[নয়ের দশকে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ সরকারের পতন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সেই রক্তাক্ত আন্দোলনের শ্লোগানার, কমরেডের লাশ ও লিটল ম্যাগের ভুত মাথার ভেতর বয়ে বেড়ানোর কালে সাংবাদিকতার প্রথম পাঠে মুখোমুখি হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল কয়েক গুনিজনের। তারা ছিলেন আমাদের সময়ের নায়ক।
এতো বছর পরে নিদানকালে অনলাইনে খুঁজে পেলাম আমার নেওয়া মহতি লেখক আহমদ ছফার একটি সাক্ষাৎকার। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে সাপ্তাহিক “প্রিয় প্রজন্মে”, পরে “আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারগসমগ্র” গ্রন্থে (সম্পাদনা নূরল আনোয়ার, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৯) স্থান করে নেয় এই কথোপকথন, বলা ভাল যেন বাঘবন্দী খেলা!
এখনো মনে আছে, আহমদ ছফার ঢাকার পরিবাগের বাসার ছোট্ট ড্রয়িং রুমে ধুমায়িত রং চায়ের কাপ হাতে রেকর্ডবন্দী হতে থাকে কথোপকথন। একটি সাঁওতাল ছেলে আমাদের চা-নাশতা বেড়ে দিচ্ছিল। ছফা তাকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় করিয়ে দেন। কথোপকথনটুকু দুদফায় নিতে হয়েছিল।
ছফার সেই কথোপকথনটুকু এখানে উপস্থাপনা করা হচ্ছে। অনলাইনে খুঁজে পাওয়া ইমেজ টেকস্ট ফর্মের সেই সাক্ষাৎকারটি আবারো ইউনিকোডে টাইপ করতে করতে যেন লুঙ্গি-স্যান্ডো গেজ্ঞি পরা ঘরোয়া মুডের ছফাভাইকে দেখতে পাই। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উচ্চারণ মিশ্রিত শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা লেখকের কন্ঠসর যেন ভেসে আসছে। প্রিয় পাঠক, চলুন আহমদ ছফার কাছে।]
বিপ্লব রহমান : আপনি খেলালেখির জগতে কিভাবে…?
আহমদ ছফা : খুব মজার ঘটনা। ছোট বেলায় আমাদের গ্রামে আমার চাইতে একটু বড় একটি ছেলের কবিতা কাজজে ছাপা হয়। তখন জিন্নাহ সাহেব সবেমাত্র মারা গিয়েছেন। আমার বাবা তখন আমাকে ডেকে বললেন, তুই কি এমন কবিতা লিখতে পারি সা? আমি বললাম, খুব পারি। তারপর আমি লিখলাম “রামচন্দ্রের পিতৃভক্তি“ বলে একটি পদ্য, দুটি লাইন এখনো মনে আছে, “যেজন পিতামাতার প্রতি নাহি করে ভকতি/পরকালে হবে তার নরকে বসতি”…দ্যাট ওয়াজ দ্যা বিগিনিং, জিন্নার মৃত্যু আমাকে তখন আহত করেনি। তারপর ক্লাস এইট অবধি কবিতা-টবিতা লিখেছি। ক্লাস নাইনে পড়ি…তখন বোধহয় আমি কম্যুনিস্ট পার্টির লোকজনের সঙ্গে মিশে গেলাম। আমার ধারণা হল, সাহিত্য করা এখন আমার কাজ না। আমার কাজ হচ্ছে একটা বিপ্লব করা। তারপর ইউনিভার্সিটিতে এসে আবার লিখতে শুরু করি।
বিপ্লব: প্রথম দিকে কী শুধুই কবিতা লিখতেন, না উপন্যাসও?
ছফা: এইট-নাইন পর্যন্ত আমি কবিতাই লিখেছি। সেভেনটির দিকে আমার প্রথম উপন্যাস বের হয়।
বিপ্লব: তার নাম কী?
