আমরা তো ভুলি নাই শহীদ...
দিনাজপুর প্রতিনিধি খবর দেওয়ার আগেই ফুলবাড়ি গণবিদ্রোহে গুলি চালানো প্রথম খবর পাই আন্দোলনের বন্ধুদের কাছ থেকে। তখনো গুলি আর টিয়ার শেল বর্ষণ চলছিলো (২৬ আগস্ট, ২০০৭, বিকেল বেলা)।
আমি খবরটি নিশ্চিত করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে দিনাজপুরে পরিচিত সাংবাদিকদের টেলিফোন করা শুরু করি। অফিসে জানাই, টপমোস্ট নিউজ রেডি হচ্ছে।
দিনাজপুরের সাংবাদিকরা তখন গুলিবর্ষণের খবরে মটর সাইকেলে ফুলবাড়ি রওনা হয়েছেন। পরিস্থিতির এতোটা অবনতি হবে তারা ভাবতেই পারেননি। তাই সেদিন সবাই দিনাজপুর সদরেই অবস্থান করছিলেন। খরবাখবরের জন্য তারা দু একজন ফুলবাড়ির স্থানীয় প্রতিনিধির ওপর ভরসা করেছিলেন। তো টেলিফোনে নিউজ সংগ্রহ করে ব্রেকিং নিউজ দেই আমার সে সময়ের কর্মস্থল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে। এর পর সন্ধ্যা ৭ টা থেকে চলে টিভি মনিটরিং।
বসদের জানাই, ওই রাতেই ফুলবাড়ী যাওয়া দরকার। অফিস এসাইনমেন্ট নিয়ে রাতেই চেপে বসি দিনাজপুরের বাসে। বাসের হেল্পারকে বলে রেখেছিলাম, ফুলবাড়ির আন্দোলন দেখলে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দেয়। আমি সেখানেই নেমে যাবো। ভোর রাতে হেল্পার ঘুম ডেকে তোলেন, সাংবাদিক ভাই আন্দোলন দেখেন!
কাঁচা ঘুম ভেঙে আবছা আলোর ভেতর জানালা দিয়ে দেখি, মোটা মোটা গাছ কেটে রাস্তায় ব্যরিকেড দেওয়া হয়েছে। তবে পুরো রাস্তা শুনশান। কোথাও কোনো পিকেটার নেই। বাসের হেল্পার আর কয়েকজন যাত্রী মিলে টেনেটুনে এ রকম আরো কয়েকটি ব্যারিকেড সরায়। তৈরি হয় দিনাজপুর যাওয়ার পথ।
রণাংগনের ভেতর
ওই সকালেই দিনাজপুরে পৌঁছে স্থানীয় এক সাংবাদিকের সহায়তায় খুঁজে বের করি ইন্টারনেট সংযোগ আছে, এমন একটি কম্পিউটারের দোকান। তখনও নাওয়া - খাওয়া হয়নি। দোকান -পাট খুলতে শুরু করেছে মাত্র। মোবাইল টেলিফোনে অনুরোধ করে কম্পিউটারের দোকান খোলানো হয়।
এর মধ্যে ফুলবাড়ি থানার ওসি, ইউএনও এবং দিনাজপুর এসপির বক্তব্য নেওয়া হয়ে গেছে। আমি বসে যাই কম্পিউটারে ফুলবাড়ির টাটকা খবর টাইপ করতে। একটি এক - দেড়শ শব্দের নিউজ মেইল করে খুঁজে বের করি রেন্টে কারের দোকান। ফুলবাড়ি যেতে কেউই রাজি নন। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে অভয় দিলে একজন অবশেষে রাজি হন মোটা টাকায় ফুলবাড়ি যেতে। ঠিক হয়, যেখানে ব্যারিকেডের কারণে গাড়ি আর যেতে পারবে না, ড্রাইভার সেখানেই আমাকে নামিয়ে দেবে। ফুলবাড়িতেই রাত্রি যাপন করতে হতে পারে ভেবে আমি হ্যাভারশেকটিকে সঙ্গে নেই।
ছোট্ট কালো ট্যাক্সি ক্যাবের সামনে -- পেছনে বড় বড় হরফে ‘সংবাদপত্র’ কথাটি লিখে টেপ দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। ঝোলানো হয়েছে দুদিকে দুটি লাল পতাকা। গাড়ি এগিয়ে চলে, গাড়িতে বসেই দোকান থেকে কেনা কলা - বিস্কুট দিয়ে আমি সকালের নাস্তা সেরে নেই।
দেখি ফুলবাড়ির পুরো রাস্তা ফাঁকা। কোথাও কোনো জনমানুষ নেই। মাঝে একবার বিডিআর হাত তুলে গাড়ি থামায়। পরিচয় - গন্তব্য জেনে আবার যেতে দেয়। আবারো হঠাৎ ব্রেক কষে ড্রাইভার। পথের মধ্যে আগুন জ্বেলে আর গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়েছে আন্দোলনের মানুষ। আট -- দশ জন যুবক মোটা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। আমি লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করে পরিচয় জানাই; গাড়ির ক্ষতি না করতে অনুরোধ করি। তারা সকলেই কলেজ ছাত্র। সব কিছু শুনে তারা প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বলেন, ঠিক আছে ভাই, আপনি নির্ভিয়ে যান। শুধু আমাদের পক্ষে লিখবেন। কলম যেনো আবার এশিয়া এনার্জির দিকে না যায়!
