Thursday, December 18, 2025

বাংলাদেশে কাউন্টার প্রক্সি ওয়্যার শুরু?

 

বাংলাদেশে গত বছর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান বেহাত, তথা জামায়াত, হেফাজত, হিজবুতের দখলে চলে যাওয়ার পর থেকেই আশংকা ছিল সিআইএর প্রক্সি ওয়্যারের বিরুদ্ধে আরেকটি কাউন্টার প্রক্সি ওয়্যারের। বর্ষা বিদ্রোহে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে গিয়ে প্রচীন দল আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে গিয়েছেন। 

গণ অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার নেতার দেশ থেকে পলায়নের ঘটনা বিশ্বে খুব নতুন নয়, কিন্তু মন্ত্রী পরিষদের সদস্য থেকে কেন্দ্রীয় নেতা তো বটেই, এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের পাতি নেতাসহ স্ব দলবলে ভারতসহ অন্যান্য দেশে পলায়নের ঘটনা নজিরবিহীন। 

তবে যারা 'দুর্ভাগ্যক্রমে' পালাতে পারেননি, এমন কিছু নেতা ও তাদের সহযোগিরা (ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে সাংবাদিকরাও আছেন) জুলাই হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন মামলায় কারাবন্দি রয়েছেন। 

শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিতেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশদাতা হিসেবে, তথা মানবতার বিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়। 
বলা ভাল, এই ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা সরকারই শুরু করেছিল, এতে ১৯৭১ এ গণহত্যাসহ যুদ্ধাপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজনের ফাঁসি ও কারাদণ্ড কার্যকর হয়। তবে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে এই বিচার বন্ধ রয়েছে। পুরনো ট্রাইব্যুনাল ভেঙে গঠন করা হয়েছে নতুন ট্রাইব্যুনাল। 



খবরে প্রকাশ, গত বছরের জুলাই-অগাস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ১৮ নভেম্বর  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
অপর দুই আসামি শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ১০ জুলাই তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয় পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। অর্থাৎ মাত্র চার মাস সাতদিনের দিন এই মামলায় রায় হলো।

রায়ের পরে তা প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা রায়টিকে "পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত" বলে অভিহিত করেছেন।
রায়টি নিয়ে মানবাধিকার প্রসঙ্গে জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগও প্রকাশ করেছে।

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ তখনই বলেছেন, শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি হবে।

এদিকে রায় ঘোষণার দিনই কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি দেয়, যা মূলত নেতাকর্মীর অনুপস্থিতিতে ভেস্তে গিয়ে দু-একটি ঝটিকা মিছিল ও বিচ্ছিন্ন বোমাবাজিতে সীমাবদ্ধ ছিল। ইউনূস জামানায় দৃশ্যতঃ আওয়ামী লীগের দল হিসেবে উঠে দাঁড়ানোর মত কোনও শক্তি নাই, চোরাগোপ্তা হামলা চালানো ছাড়া। 



এদিকে, নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ইউনূস সরকার ঘোষণা করেছে জাতীয় নির্বাচন। 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

১১ ডিসেম্বর  জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। 

নির্বাচনকে ঘিরে শুরু হয় নতুন মেরুকরণ। আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলত ফেসবুক ও এআই নির্ভরতা কাটিয়ে বিচ্ছিন্ন চোরাগোপ্তা হামলা নির্ভর হয়ে পড়ে। তাদের আশ্রয়-প্রশয়দাতা আন্তর্জাতিক পরিশক্তির এতে মদদ নেই, তা-ই বা বলি কি করে? 

আগামী দিনের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন আসছে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে তিনি দেশে ফিরবেন ও নির্বাচনে অংশ নেবেন। তার নির্বচনী প্রচারণার জন্য এরই মধ্যে দলের পক্ষ থেকে কেনা হয়েছে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকার বুলেট প্রুফ গাড়ি। সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। 

দৃশ্যত, বিএনপি, জামায়াতসহ ইসলামী দল, নব্য এনসিপি এবং বাম দলগুলো আগেভাগেই জোর নির্বচনী প্রচারণা চালিয়ে আসলেও ইলেকশন ট্রেন থেকে ছিটকে পড়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের সমর্থক ভোটারদের ভোট বিএনপি না জামায়াতের বাক্সে পড়ে  এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা কম নেই। 

৪ 

এরই মধ্যে ঘটে যায় মর্মান্তিক ঘটনা। 

দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

খবরে প্রকাশ, এ দিন রাতে ওসমান হাদির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ওই পোস্টে বলা হয়, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের মোকাবিলায় মহান বিপ্লবী ওসমান হাদিকে আল্লাহ শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন।’
 
ওসমান হাদি সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
 
গত ১২ ডিসেম্বর গণসংযোগের জন্য রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গেলে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে গুলি করা হয়। গুলিটি তার মাথায় লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। 