ছফা: “সূর্য তুমি সাথী”—সেটা আমি চ্যালেঞ্জ করে লিখি। তখন আমাদের একটা ফ্লিম সোসাইটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান ছিল। আমাদের এক বন্ধু ছিল জামাল খান, ওয়ান অব দ্যা মোস্ট ব্রিলিয়ান্ট বয়, সে আমাদের বললো, মাণিক বন্দোপধ্যায়ের “পদ্মা নদীর মাঝি”র মতো উপন্যাস লেখা যায় কিনা—আমাদের এই ঢাকায়? তখন “সংবাদ” এর যে সাহিত্য সাময়িকী—সেটি খুব রিচ ছিল। রণেশ দাসগুপ্ত এটা চালাতেন। চ্যালেঞ্জটা ছিল ১০০ টাকার—তখন ১০০ টাকা কিন্তু অনেক টাকা। আমাদের যদি কেউ লিখে এটা সংবাদে ছাপতে পারে, সে টাকাটা পাবে। “সূর্য তুমি সাথী”র প্রথম কিস্তি আমি তখন সংবাদে ছাপতে দিলাম এবং সেটা ঠিকই সেখানে ছাপা হল।
বিপ্লব: ’৭৫ এর জানুয়ারিতে আপনি মুজিবী দু:শাসনের বিরুদ্ধে “জল্লাদ সময়” নামে একটি কবিতার বই লেখেন। সেই বইয়ের “২৫শে বৈশাখ” কবিতায় আপনি লিখেছেন, “আমার কবিতা হয়ে উঠুক বল্লমের ফলা।” পরবর্তীতে কী তাই হয়েছিল?
ছফা: পরবর্তীতে আমি আরো একটি কবিতার বই লিখেছি, “দু:খের দিনের দোহা”, সেখানেও বল্লমের ফলার মত একটি কবিতা আছে। তাছাড়া একটি “একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থণা” বলে একটা কবিতা লিখেছি। সেটা অবশ্যই আমার ওয়ান অব দ্যা বেস্ট বই।
বিপ্লব: সেটা কতো সালে?
ছফা: এটা বেরিয়েছে বোধহয় সেভেন্টি সেভেনে। তারপর তো “ফাউস্ট” বের করলাম।
বিপ্লব: “ওঙ্কার” – এর মতো একটি কালজয়ী উপন্যাস আপনি লিখেছেন, যেখানে আমরা দেখি যে, ক্ষুদ্র পরিসরে বিশাল ক্যানভাসের সহাবস্থান, এ ধরণের উপন্যাস আর লিখছেন না বা আপনার বইগুলো পুনমূদ্রণ করার উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন?
ছফা: এর কারণ হিসেবে বলা যায়, আমার জীবন বেশ খানিকটা এলোমেলো। তবে আমি কিন্তু “ওঙ্কার” এর পরে আরো তিনটি উপন্যাস লিখেছি। বিষয় গৌরবে এগুলো “ওঙ্কার” এর মতো না হলেও “ওঙ্কার’ এর চেয়ে আরো সিরিয়াস লেখা। তাছাড়া বাংলাদেশের উত্থান নিয়ে আরেকটি উপন্যাস আমি লিখেছি, সেটার নাম হচ্ছে “অলাতচক্র”। লেখাটা “নিপুন” পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় খানিকটা ছাপা হয়েছে। বইটা প্রায় পুরোটাই ছাপা হয়ে গেছে “মুক্তধারা” থেকে। শুধু লাস্ট ত্রিশ পাতা লেখা বাকি। ওই ত্রিশ পাতা আমি লিখতে পারছি না। কী লিখবো আমি জানি না। প্রতি সপ্তায় চিত্তরজ্ঞনবাবু আমাকে তাগাদা দেন। কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠে না। আর আমার সব বই যে পাওয়া যায় না, তা কিন্তু নয়। হয়তো আপনি বলতে পারেন, আমার অনেক বই পাওয়া যায় না। ভাবছি, এগুলো আবার প্রকাশের উদ্যোগ নেব।
বিপ্লব: “ফাউস্ট” অনুবাদের পর দেশে-বিদেশে আপনি কী ধরনের সন্মান এবং সন্মানী পেয়েছেন, তা কি আমাদের বলা যাবে?
