Tuesday, March 31, 2020

ঘোল


অন্যকে না খাওয়ালেও নিজে বিস্তর ঘোল খাননি, এমন বাঙালি মেলা দুস্কর। অর্থাৎ বাঙালি মাত্রই ঘাটে ঘাটে ঘোল খেয়ে থাকেন।

আমাদের শৈশবে রূপকথার বইতেও দেখেছি, রাজা-রাজড়ার আমলে দুস্কৃতিকারীকে  জুতোর মালা পরিয়ে, উল্টো গাধায় বসিয়ে, মাথায় ঘোল ঢেলে রাজ্যের বাইরে বের করে দেওয়া হতো। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবির শুরুতেও বেসুরো গান ও বেতাল ঢোলের জন্য গুপি-বাঘাকে ওইরূপ শাস্তি ভোগ করতে দেখা যাবে।


সাতের দশকে ইস্কুলের নীচু ক্লাসের পড়ার কালে ঢাকা তখনো ছিল হাফ-মফঃস্বল, প্রধান সড়কে মটোরগাড়ি-বাস-রিকশার পাশাপাশি রীতিমতো গরুরগাড়ি চলতো। পাড়ায় পাড়ায় ছিল বানর বা সাপ খেলা, ম্যাজিক দেখানো, খোলা মাঠে বসতো মিনি সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রা ইত্যাদি। ফুচকা, হট প্যাটিস বা ঘটিগরমই ছিল আমাদের ফাস্টফুড। সে সব বিস্তারিত ‌‘শিরোনামহীন’ লেখায় বলেছি, আগ্রহী পাঠক গুগল করে দেখে নেবেন।

সে সময় আমাদের শৈশবে প্রায় একমাত্র পানীয় হিসেবে ছিল ঘোল। বাচ্চাদের চা খাওয়া ছিল বারণ। আর তখনো বোতলজাত কোল্ড ড্রিংক্স এতো পাত্তা পায়নি।

১৯৭১ এ স্বাধীনতার পর উর্দূভাষী আটকে পড়া পাকিস্তানীরা, যারা ‘বিহারী’ নামে এখনো পরিচিত, অনেকেই দেশবিভাগের সময় বিহার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা ঘোলকে বলতেন ‘মাঠা’।

তো মোহাম্মাদপুরে বিহারী বসতিপূর্ণ এলাকায় বাসার গলির মুখে খুব ভোরে বিশাল এলমুনিয়ামের হাড়ি নিয়ে গাল ভাঙা, খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাঁড়ির বিহারী ঘোলওয়ালা বসতেন। তার হাড়িতে থাকতো ঘরে তৈরি ঘোল। হাড়ির মুখটি কাঁচের চৌকা টুকরো দিয়ে ঢাকা থাকতো। ওপরে বসানো থাকতো ছোট ছোট কাঁচের গ্লাস। মাঝারি মাপের এলমুনিয়ামের মাগ দিয়ে ক্রেতাদের ওইসব সব গ্লাসে ঢেলে দেওয়া হতো সুস্বাদু ফেনা ওঠা ঘোল। আর উঁকি দিলে হাড়িতে দেখা যেত ঘোলের ওপর বিস্কুট মাপের হলুদাভ মাখন ভাসতে। প্রতি গ্লাস দুই সিকি (তখনো একে ‘চার আনা’ বলা হতো) বা পঞ্চাশ পয়সা (‘আট আনা’) মাত্র।

ঘোল ওয়ালা মাঝে মাঝে হাঁকতেন, ‘এই মাট্টঠাআআআআ…’!
নামাজীরা অনেকেই মসজিদে ফজরের নামাজ সেরে বাসায় ফেরার পথে দুই-এক গ্লাস ঘোল খেতেন।  আমরা কচিকাঁচারা কখনো খুচরো টাকাপয়সা নিয়ে গিয়ে মাগ বা জগে সাধ্যমত ঘোল কিনে বাসায় এনে খেতাম। বেশী করে কিনলে ঘোলওয়ালা বিশাল হাতলওয়ালা চামচে করে একটুকরো মাখন তুলে ক্রেতাকে ফ্রি দিতেন। দুটি বিশাল বোতল-কাটা গ্লাসে ওপর-নীচ দূরত্বে তার ঘোলা ঢালাঢালির কৌশল মুগ্ধ হয়ে দেখতাম!

এখনো যেন চোখ বুজলেই দেখতে পাই সেই আধবুড়ো, তিন পকেট শার্ট, ঢোলা পায়জামা, টায়ারের স্যান্ডেল পরা শুকনো মতো ঘোলওয়ালাকে। হা শৈশব!

তো, এই গরমে দু-এক গ্লাস ঘোল হলে মন্দ হয় না। ওপরে ভাসবে বরফ কুঁচি। এটি বানানো খুবই সহজ।

এক গ্লাসের এক পঞ্চমাংশ টক দই, বাকিটা পানি, এক টুকরো লেবুর রস, এক চিমটি লবন দিয়ে খুব করে চামচ দিয়ে মেশাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন, ঘোলে পানির পরিমান বেশি হয়। অনেকক্ষণ মেশানোর পর গ্লাসের ওপরে ফেনার বুদবুদ ভেসে উঠলে বুঝতে হবে ঘোল তৈরি। এই অনুপাতে ব্লেন্ডারে বেশি করেও বানানো যায়।

ঠাণ্ডা ঘোল শুধু গরমের আরাম নয়, এটি হজমে সহায়তা করে, ফ্যাট কাটাতেও সয়াহক, আর সাধারণ ডায়েরিয়ায় রীতিমতো খাবার স্যালাইনের কাজ করে।

আর পুরনো পদ্ধতিতে ঘোল বানাতে হলে নীচের ভিডিও ক্লিপিং দেখতে পারেন, রীতিমতো গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য, মূল রেসিপি কিন্তু একই। চিয়ার্স!  

No comments:

Post a Comment