Saturday, October 3, 2020

আমি বাংলার, বাংলা আমার, ওতপ্রোত মেশামেশি… -


দেশবিভাগের একটি সুফল হচ্ছে “বাংলাদেশ” নামক নতুন দেশের জন্ম, যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তানী জাতিগত নিপীড়নের অবসানে ১৯৭১ এ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা।

তবে দেশবিভাগের নেপথ্যে যে লাখোকোটি জনতার রক্ত, অশ্রু, আত্মত্যাগ থাকে, তা কখনোই কালেরগর্ভে হারিয়ে যায় না, দেশ হারানোর বেদনাশূল বিঁধে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, পরানের গহিন ভিতর।

প্রসঙ্গত, এক টুকরো স্মৃতিকথা। ১৯৯৯ সালে প্রথম চালু হলো ঢাকা-কলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস। সৌভাগ্য হয়েছিল, এর পরীক্ষামূলক প্রথম ট্রিপে সাংবাদিক হিসেবে অংশগ্রহণের। শ্যামলী পরিবহনের বাসটির গায়ে লাল-সবুজ বাংলাদেশের পতাকা আঁকা। এই বাস যখন এলেন্স গিনসবার্গের ‌“সেপ্টেম্বর ইন যশোর রোড” ধরে বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে পৌঁছায়, তখন দেখা যায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

ওপারের শত শত গ্রামের মানুষ পথ আটকে বসে আছেন রাস্তায়, শুধু এক নজর বাসটিকে দেখবেন বলে! বাসটি সেখানে পৌঁছাতেই নানা বয়সী নারী-পুরুষে হুলুস্থুল শুরু হয়ে যায়। বাড়ির বউরা শাঁখ বাজান, উলু ধ্বণী দেন, ঢাক-ঢোল-কাঁসর বাজতেই থাকে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা বাসটিকে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। অসংখ্য মানুষ ঘিরে ধরেন বাসটিকে। আরো দূরের যারা, তারাও কাছে আসার জন্য ঠেলাঠেলি করতে থাকেন!

টিম লিডারকে বলে এই বিরল দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে বাস থেকে লাফিয়ে নামা। খালি পা, সাদা মলিন থানের এক বৃদ্ধা বাসটিকে ছুঁয়ে হাউমাউ করে কাঁদেন। ঠাকুমা, কাঁদছেন কেন? হট্টগোল ছাপিয়ে বুড়ির মুখের কাছে কান পেতে শোনা যায়, একটিই আহাজারি বার বার, “বাংলাদ্যাশের গাড়ি! আমাগো বাংলাদ্যাশের গাড়ি!”

এক নিমিষে উন্মোচিত হয় মহাসত্য। এই বিশাল জনস্রোত আসলে দেশ বিভাগের শিকার জনগোষ্ঠী। তারা এখনো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধারণ করেন ফেলে আসা পূর্ববংলা। হারানো দেশের এই বাহনটি যেন তাদের কাছে হারিয়ে যাওয়া সেই দেশই!

উল্টে গেল পাশার দান!

এটি বিস্ময়কর,  যে বাঙালি জাতি পাকিস্তানী জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করলো, এই জাতিই স্বাধীন দেশে অপরাপর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শোষক হয়ে দাঁড়ালো। বাঙালি উগ্র জাতীয়তাবাদের নির্মম রোষানলে পড়লো ভিন্ন ভাষাভাষী পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী।

১৯৭২ সালের খসড়া সংবিধান রচনারকালে উপেন্দ্র লাল চাকমা, এম এন লারমাসহ পাহাড়ি নেতারা সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাবনা নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে তাৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবনাটি তীব্রভাবে নাকচ করেন। প্রতিনিধিদলকে সৌজন্যবশত বসতেও বলা হয়নি। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁদের মুখের ওপর প্রস্তাবনার ফাইল ছুঁড়ে মেরেছিলেন (দেখুন, লাইফ ইজ নট আওয়ার্স, সিএইচটি কমিশন রিপোর্ট, ১৯৯২)।

পাহাড়ি নেতা, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এমএন লারমা ১৯৭৩ সালে সংসদ অধিবেশনে তুলে ধরেন পাঁচ দফা দাবিনামা। এগুলো হচ্ছে :

“ক. আমরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাসমেত পৃথক অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পেতে চাই। খ. আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার থাকবে, এ রকম শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন চাই। গ. আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষিত হবে, এমন শাসনব্যবস্থা আমরা পেতে চাই। ঘ. আমাদের জমিস্বত্ব, জুম চাষের জমি ও কর্ষণযোগ্য সমতল জমির স্বত্ব সংরক্ষিত হয়, এমন শাসনব্যবস্থা আমরা পেতে চাই। ঙ. বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে যেন কেউ বসতি স্থাপন করতে না পারে, তজ্জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার প্রবর্তন চাই।”…

কিন্তু স্বাধীন দেশের প্রথম সংবিধানে চরমভাবে উপেক্ষিত হয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি। বর্তমান সংবিধানের মতো সেখানেও ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’–এমন কথা বলা হয়। শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব রাঙামাটির জনসভায় পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা সবাই বাঙালি হইয়া যাও। আমি তোমাদের উপজাতি থেকে জাতিতে প্রমোশন দিলাম।”