ছফা: ওয়েল। লেখকরা সকলে দেশের কথা বলতে গিয়ে দেশের নিন্দা করে। কিন্তু সন্মানী যদি নাও পাই, তবু দেশের নিন্দা করতে আমার খুব কষ্ট হয়। তারপরেও সত্য যদি বলতে হয়, তাহলে বলতে হয় যে, “ফাউস্ট” অনুবাদ করার পর আমার দেশের বন্ধু-বান্ধব কাউকে আমি ম্যানাসক্রিপ্টটাও শোনাতে পারিনি। তার কারণ তাদের সময় এতো কম, কিন্তু উচ্চতা এতো বেশী যে, তারা সেটা ধারণ করতে পারে না। অর্থাৎ তাদের সে ধরনের সংবেদনশীলতাই নেই।
ছাপার ব্যাপারটা যখন আসল, তখন আমি বাংলা একাডেমিতে ছাপতে দিলাম। ওরা প্রায় পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বইটা ছাপতে রাজি হল না। তারপর জার্মান অ্যামবেসি আমাকে যথেষ্ট ফিন্যান্স করেছে। ওরা তারপর আমাকে প্রায় দুই লাখ টাকা দিয়েছে।
কবির চৌধুরী বইটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। তারপরে বইটা নিয়ে এখানে কোনো আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। সে জন্য আমার কোনো দু:খ নেই। কেননা, এধরনের কাজের আলোচনা-সমালোচনা করার জন্য এ দেশে তেমন কেউ আছেন বলে আমার মনে হয় না। দেশের রেডিও-টিভিতে আমি কখনো যাইনি।
বিপ্লব: আপনি ভবিষ্যতে এ ধরণের অনুবাদের কাজ আরো করবেন কী?
ছফা: না, এতে আমার কষ্ট হয়। আমি পৃথিবীতে গ্যেটের অনুবাদক হিসেবে পরিচিতি পেতে চাই না। আমার নিজের লেখাতেই আমার আসল পরিচয়।
বিপ্লব: গ্যেটে ছাড়া অন্য কোনো লেখক?
ছফা: অন্য কোনো লেখকের লেখাও আমি অনুবাদ করতে চাই না। কেননা আমার লেখাই এখন অনুবাদ করার সময় এসে গেছে।
বিপ্লব: আপনি কী কখনো কলাম লিখতেন?
ছফা: একসময়ে লিখেছি। এখন ইচ্ছে করে না। “কাগজ” এ (”সাপ্তাহিক খবরের কাগজ”) একবার একটা প্রতিক্রিয়া লিখতে হয়েছিল। কিছুদিন আগে লিখতাম “উত্তরণ” এ।
বিপ্লব: “উত্তরণ” প্রসঙ্গে কিছু বলবেন?
ছফা: “উত্তরণ” আমরা বের করেছিলাম—অর্থাভাবে এটা বন্ধ হয়ে যায়। এখন টাকা-পয়সা নেই, “উত্তরণ” আবার বের করার কথা চিন্তা করছি। কবে বের করতে পারবো জানি না। আমি বুঝতে পারি না, যে দেশ একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করতে পারে না, সে দেশে “রাষ্ট্র”, “সমাজ” এগুলোর কোনো অর্থ হয়? হাজার হাজার পত্রিকা বের হচ্ছে, এগুলো ছুঁয়ে দেখতে ঘেন্না করে, বর্ণমালার এতো অপচয়, কাগজের এতো অপচয়!
বিপ্লব: আপনি কী লেখালেখির বিষয়টিতে পরিমাণের চেয়ে গুণকে বেশী প্রাধান্য দেন?