ফুলবাড়ি জেগেছে!
এদিকে গাড়ি ভাঙার ভয়ে ড্রাইভার আবার বেঁকে বসেছে। কিছুতেই তিনি ফুলবাড়ি যাবেন না। এবার পিকেটাররাই তাকে শাসায়, সাংবাদিককে ফুলবাড়ি নিয়ে না গেলে এখানই গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। এই হুমকিতে কাজ হয়। আমি বুদ্ধি করে পিকেটারদের একজনকে সামনে তুলে নেই। সেও কলেজ ছাত্র, ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম বর্ষে পড়ে। নাম জানায়, তাজ (পরে তাজের সঙ্গে আমার চমৎকার বন্ধুত্ব হয়। এর পরের দিনগুলোতে মোবাইল ফোনে মিসড কল দিলেই আমি ওকে রিং ব্যাক করে জেনে নিতাম আন্দোলন পরিস্থিতি। ফুলবাড়িতে তাজই আমার গাইড হিসেবে কাজ করে। ওর সঙ্গে এখনো মাঝে মাঝে টেলিফোনে কথা হয়।)।
সামনের পথটুকু ওই- ই নিরাপত্তা পাস হিসেবে কাজ করে। তো পিকেটাররা গাছের গুড়ির ব্যারিকেড সরিয়ে পথ করে দেয়। পথে আরো দু/ একটি এরকম বাধা -- বিপত্তি ঠেলে গাড়ি এগিয়ে চলে।
ফুলবাড়ির একটু আগেই গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হয়। লোহার একটি ব্রিজের কয়েকটি পাটাতন খুলে ফেলায় পথ বন্ধ। ব্রিজের পাশেই এক জায়গায় শুকনো রক্তের দাগ। ইটের টুকরো দিয়ে সেই স্থানটি ঘেরে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের দিনই সেখানে পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন ফুলবাড়ির তিনজন শহীদের একজন কলেজ ছাত্র তরিকুল।
পাশেই জটলা করছেন কয়েকজন আন্দোলনকারী সাধারণ মানুষ। ব্রিজের ওপারে বিশাল মিছিল হচ্ছে। লাঠিশোটা হাতে হাজার হাজার মানুষ। মিছিলের সামনে গ্রামের বউ - ঝি’ রা। মিছিল থেকে রণ হুংকার দেওয়া হয়,
আমি দ্রুত গাড়িটিকে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে ফুলবাড়ি আন্দোলনের কয়েকজন নেতার ভাষ্য নেই। আরো কয়েক ঘন্টা আন্দোলনকারীদের মিছিল - বিক্ষোভ, ফুলবাড়ির মোড়ে মোড়ে টায়ার পোড়ানো দেখি। আমাকে আবার বিকেলের মধ্যে দিনাজপুর পৌঁছতে হবে। অনির্দিষ্ট হরতালের কারণে ফুলবাড়ির সমস্ত দোকান -- পাট বন্ধ। আন্দোলনকারীদের জ্বালাও -- পোড়ানোর আগুন থেকে দুর্ঘটনা হতে পারে, এই ভয়ে সেখানের বিদ্যুত লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ফেরার পথে ফুলবাড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আহত কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ সাঁওতালও রয়েছেন। নাম বিস্তৃত সেই সাওঁতাল যুবক যখন তীর - ধনুক নিয়ে শত শত সাঁওতাল নারী - পুরুষের মূল আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা বলছিলেন, তখন নার্স আর ওয়ার্ড বয়রা ভীড় জমান তার কথা শুনতে। আমি বলি, গুলি যদি পায়ে না লেগে বুকে লাগতো? সাওঁতাল বলেন, আমি তো একদিন মরবোই। গুলিতে আমি মারা গেলেও যদি এশিয়া এনার্জি এখান থেকে পালায়, তাহলে অন্তুত আমার ছেলেমেয়ে না খেয়ে মরবে না। এই ভেবেই আমরা মিছিলে গিয়েছি।