ইতিহাস স্বাক্ষী, এই উগ্র জাতীয়তাবাদী আগ্রাসী মনোভাবের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল দেশকে, পাহাড়িদের গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনী আড়াই দশকের রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধে, ১৩টি গণহত্যায়, প্রায় ৭০ হাজার পাহাড়ি মানুষের একযুগের শরণার্থী জীবন যাপন এবং আনুমানিক পাহাড়ি-বাঙালি ২৫ হাজার মানুষের জীবনদানে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে অবসান ঘটে পাহাড়ে যুদ্ধাবস্থার, বিলুপ্ত হয় গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনী, শরণার্থী জীবনের গ্লানি ঘুচিয়ে দেশে ফেরেন দেশান্তরী হওয়া মানুষ, তবে শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্তসমূহ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, সেটি অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।   

“বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী!”

বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে একটি উদ্ভট তত্ত্ব দেয়, বঙ্গীয় নৃতাত্বিক ইতিহাস গুলে খেয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঘোষণা করা হয়, উপজাতিরা নয়, বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী! আর চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কোল, গারো, খাসি প্রভৃতি ৭৫টি ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠী, ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে যারা অকাতরে বাঙালির পাশাপাশি সম্মুখযুদ্ধে জীবন দিয়েছে, তারা নাকি বহিরাগত!

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন জোর প্রচারণাই শুধু চালানো হয়নি, তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি মিডিয়ার সম্পাদকদের ডেকে অনুরোধ করেন, ভাষিক সংখ্যালঘুদের  “আদিবাসী” অভিধার বদলে যেন “ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী” অভিধায় ডাকা হয়। আর সেই থেকে মিডিয়া রাতারাতি “আদিবাসী” অভিধার বদলে “ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী” অভিধাই ব্যবহার করছে।

জাতিগত এই উগ্র অহমিকার প্রত্যক্ষ হুমকি হচ্ছে, দেশের ক্ষুদ্রজাতি গোষ্ঠীর মানুষের কাছে যেটুকু জমি, জলা, টিলা, বাগান ইত্যাদি সম্পদ রয়েছে, বাঙালি লুণ্ঠনকারী গোষ্ঠীকে সেটুকুও কেড়ে নিতে উস্কানি দেওয়া।

সেই থেকে বাংলাদেশ এই উগ্র রাজনৈতিক দর্শনে পরিচালিত হচ্ছে, পাহাড় থেকে সমতলে প্রতিনিয়ত বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম কী ডাকাতদের গ্রাম?

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে ১৩টি ভিন্ন ভাষাভাষী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চল। প্রায় প্রতিনিয়ত সেখানে অভিবাসিত বাঙালিদের দ্বারা মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। কখনো এসব মানবাধিকার লংঘন সহিংস রূপ নেয়, নেপথ্যে থাকে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদ। জায়গা-জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে উজাড় হয় একের পর এক পাহাড়ি গ্রাম।

বেসরকারি সংস্থা কাপেং ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর এ পর্যন্ত ১৭টি সহিংস ঘটনায় অসংখ্য পাহাড়ি গ্রাম লুঠপাঠ ও উচ্ছেদ হয়েছে। হতাহত হয়েছেন অনেকে। আর এভাবেই পাহাড়ে জেঁকে ভয়ের রাজ্য। সেটি যেন আসলে ডাকাতদেরই শাসনের বৃহত্তর গ্রাম। গ্রামবাসী পাহাড়িরা মাঝে মধ্যেই ডাকাতি-লুন্ঠানের শিকার হবেন, এ-ও যেন অনিবার্য।   

সবশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের বলপাইয়া আদাম এলাকায় পাহাড়ি গ্রামের ভেতরে ঢুকে নয়জন সেটেলার বাঙালি হামলা ও লুঠপাঠ চালায়। এ সময় তারা বাড়ির প্রতিবন্ধী চাকমা মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে।  লক্ষ্যনীয়, সেপ্টেম্বরেই খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও মহালছড়িতে দুজন পাহাড়ি স্কুলছাত্রী এবং বান্দরবানে এক ত্রিপুরা নারী ধর্ষিত হয়েছে, আদিবাসী বলে এ পর্যন্ত কোনো ঘটনারই সুরাহা হয়নি।

কিন্তু প্রতিবন্ধী চাকমা মেয়েটির গণধর্ষণের সোচ্চার হয় দেশ। করোনাক্রান্তির ভেতরেই পাহাড়ে তো বটেই, খোদ ঢাকার শাহবাগে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন একের পর এক প্রতিবাদী মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। আর মেয়েটিকে হাসপাতালে নেওয়ার একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন, যা পাহাড়ে খুবই বিরল ঘটনা। পুলিশ তৎপর হয়ে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে পলাতক আটজন আসামিকে। তাদের মধ্যে পাঁচজন আবার এরইমধ্যে আদালতে লুঠপাঠ ও ধর্ষণের দায় স্বীকার করে জবানবন্দীও দিয়েছেন।

অর্থাৎ পাহাড়ে কোনো মানবাধিকার লংঘিত হলে, তা শুধু রাজপথে গড়ালে ও স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলেই সুবিচারের সম্ভাবনা থাকে, নইলে নয়? এ কোন বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে আমাদের বসবাস?

No comments:

Post a Comment