১৯৭১ এর রক্তস্নাত বাংলাদেশে এমন ভোর কখনো আসেনি। করোনার কারণে দেশ এই প্রথমবারের মতো যেন ভুলে গেল স্বাধীনতা দিবস! আনুষ্ঠানিক-অনানুস্ঠানিক লকডাউনের খপ্পরে এই প্রথমবারের মতো সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে লাখ লাখ জনতার ঢল তো দূরের কথা, তেমন কোনো শ্রদ্ধাঞ্জলিও পড়েনি। খা খা করছে স্মৃতিসৌধ, যেন ৩০ লাখ শহীদের আত্মা ঝাউবনের চিরল পাতার কম্পনে, বাতাসের ফিসফিসানীতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, কী মাঝি? ডরাইলা?...
স্বাধীনতার কালই অধমের ভূমিষ্টের কাল। ভাবতে গৌরব হয়, আমার স্বজনেরা যুদ্ধদিনে কতো কষ্টেই না আগলে রেখেছিল নিদানকালের শিশুপ্রাণটিকে।
বড়ো হয়ে জানতে পাই, আমার ছোট মাসি (এপারে ‘খালা’) মঞ্জু, সৈয়দা এলিজা সিরাজী নামের অকুতভয় এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কথা। তিনি ছিলেন দারুণ সাহসী ও দাপুটে ছাত্রনেত্রী। তখন যৌবন কাল, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। উত্তরবঙ্গের মহকুমা শহর (এখন জেলা) সিরাজগঞ্জের কথা, সেদিনটি ছিল ১৯৭১ এর ২৪ মার্চ, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন। মঞ্জুখালা তখন বিএড কলেজে পড়েন, ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও মহিলা সংগ্রাম পরিষদ, সিরাজগঞ্জ মহকুমা কমটির আহবায়ক। আগুন ঝরা ওই সকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র মিছিলের পাশাপাশি তিনি সব কলেজের ছাত্রীদের সংগঠিত করে বিশাল মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে যোগ দেন মিছিলে।
ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের বিশাল মিছিলে জেনারেল আইয়ুব বিরোধী সেই সময়ে একজন মুসলিম তরুণী প্রকাশ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, দুই হাত মুখের কাছে গোল করে লিড শ্লোগানারের ভূমিকা পালন করছেন, ভাবা যায়? সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের দৈনিকগুলোতে এমন একটি ছবি ফলাও করে ছাপা হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই ছবির সূত্র ধরেই পাক সামরিক জান্তা মঞ্জু খালাকে গ্রেপ্তার করার জন্য অনেক অভিযান চালায়। তবে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জু অতি দক্ষতায় বরাবরই থেকে গেছেন তাদের ধরাছেঁয়ার বাইরে।
এদিকে, খালার বড় ভাই, সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান শিরাজি, আমার মন্টু মামাও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কর্মী। ১৯৭১ এ রাজাকাররা তাকে ঘুমখুন করে। শহীদ মন্টুমামার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি, তার কোনো ছবিও নেই। তার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একটি নীল রংগের তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও খালার কাছে সংরক্ষিত আছে। মন্টু মামা মুক্তিযুদ্ধের এক অকথিত অধ্যায়।
এখন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মঞ্জু খালা নানান অসুখ ও বয়সের ভারে কাবু। তবু মুক্তিযুদ্ধের নানা ছবি, পেপার ক্লিপিং, বইপত্র আর অজস্র স্মৃতিকথা আগলে আছেন পরম যত্নে। আমাদের মতো প্রজন্ম ৭১ বা দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রজন্মের কেউ আগুন ঝরা দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে আগ্রহ নিয়ে শোনান সে সব দিনের কথা। "সে এক দিন ছিলো গো সোনা..."…
মন্জু খালা এখন, পারিবারিক অ্যালবাম থেকে :
No comments:
Post a Comment