সাঁওতাল যুবকের এই সাহসী বক্তব্যকে নার্স - ওয়ার্ড বয়রা শাবাশ, শাবশ বলে স্বাগত জানায়। তারা তার পিঠ চাপড়ে দেয়।
রক্তের ধারা পেছনে যায় না
ফেরার পথে ট্যাক্সি ক্যাবে বসেই মোবাইল ফোনে অফিসে ছোট্ট করে জানাই আপডেট নিউজ। দিনাজপুরে পৌঁছে দ্রুত বিস্তারিত নিউজ লিখতে বসে যাই। বিকালের আলো তখন মরে আসছে।
নিউজ মেইল করে একটি হোটেল খুঁজে স্নানাহার করে নেই। ব্যাস্ততার কারণে দুপুরে ভাত খাওয়া হয়নি। আগের দিনের কর্মক্লান্তি, নাইট জার্নির ধকল আর সেদিন দিনভর ফুলবাড়িতে রোদে তেঁতেপুড়ে সমস্ত শরীর যেনো ভেঙে আসতে চায়।
সন্ধ্যার একটু পরে সেই কলেজ ছাত্র গাইড তাজ মিসড্ কল দেয়। খুবই উত্তেজিত গলা, বিপ্লব দা, আমরা এশিয়া এনার্জির ল্যাবরেটরীতে আগুন দিয়েছি। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। পুলিশ - বিডিআর সবাই পালিয়েছে। আমি ওসি - এসপির সঙ্গে কথা বলে খবরটি সম্পর্কে নিশ্চিত হই। তারা জানান, রাস্তা বন্ধ থাকায় দমকল বাহিনীর গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারছে না। পুরো ল্যাবরেটরী এরই মধ্যে পুড়ে ছাই। আমি আবারো অফিসে টেলিফোনে জানাই সেদিনের সর্বশেষ আপডেট নিউজ। সাজেস্ট করি, আমার নিউজের শিরোনাম দিতে, অগ্নিগর্ভ ফুলবাড়ী! অফিস আমার কথা রাখে।
বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে
এর পর আবারো সেই ট্যাক্সি ক্যাবে খানিকটা পথ এগিয়ে বাকিটা পথ হেঁটে হেঁটে প্রচন্ড তাপদাহের ভেতর আন্দোলনের আপডেট নিউজ করা।
শহীদ তরিকুলের বাসায় পৌঁছে ওর মা’র ভাষ্য নিয়ে সাইট স্টোরি করা। আহতদের নিয়ে তৈরি করি আরেকটি হিউম্যান স্টোরি।
সে সময় চোখের সামনে দেখি, ফুলবাড়ির গণবিদ্রোহের সংগঠিত আগুন। এশিয়া এনার্জির কর্মকর্তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আন্দোলনকারীরা আগুন দেয়। এসব বাড়ির মালিকরা জীবন বাঁচাতে আগেই স্বপরিবারে পালিয়ে বেঁচেছে। ফুলবাড়ি থানার সামনেই লুঙ্গী পরা আম জনতা রাস্তার ওপরে এসব বাড়ি থেকে ফ্রিজ, টেলিভিশন আর দামি দামি আসবাব আছড়ে ভাঙে, আগুন দেয়। কোথাও কোনো লুঠপাট হয়নি।
এক সময় থানার ভেতর থেকে হ্যান্ড মাইকে ওসির অসহায় আর ভীত - সন্ত্রস্ত গলা ভেসে আসে:
গণআন্দোলনের ওই উত্তাল মূহুর্তেও সাধারণ মানুষের হিউমার আমাকে ভাবায়। রাস্তার ওপর কাঠ আর বাতিল খবরের কাগজে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বিক্ষোভ করছিলো কয়েকজন। কালো ধোঁয়া তৈরি করতে সবুজ পাতাসহ গাছের ডাল ভেঙে দেওয়া হয় আগুনে। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন জোড়া মুরগি হাতে এক বুড়ো মতোন একজন। তিনিও হাতের মুরগি এক পাশে নামিয়ে রেখে কয়েকটি কাঁচা পাতা ছিঁড়ে আগুনে দেন। তো যুবকরা মশকরা করে স্থানীয় ভাষায় বলে ওঠেন, ও চাচা মিয়া, পাতা না দিয়া আগুনে মুরগি দিলে ধোঁয়া তো আরো ভাল হইতো!
