Monday, August 5, 2024

বাংলাদেশে প্রক্সি যুদ্ধে জয় কার?

 সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগকে কবরে পাঠিয়ে ন্যাকারজনকভাবে সদলবলে দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচলেন। 


ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের   জোয়ার ভেসে গেল টানা ১৫ বছর ধরে বিনা ভোটে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা আওয়ামী দুঃশাসন। 
 
এই ১৫ বছর নির্রাচনের নামে প্রহসন হয়েছে, নিশিরাতের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভোট হয়নি, মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এ নিয়েও জনমনে ক্ষোভ নেহাত কম নেই। ভেংগে যেতে বসা সংসদের তাই কোনো জবাবদিহি ছিল না, সেটি গঠিত হয়েছিল কেবলই আওয়ামী লীগ ও কিংস পার্টি দিয়ে, পোষা বিরোধী দল ছিল যথারীতি জাতীয় পার্টি। 
 
ইতিমধ্যে সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। 


দেশ এর আগে সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদের পতন দেখেছে। এই লেখক নিজেও ১৯৯০ এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের কর্মী ছিলেন। এরশাদ তবু ক্ষমতা থেকে পদত্যাগের পর দেশেই থেকেছেন। দুর্নীতির দায়ে জেল খেটে বেরিয়ে এসে আবারও তার দল জাতীয় পার্টি গুছিয়েছেন, নির্বাচন করে সাংসদও হয়েছেন। 

হাসিনার মতো লেজগুটিয়ে সদলবলে পালিয়ে যাননি। দুপুরেই খবর রটে যায়, কারফিউ ভেংগে হাজার হাজার ছাত্র জনতা শাহবাগে জড়ো হয়েছেন, ঢাকার সমস্ত রাজপথ ধীরে ধীরে দখল নিতে থাকেন জনতা। আর ওদিকে, বংগভবন (প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) থেকে ছোট বোন শেখ রেহানাকে সহ  হেলিকপ্টারে করে ভারতের আগরতলায় পালিয়ে যান পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই খবর পাওয়া মাত্র জনস্রোত বংগভবনের দখল নেয়। 


খবরে প্রকাশ, শেখ হাসিনাকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজটি নয়াদিল্লির কাছে হিন্ডন বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেছে।

উড়োজাহাজটি অবতরণের কথা নিশ্চিত করেছে ভারতের এনডিটিভি। দিল্লির কাছাকাছি এই বিমান ঘাঁটিটি উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদ জেলায় অবস্থিত।
শেখ হাসিনাকে বহন করছে একটি লকহিড সি১৩০জে হারকিউলিস উড়োজাহাজ। ছোট বোন শেখ রেহানা তার সঙ্গে রয়েছে। 

ভারতের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, হাসিনা ভারতের হিন্ডন বিমান ঘাঁটি থেকে লন্ডন যেতে পারেন। সেখানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন। 

এদিকে, তার প্রবাসীপুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় বিবিসিকে বলেছেন, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। 

অন্যদিকে, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীবর্গ এরই মধ্যে দেশত্যাগ করেছেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। ছাত্রলীগ নামধারী হেলমেট লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী আপাততঃ গর্তে লুকিয়েছে। 


অথচ ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীদের সংগে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় মিমাংসা হতে পারতো। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হাসিনা সরকার প্রথমে পুলিশ লীগ, পরে হেলমেট লীগ দিয়ে নির্বিচার পিটুনিতে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছে। এতেও হিতে বিপরীত হয়ে আন্দোলন ছড়িয়েছে সারাদেশে। 

পরে নির্বিচার গুলিতে একমাসে অন্তত সাড়ে তিনশ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে (বেসরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা সহস্রাধিক), আহত হয়েছেন অসংখ্য। এতে শিক্ষক, অভিভাবক, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের জনতার ভেতরে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। 

বর্ষিয়ান লেখক, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, এতো অল্প সময়ে এতো নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আমলে এক ১৯৭১ সাল ছাড়া আর কখনো হয়নি। 

