উতল ফেগে মেঘে মেঘে মেঘলা দেবার তলে/ ম'র পরানে যিদুন মাগে তারার লগে লগে... চাকমা গান...ওই উঁচু মেঘের সাথে, পাখিদের সাথে উড়ে যেতে চায় এই মন...
এক. বুদ্ধজ্যোতি চাকমা আমার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু। সে বান্দরবানের একজন সাংবাদিক। ওর বাড়ি থানচির এক দুর্গম পাহাড়ে। কিছুদিন আগে ও বিয়ে করেছে থানচিতেই। ছোট্ট এক রত্তি ছেলেও আছে ওর। বুদ্ধর বউ গ্রমের মেয়ে হলেও কথাবার্তায় খুব চৌকস।
আমি যখন বান্দরবান যাই, তখন বুদ্ধকে খুঁজতে ওর বাসায় গেলে দুষ্টুমী করে বলি, 'ও বুজি, ভগমান হুদু?'... বৌদী ভগবান কোথায় গেছে? বৌদীও চটপট জবাব দেয়, 'তারার নির্বান হইয়ে।'... তার নির্বান লাভ হয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধ বাসায় নেই।
দুই. তো বুদ্ধ বিয়ে করার বেশ আগে, ঢাকা থেকে দিন দশেক ছুটি নিয়ে আমি বান্দরবানে গিয়েছি বেড়াতে। বুদ্ধকে গাইড করার জন্য এক রকম অ্যারেস্ট করেই ফেলি। ও ছাত্র অবস্থায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কাজে অনেক দূর দূরান্তে ঘুরেছে।
বুদ্ধ আর আমি বান্দরবান শহর থেকে এক সকালে রওনা দেই। বাস, বেবী ট্যাক্সি, সাম্পান আর হন্টনের দীর্ঘ কঠিন যাত্রা ছিলো সেটি। বান্দরবান থেকে রাজস্থলি, রাজস্থলি থেকে কাপ্তাই হয়ে ফারুয়া, তক্তানালা হয়ে পৌঁেছে যাই জগ্নাছড়া নামক এক বিস্ময়কর সুন্দর পাহাড়ি গ্রামে। সেটা মিজোরাম সীমান্তের কাছাকাছি বম জনগোষ্ঠির একটি গ্রাম।
চারিদিকে শুধু সবুজ পাহাড় আর ঘন বন। উঁচু উঁচু পাহাড়ে অল্প কয়েকটি মাচাং ঘর নিয়ে সেখানে ছোট্ট এক বম পাড়া। মনে হয়, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি টেলিভিশনের মধ্যে ঢুকে গেছি। সব কিছু দেখে আমরা দুজনেই খুব মুগ্ধ। আর মানুষগুলো যে কী ভাল!...
পুরো গ্রামটা আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি। জুম চাষ আর শিকার গ্রামবাসীদের আয়ের প্রধান উৎস।
মাচার ওপর বিশাল বিশাল বাঁেশর টং ঘর। ঘরে পৌঁছাতে হয় একটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। সন্ধ্যার পর এইসব সিঁড়ি আবার সরিয়ে ফেলা হয়। বুনো জন্তু যাতে হুট করে ঘরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য এই ব্যবস্থা।
আমরা ভাত খাই ওই গ্রামের এক বৃদ্ধ জুম চাষীর ঘরে। অচেনা মানুষগুলোর অতিথি পরায়নতা দেখে সত্যিই অবাক না হয়ে পারা যায় না।...আমরা সিদ্ধান্ত নেই, রাতটা সেখানেই কাটানোর।
তিন. সেখানে পরিচয় হয় আরেক শিকারী বৃদ্ধর সঙ্গে। এখন আর তার নাম মনে নেই। বিরাট এক গাদা বন্দুক দিয়ে সারা জীবন অনেক ধরনের শিকার করেছেন তিনি। সন্ধ্যায় এক বোতল মদ নিয়ে তার মাচাং ঘরের ইজরে (বারান্দা)বসি। পাহাড় তখন ভেসে যাচ্ছে টাটকা দুধের ফেনার মতো ফিনফিনে পূর্নিমার আলোয়।...
বৃদ্ধ শিকারী চুরুট টানতে টানতে ভাঙা বাংলায় বলেন তার শিকার জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা। আমি আর বুদ্ধ তার পায়ের কাছে বসে বালক-বিস্ময়ে শুনতে থাকি রূপকথার মতো সেই সব কথন। ছোট্ট মদের বোতল ফুরিয়ে যায় দ্রুত। ...
ওই রাতে চরম এক উপলব্ধি নিয়ে ঘুমাতে যাই।
চার. অনেক দিন ধরে পাহাড়ে, বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে নিউজ করা সুবাদে দেখেছি অনেক দালাল, সুবিধাবাদী গোষ্ঠির দৌরাত্ব। আমি যাদের বলি জুম্ম (পাহাড়ি) ব্যাপারী। আমার মনে হতো, আমি নিজেও কী তাই??
মাথার ভেতর ঘুন পোকার মতো কুটকুট করতে থাকা দীর্ঘদিনের এই গুরুতর প্রশ্নটির সমাধান হয় ওই রাতে।
না, আসলে আমি তা নই। পাহাড় আমাকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে, খ্যাতি দিয়েছে, সন্মান দিয়েছে -- এটি আদিবাসীদের নিয়ে কোনো তথ্য-বাণিজ্য করার কারণে নয়; এটি সম্ভবত তথ্য সেবা দিয়ে আদিবাসী পাহাড়ি জীবন-কথার একেবারে নির্মম গুঢ় সত্য প্রকাশ্যে তুলে ধরার জন্যই। এর নেপথ্যে যে দীর্ঘ আত্নত্যাগ রয়েছে, সে কথা না হয় অনুচ্চারিতই থাকলো!