চাচা বলেন, হ আর তোমরাও গরমা গরম রোস্ট খাইতে পারতা! কিন্তু তোমার চাচি আমারে আর ঘরে ঢুকতে দিবো না!...এর পর সমস্বরে সকলের অট্টহাস্য।
যে গল্পের শেষ নাই
এরপরের ঘটনা মোটামুটি সবারই জানা। রাজশাহীর মেয়র মিনু ফুলবাড়িতে এসে বেশ রাতে একটি নাটুকে চুক্তি করেন আন্দালনকারীদের সাথে। ওই চুক্তিটি সে সময় আদৌ সরকার পক্ষের সঙ্গে সাক্ষরিত হয়েছিলো কী না, এ প্রশ্ন তখনই উঠেছিলো।
এই বিতর্কের বাইরে ফুলবাড়িতে কয়লা খনি খনন প্রকল্পের কাজ গুটিয়ে নিলেও চুক্তি মেনে এশিয়া এনার্জিকে এখনো এ দেশ থেকে বহিস্কার করা হয়নি। শুনতে পাই, আবারো তারা ফুলবাড়িতে খনন কাজ শুরু করার পায়তাড়া কষছে!
সামনের পথটুকু ওই- ই নিরাপত্তা পাস হিসেবে কাজ করে। তো পিকেটাররা গাছের গুড়ির ব্যারিকেড সরিয়ে পথ করে দেয়। পথে আরো দু/ একটি এরকম বাধা -- বিপত্তি ঠেলে গাড়ি এগিয়ে চলে।
ফুলবাড়ির একটু আগেই গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হয়। লোহার একটি ব্রিজের কয়েকটি পাটাতন খুলে ফেলায় পথ বন্ধ। ব্রিজের পাশেই এক জায়গায় শুকনো রক্তের দাগ। ইটের টুকরো দিয়ে সেই স্থানটি ঘেরে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের দিনই সেখানে পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন ফুলবাড়ির তিনজন শহীদের একজন কলেজ ছাত্র তরিকুল।
পাশেই জটলা করছেন কয়েকজন আন্দোলনকারী সাধারণ মানুষ। ব্রিজের ওপারে বিশাল মিছিল হচ্ছে। লাঠিশোটা হাতে হাজার হাজার মানুষ। মিছিলের সামনে গ্রামের বউ - ঝি’ রা। মিছিল থেকে রণ হুংকার দেওয়া হয়,
এশিয়া এনার্জির দালালরা হুঁশিয়ার, সাবধান! ক্ষেপেছে রে ক্ষেপেছে, ফুলবাড়ি ক্ষেপেছে! জেগেছে রে জেগেছে, ফুলবাড়ি জেগেছে!
আমি দ্রুত গাড়িটিকে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে ফুলবাড়ি আন্দোলনের কয়েকজন নেতার ভাষ্য নেই। আরো কয়েক ঘন্টা আন্দোলনকারীদের মিছিল - বিক্ষোভ, ফুলবাড়ির মোড়ে মোড়ে টায়ার পোড়ানো দেখি। আমাকে আবার বিকেলের মধ্যে দিনাজপুর পৌঁছতে হবে। অনির্দিষ্ট হরতালের কারণে ফুলবাড়ির সমস্ত দোকান -- পাট বন্ধ। আন্দোলনকারীদের জ্বালাও -- পোড়ানোর আগুন থেকে দুর্ঘটনা হতে পারে, এই ভয়ে সেখানের বিদ্যুত লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ফেরার পথে ফুলবাড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আহত কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ সাঁওতালও রয়েছেন। নাম বিস্তৃত সেই সাওঁতাল যুবক যখন তীর - ধনুক নিয়ে শত শত সাঁওতাল নারী - পুরুষের মূল আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা বলছিলেন, তখন নার্স আর ওয়ার্ড বয়রা ভীড় জমান তার কথা শুনতে। আমি বলি, গুলি যদি পায়ে না লেগে বুকে লাগতো? সাওঁতাল বলেন, আমি তো একদিন মরবোই। গুলিতে আমি মারা গেলেও যদি এশিয়া এনার্জি এখান থেকে পালায়, তাহলে অন্তুত আমার ছেলেমেয়ে না খেয়ে মরবে না। এই ভেবেই আমরা মিছিলে গিয়েছি।