সেইসাথে মেট্রোরেল, পদ্মাসেতু, একের পর এক উড়াল সড়ক, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ইত্যাদি মেগা প্রকল্পে মেগা লুটপাট, লাগামহীন নিত্যপণ্যে নাভিশ্বাস তো আছেই। 

এসবই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আকারে ফেটে পড়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। 
 
এই দেশ ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর ছাত্র গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ এর এরশাদ পতনের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান দেখেছে। মাঝে ঘটে গেছে ২০১৩ সালের শাহবাগ গণজাগরণ। সবশেষ এই দেশ ২০২৪ এর বেহাত ছাত্র আন্দোলনের সাক্ষী হয়ে রইল। 

আগেই যেমন বলা হয়েছিল,  একটি ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনকে বাংলাদেশ এই প্রথম বেহাত হয়ে বিএনপি-জামাত-শিবির-হেফাজতের দখলে যেতে দেখল। এ কারণেই খুব দ্রুত ছাত্র আন্দোলনটি পরিনত হয় এক দফার দাবিতে, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে। সে সময়ই বল খুব দ্রুত চলে যায় আওয়ামী লীগের গ্রাসের বাইরে। 

শেকড় সংবাদে, ভেতরে ভেতরে এখানে আসলে আমেরিকা, চীন ও ভারতের প্রক্সি যুদ্ধ চলেছে। গণ আন্দোলনকে এরকমভাবে প্রক্সিযুদ্ধে পরিনত হওয়ার ঘটনাও এই প্রথম। এই প্রক্সি যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ভারত ও চীন পিছু হটেছে। যুক্তরাষ্ট্র- পাকিস্তান পক্ষই জয়ী হয়েছে। 
 
যুক্তরাষ্ট্রের চাই, ভারত-চীন- বার্মাকে ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লায় রাখতে বংগোপসাগরে নৌ ঘাঁটি, আর দক্ষিণ এশিয়ার এই ব-দ্বীপ ভূমিতে একক মার্কিন পরাশক্তির খবরদারি তো চাইই বটে!
 
বলা ভাল,  শিক্ষার্থীদের বেহাত আন্দোলনে বেশকিছুদিন ধরে আঠালো ভাবে মিশে আছে, সদ্য নিষিদ্ধ ঘোষিত ছুপারুস্তম জামাত-শিবির। তারাই প্রক্সি যুদ্ধে এজেন্ট হিসেবে ভেতর থেকে খেলছে। 

অবশ্য হলি ক্রস হিসেবে তারা প্রথম সারিতে রেখেছে ছাত্রদের। আর জাতীয় সরকারের খসড়ায় রয়েছে বিএনপি-জামায়াত ( সদ্য নিষিদ্ধ)-হেফাজত-বামপন্থী-পেশাজীবীদের প্রতিনিধি। 
 
এরই মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগে অন্তত ২০ বছর ধরে বিদেশে পলাতক তাদের নেতা তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া চলছে। শিগগিরই সব মামলা প্রত্যাহারের পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে নয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী করাও বিচিত্র নয়। 

কিন্তু এতেই শেষ রক্ষা হবে তো? নাকি  দেশ এগিয়ে চলেছে একটি জোড়াতালির দুর্বল জাতীয় সরকার গঠনের অনিবার্য পরিণতিতে? আর যে প্রজন্ম ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যথেষ্ট শানিত নয়, রাজনীতির অ-আ-ক-খ জ্ঞানও যাদের নাই, তাদেরই কাছে দেয়া হচ্ছে দেশের ভার, এর ভবিষ্যত তাহলে কী? 
 
ঘর পোড়া গরু ঈশান কোনে মেঘ দেখলে ভয় পাবেই। তবে সরাসরি সেনা শাসনের চেয়ে দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকার মন্দের ভালো। 
 ____________________
*দ্রষ্টব্য :
1)   ইন্ডিয়ান এক্সপেসের বিশ্লেষণ : ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার দেশত্যাগ, ভারতের জন্য কী বার্তা
 
2) সেন্টমার্টিন-বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রেকে দিলে ক্ষমতায় টিকে থাকতাম: হাসিনা
 
3) শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতিতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়: হোয়াইট হাউস
 


No comments:

Post a Comment