জানা গেছে, হাদির শ্যুটাররা ওই হামলার পর পরই দেশত্যাগ করেছে। এ হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রচ্ছন্ন উল্লাস করতেও দেখা গেছে। 

হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের তাত্ত্বিক নেতা, লন্ডন প্রবাসী ব্যরিস্টার নিঝুম মজুমদার সরাসরি ফেসবুক পোস্টে লিখছেন, "এক জুলাই স*ন্ত্রা*সী*র করুণ পরিণতি"। 

তিনি আরেক পোস্টে বলেন, "যে এম্বুলেন্সে করে ছেলেটা এরোপ্লেনে উঠলো তা ভারতের উপহার দেয়া এম্বুলেন্স। যে চিকিতসক সিঙ্গাপুরে তাকে দেখভাল করছে সেই চিকিতসক ভারতীয়। নাম প্রেমবিল্লাই। সিঙ্গাপুরের যে মন্ত্রী ছেলেটির খোঁজ খবর নিচ্ছে তিনিও ভারতীয় বংশদ্ভুত (বাবা ভারতীয় তামিল)। ভিভিয়ান বালা কৃষ্ণান। ছেলেটার সমস্ত ঘৃণা ছিলো ভারতের প্রতি অথচ মৃত্যুকালে ভারতই তাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো... নিয়তির কি অদ্ভুত পরিহাস!" 

সবশেষ পোস্টে তিনি ওই হামলার দায় জামায়াতের ওপর চাপিয়ে আওয়ামী লীগ ও ভারতকে দায়মুক্ত করেছেন। 



জুলাই যোদ্ধা হাদির মৃত্যু নতুন করে ভাবাচ্ছে বাংলাদেশকে। খোদ অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। ঘোষণা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় শোক। 

এদিকে, হাদি হত্যার প্রতিবাদে ১৯ ডিসেম্বর রাত থেকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে ছাত্র-জনতা।

হাদি হত্যার প্রতিবাদে এ দিন সকাল ৭টায় শাহবাগ মোড়ে নানা পেশার মানুষকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। ভোরে শাহবাগ মোড়ে মাইকে আজান দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন আন্দোলনকারীরা।

এর আগে ১৮ ডিসেম্বর রাতে হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন জুলাই মঞ্চের কর্মী-সমর্থকরা। বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরাও।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চত্বর ও রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। শাহবাগের বিক্ষোভে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। 
 
জাতীয় ছাত্রশক্তির সঙ্গে একে একে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং সাবেক দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম যোগ দেন। পরে অন্যান্য এনসিপি নেতারাও বিক্ষোভে অংশ নেন। 
 
এদিকে, রাত সাড়ে ১১টার দিকে দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবনে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ একটি দল। হামলার কারণে এই পত্রিকা দু'টি এই প্রথমবারের মতো মুদ্রিত সংখ্যা বের করতে পারেনি। 
 
এছাড়া হাদির মৃত্যুর খবরে দেশের নানা প্রান্তে ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ ও বোমাবাজির খবর আসছে। পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হচ্ছে।...
 
সবশেষ, সাংবাদিক ও পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে ফেসবুক পোস্টে লিখছেন, "প্রথম আলো পোড়ানো, আপসহীন সম্পাদক (দ্য নিউ এজ)  নুরুল কবীরকে হেনস্থাসহ যা যা করা হলো, তা হাদির ঘাতকদের হাতকে শক্তিশালী করলো। হাদীর শহীদানকে ব্যর্থ করে দিতে চাইলো। এরা জুলাইয়ের কেউ না, এরা জুলাইকে ধ্বংস করতে নেমেছে।" 
 
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কল্লোল মোস্তফা বলেন, "ওসমান হাদিকে হত্যা আর প্রথম আলো --ডেইলি স্টার -- ছায়ানটে হামলা-- --ভাঙচুর--অগ্নিসংযোগ একই মাস্টারপ্ল্যানের অংশ। হাদীর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যারা এই হামলা--ভাঙচুর--অগ্নিসংযোগে উস্কানি দিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন, সমর্থন যুগিয়েছেন তারা সবাই এই প্ল্যানের অংশ। সরকারের দিক থেকে সময় মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে সরকারও তাতে সহযোগীতা করেছে।"

তিনি বলেন,  "এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে ক্লাসিকাল ফ্যাসিজমের উত্থানের সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠল। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক অবস্থানের কারণে হাসিনা আমলেও প্রথম আলো--ডেইলিস্টার একদিন বন্ধ থাকে নাই, নুরুল কবিরের উপরে হামলা হয় নাই। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যা ঘটতে পারল। দেশে উগ্র ডানপন্থি গোষ্ঠীর উত্থান ও অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই এ রকম ঘটনা সম্ভব হলো।"

No comments:

Post a Comment