সাঁওতাল যুবকের এই সাহসী বক্তব্যকে নার্স - ওয়ার্ড বয়রা শাবাশ, শাবশ বলে স্বাগত জানায়। তারা তার পিঠ চাপড়ে দেয়।
রক্তের ধারা পেছনে যায় না
ফেরার পথে ট্যাক্সি ক্যাবে বসেই মোবাইল ফোনে অফিসে ছোট্ট করে জানাই আপডেট নিউজ। দিনাজপুরে পৌঁছে দ্রুত বিস্তারিত নিউজ লিখতে বসে যাই। বিকালের আলো তখন মরে আসছে।
নিউজ মেইল করে একটি হোটেল খুঁজে স্নানাহার করে নেই। ব্যাস্ততার কারণে দুপুরে ভাত খাওয়া হয়নি। আগের দিনের কর্মক্লান্তি, নাইট জার্নির ধকল আর সেদিন দিনভর ফুলবাড়িতে রোদে তেঁতেপুড়ে সমস্ত শরীর যেনো ভেঙে আসতে চায়।
সন্ধ্যার একটু পরে সেই কলেজ ছাত্র গাইড তাজ মিসড্ কল দেয়। খুবই উত্তেজিত গলা, বিপ্লব দা, আমরা এশিয়া এনার্জির ল্যাবরেটরীতে আগুন দিয়েছি। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। পুলিশ - বিডিআর সবাই পালিয়েছে। আমি ওসি - এসপির সঙ্গে কথা বলে খবরটি সম্পর্কে নিশ্চিত হই। তারা জানান, রাস্তা বন্ধ থাকায় দমকল বাহিনীর গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারছে না। পুরো ল্যাবরেটরী এরই মধ্যে পুড়ে ছাই। আমি আবারো অফিসে টেলিফোনে জানাই সেদিনের সর্বশেষ আপডেট নিউজ। সাজেস্ট করি, আমার নিউজের শিরোনাম দিতে, অগ্নিগর্ভ ফুলবাড়ী! অফিস আমার কথা রাখে।
বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে
এর পর আবারো সেই ট্যাক্সি ক্যাবে খানিকটা পথ এগিয়ে বাকিটা পথ হেঁটে হেঁটে প্রচন্ড তাপদাহের ভেতর আন্দোলনের আপডেট নিউজ করা।
শহীদ তরিকুলের বাসায় পৌঁছে ওর মা’র ভাষ্য নিয়ে সাইট স্টোরি করা। আহতদের নিয়ে তৈরি করি আরেকটি হিউম্যান স্টোরি।
সে সময় চোখের সামনে দেখি, ফুলবাড়ির গণবিদ্রোহের সংগঠিত আগুন। এশিয়া এনার্জির কর্মকর্তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আন্দোলনকারীরা আগুন দেয়। এসব বাড়ির মালিকরা জীবন বাঁচাতে আগেই স্বপরিবারে পালিয়ে বেঁচেছে। ফুলবাড়ি থানার সামনেই লুঙ্গী পরা আম জনতা রাস্তার ওপরে এসব বাড়ি থেকে ফ্রিজ, টেলিভিশন আর দামি দামি আসবাব আছড়ে ভাঙে, আগুন দেয়। কোথাও কোনো লুঠপাট হয়নি।
এক সময় থানার ভেতর থেকে হ্যান্ড মাইকে ওসির অসহায় আর ভীত - সন্ত্রস্ত গলা ভেসে আসে:
ভাইসব, ভাইসব, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যান। আমরা আপনাদের পক্ষে আছি। শুধু থানার কোনো ক্ষতি করবেন না। পুলিশ -- জনতা ভাই ভাই! ...
গণআন্দোলনের ওই উত্তাল মূহুর্তেও সাধারণ মানুষের হিউমার আমাকে ভাবায়। রাস্তার ওপর কাঠ আর বাতিল খবরের কাগজে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বিক্ষোভ করছিলো কয়েকজন। কালো ধোঁয়া তৈরি করতে সবুজ পাতাসহ গাছের ডাল ভেঙে দেওয়া হয় আগুনে। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন জোড়া মুরগি হাতে এক বুড়ো মতোন একজন। তিনিও হাতের মুরগি এক পাশে নামিয়ে রেখে কয়েকটি কাঁচা পাতা ছিঁড়ে আগুনে দেন। তো যুবকরা মশকরা করে স্থানীয় ভাষায় বলে ওঠেন, ও চাচা মিয়া, পাতা না দিয়া আগুনে মুরগি দিলে ধোঁয়া তো আরো ভাল হইতো!
