। আমার মাই ওর দেখাশুনা করেন। আমি মন দিয়ে মাস্টারি করছি। আমাদের বন্ধু - বান্ধবের সম্পাদনায় এবার বই মেলায় একটি সম্পাদিত ছোটগল্পের বই বেরুচ্ছে।...
--আর দাদাবাবু?
-- ওই আর কি!
উমা এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনার সঙ্গে দেখা হয় না?
-- মাঝে মাঝে দেখা হয়, আমি কথা বলার আগ্রহ পাই না। তার দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল আর সেই বিখ্যাত ভুবন ভোলানো হাসি, সহজে কি এড়ানো যায়!...
____________
ছবি: কামরুল হাসান।
No comments:
Post a Comment