এক. বুদ্ধজ্যোতি চাকমা আমার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু। সে বান্দরবানের একজন সাংবাদিক। ওর বাড়ি থানচির এক দুর্গম পাহাড়ে। কিছুদিন আগে ও বিয়ে করেছে থানচিতেই। ছোট্ট এক রত্তি ছেলেও আছে ওর। বুদ্ধর বউ গ্রমের মেয়ে হলেও কথাবার্তায় খুব চৌকস।
আমি যখন বান্দরবান যাই, তখন বুদ্ধকে খুঁজতে ওর বাসায় গেলে দুষ্টুমী করে বলি, 'ও বুজি, ভগমান হুদু?'... বৌদী ভগবান কোথায় গেছে? বৌদীও চটপট জবাব দেয়, 'তারার নির্বান হইয়ে।'... তার নির্বান লাভ হয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধ বাসায় নেই।
দুই. তো বুদ্ধ বিয়ে করার বেশ আগে, ঢাকা থেকে দিন দশেক ছুটি নিয়ে আমি বান্দরবানে গিয়েছি বেড়াতে। বুদ্ধকে গাইড করার জন্য এক রকম অ্যারেস্ট করেই ফেলি। ও ছাত্র অবস্থায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কাজে অনেক দূর দূরান্তে ঘুরেছে।
বুদ্ধ আর আমি বান্দরবান শহর থেকে এক সকালে রওনা দেই। বাস, বেবী ট্যাক্সি, সাম্পান আর হন্টনের দীর্ঘ কঠিন যাত্রা ছিলো সেটি। বান্দরবান থেকে রাজস্থলি, রাজস্থলি থেকে কাপ্তাই হয়ে ফারুয়া, তক্তানালা হয়ে পৌঁেছে যাই জগ্নাছড়া নামক এক বিস্ময়কর সুন্দর পাহাড়ি গ্রামে। সেটা মিজোরাম সীমান্তের কাছাকাছি বম জনগোষ্ঠির একটি গ্রাম।
চারিদিকে শুধু সবুজ পাহাড় আর ঘন বন। উঁচু উঁচু পাহাড়ে অল্প কয়েকটি মাচাং ঘর নিয়ে সেখানে ছোট্ট এক বম পাড়া। মনে হয়, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি টেলিভিশনের মধ্যে ঢুকে গেছি। সব কিছু দেখে আমরা দুজনেই খুব মুগ্ধ। আর মানুষগুলো যে কী ভাল!...
পুরো গ্রামটা আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি। জুম চাষ আর শিকার গ্রামবাসীদের আয়ের প্রধান উৎস।
মাচার ওপর বিশাল বিশাল বাঁেশর টং ঘর। ঘরে পৌঁছাতে হয় একটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। সন্ধ্যার পর এইসব সিঁড়ি আবার সরিয়ে ফেলা হয়। বুনো জন্তু যাতে হুট করে ঘরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য এই ব্যবস্থা।
আমরা ভাত খাই ওই গ্রামের এক বৃদ্ধ জুম চাষীর ঘরে। অচেনা মানুষগুলোর অতিথি পরায়নতা দেখে সত্যিই অবাক না হয়ে পারা যায় না।...আমরা সিদ্ধান্ত নেই, রাতটা সেখানেই কাটানোর।
তিন. সেখানে পরিচয় হয় আরেক শিকারী বৃদ্ধর সঙ্গে। এখন আর তার নাম মনে নেই। বিরাট এক গাদা বন্দুক দিয়ে সারা জীবন অনেক ধরনের শিকার করেছেন তিনি। সন্ধ্যায় এক বোতল মদ নিয়ে তার মাচাং ঘরের ইজরে (বারান্দা)বসি। পাহাড় তখন ভেসে যাচ্ছে টাটকা দুধের ফেনার মতো ফিনফিনে পূর্নিমার আলোয়।...
বৃদ্ধ শিকারী চুরুট টানতে টানতে ভাঙা বাংলায় বলেন তার শিকার জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা। আমি আর বুদ্ধ তার পায়ের কাছে বসে বালক-বিস্ময়ে শুনতে থাকি রূপকথার মতো সেই সব কথন। ছোট্ট মদের বোতল ফুরিয়ে যায় দ্রুত। ...
ওই রাতে চরম এক উপলব্ধি নিয়ে ঘুমাতে যাই।
চার. অনেক দিন ধরে পাহাড়ে, বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে নিউজ করা সুবাদে দেখেছি অনেক দালাল, সুবিধাবাদী গোষ্ঠির দৌরাত্ব। আমি যাদের বলি জুম্ম (পাহাড়ি) ব্যাপারী। আমার মনে হতো, আমি নিজেও কী তাই??
মাথার ভেতর ঘুন পোকার মতো কুটকুট করতে থাকা দীর্ঘদিনের এই গুরুতর প্রশ্নটির সমাধান হয় ওই রাতে।
না, আসলে আমি তা নই। পাহাড় আমাকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে, খ্যাতি দিয়েছে, সন্মান দিয়েছে -- এটি আদিবাসীদের নিয়ে কোনো তথ্য-বাণিজ্য করার কারণে নয়; এটি সম্ভবত তথ্য সেবা দিয়ে আদিবাসী পাহাড়ি জীবন-কথার একেবারে নির্মম গুঢ় সত্য প্রকাশ্যে তুলে ধরার জন্যই। এর নেপথ্যে যে দীর্ঘ আত্নত্যাগ রয়েছে, সে কথা না হয় অনুচ্চারিতই থাকলো!
No comments:
Post a Comment