চাচা বলেন, হ আর তোমরাও গরমা গরম রোস্ট খাইতে পারতা! কিন্তু তোমার চাচি আমারে আর ঘরে ঢুকতে দিবো না!...এর পর সমস্বরে সকলের অট্টহাস্য।
যে গল্পের শেষ নাই
এরপরের ঘটনা মোটামুটি সবারই জানা। রাজশাহীর মেয়র মিনু ফুলবাড়িতে এসে বেশ রাতে একটি নাটুকে চুক্তি করেন আন্দালনকারীদের সাথে। ওই চুক্তিটি সে সময় আদৌ সরকার পক্ষের সঙ্গে সাক্ষরিত হয়েছিলো কী না, এ প্রশ্ন তখনই উঠেছিলো।
এই বিতর্কের বাইরে ফুলবাড়িতে কয়লা খনি খনন প্রকল্পের কাজ গুটিয়ে নিলেও চুক্তি মেনে এশিয়া এনার্জিকে এখনো এ দেশ থেকে বহিস্কার করা হয়নি। শুনতে পাই, আবারো তারা ফুলবাড়িতে খনন কাজ শুরু করার পায়তাড়া কষছে!
_________________________
এ মাটির নিচে কালো কয়লার খনি
বুকের রক্ত শুকালেও হয় কালো
কয়লা বাঁচাতে যে কিশোর দিল প্রাণ
ফুলবাড়ী তুমি শহীদের কথা বল।
কয়লা বাঁচাতে যারা দিয়েছিল প্রাণ
ফুলবাড়ী তুমি লড়াইয়ের কথা বল।
লাখো মানুষের ভিটে উচ্ছেদ করে
বিষাক্ত করে আকাশ বাতাস পানি
মরুভূমি করে ফসলের সোনা জমি
আমার কয়লা করে দেবে রপ্তানি!!
বিদেশি শকুন আর দেশি তস্কর
জোট গড়ে তোলে লুটেরার দল মিলে
কিন্তু লড়াকু জনতার দলই ভারি
ফুলবাড়ী তুমি প্রাণ দিয়ে রুখে দিলে।
ফুলবাড়ী তুমি ইতিহাস গড়েছিলে,
ফুলবাড়ী তুমি লড়াইয়ের কথা বল।
ফুলবাড়ী তুমি সাহসী দিনাজপুর
ইয়াসমিনের গুলি বেঁধা সাত ভাই
তোমার দিকেই চলেছে এই মিছিল
গানে আর সুরে তোমাকে সেলাম জানাই।।
*২০১০ সালে জাতীয় কমিটির ঢাকা-দিনাজপুর-ফুলবাড়ী লংমার্চ উপলক্ষে লেখা।
সুর দিয়েছে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
বুকের রক্ত শুকালেও হয় কালো
কয়লা বাঁচাতে যে কিশোর দিল প্রাণ
ফুলবাড়ী তুমি শহীদের কথা বল।
কয়লা বাঁচাতে যারা দিয়েছিল প্রাণ
ফুলবাড়ী তুমি লড়াইয়ের কথা বল।
লাখো মানুষের ভিটে উচ্ছেদ করে
বিষাক্ত করে আকাশ বাতাস পানি
মরুভূমি করে ফসলের সোনা জমি
আমার কয়লা করে দেবে রপ্তানি!!
বিদেশি শকুন আর দেশি তস্কর
জোট গড়ে তোলে লুটেরার দল মিলে
কিন্তু লড়াকু জনতার দলই ভারি
ফুলবাড়ী তুমি প্রাণ দিয়ে রুখে দিলে।
ফুলবাড়ী তুমি ইতিহাস গড়েছিলে,
ফুলবাড়ী তুমি লড়াইয়ের কথা বল।
ফুলবাড়ী তুমি সাহসী দিনাজপুর
ইয়াসমিনের গুলি বেঁধা সাত ভাই
তোমার দিকেই চলেছে এই মিছিল
গানে আর সুরে তোমাকে সেলাম জানাই।।
*২০১০ সালে জাতীয় কমিটির ঢাকা-দিনাজপুর-ফুলবাড়ী লংমার্চ উপলক্ষে লেখা।
সুর দিয়েছে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
*ছবি: (c) Taslima Akhter
No comments:
Post a Comment