ছফা: আমি পরিমান বা সংখ্যাকে প্রাধান্য দেই না। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের সংখ্যা মাত্র কয়েকটা, কিন্তু সুনীল গাঙ্গুলীর প্রায় চারশ। অথচ বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমবাবুকে কেউ অতিক্রম করতে পেরেছেন? লেখকের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে মেধাবী রচনা লেখা। লেখকের যদি লেখার প্রতি কমিটমেন্ট না থাকে… আমাদের দেশে এক ধরনের লেখক আছে, যারা সমাজ সমাজ বলে চিল্লায়, বাট দে আর নট কমিটেড। লেখার মধ্যে রুচি এবং মানুষের গভীর ক্ষুধা এগুলো তুলে ধরতে হবে।
বিপ্লব: ভারতে যেমন “দেশ”সহ আরো নানান স্ট্যাবলিশমেন্টের পক্ষের পত্রিকা বিরোধী লিটল ম্যাগাজিন গ্রুপগুলো লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন পরিচালনা করছে, এ দেশেও তেমনি স্ট্যাবলিশমেন্ট বিরোধী ধারার আন্দোলন গড়ে তোলাও লেখকের দায়িত্ব, তা কী আপনি মনে করেন?
ছফা: প্যারালাল সাহিত্য অবশ্যই সৃষ্টি করতে হবে। বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রেডিও, টেলিভিশন [বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভি, দুইই সরকারি, তখনো বেসরকারি রেডিও-টিভি চ্যানেল হয়নি] – সব মিলিয়ে এমন একটা দুষ্টচক্র তৈরি করেছে – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যিনি চাকরি করেন, সেই ব্যক্তিই আবার বাংলা একাডেমি থেকে বই লেখেন, ইত্তেফাকে লেখেন, দৈনিক বাংলায় লেখেন [সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত দৈনিক, সাবেক নাম “দৈনিক পাকিস্তান”, বিশের দশকে বিলুপ্ত], রেডিও-টিভিতে যান। এটা একটা দুষ্টচক্র। অথচ দেখা যাবে যে এরা হয়তো শতকরা পাঁচভাগ লোক। এরাই শিল্প-সাহিত্যকে কন্ট্রোল করছেন, যে কোনো গভর্নমেন্ট আসছে – এদের অবস্থা কিন্তু নড়ে না। এ জন্যই এর প্যারালাল ধারা তৈরি করা দরকার।
বিপ্লব: আপনি কী আপনার ব্যক্তিগত দর্শন, রাজনৈতিক দর্শন আমাদের বলবেন?
ছফা: হ্যাঁ, নিজের ব্যক্তিগত দর্শন বলতে আমি বুঝি মানুষকে ভালবাসা। আর রাজনৈতিক দর্শন? রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে, ম্যাকসিমাম মানুষ যেন তার সবটুকু অধিকার উপভোগ করতে পারে।
বিপ্লব: উপযোগবাদ?
ছফা: উপযোগবাদ ঠিক না। সেখানে মানুষ যেন উপভোগ করতে পারে, প্রয়োগ করতে পারে তার সবকিছু।
বিপ্লব: কমিউনিস্ট পার্টি বা কৃষক সমিতির সাথে আপনার বিচ্ছিন্নতা হলো কীভাবে?
ছফা: সিক্সটি সেভেন-এইটের পরেও কমিউনিস্টদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীতে কমিউনিজমের প্রতি আমি আস্থা হারিয়ে ফেলি। কমিউনিস্ট পার্টি সে সময় যে ধরনের আনুগত্যের দাবি করে, সেটা আমার কাছে মানবতার অবমাননা বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া আমার নেচারও সে রকম না। এমএন রায়ের বই পড়ে আমার আনুগত্য চলে যায়। তার আগে মাও সেতুঙের কোটেশন অনুবাদ করেছি।
বিপ্লব: সেটা পিকিং থেকে ছাপা হয়েছিল?
ছফা: না, না – পিকিংঅলারা আমারটাই চুরি করে ছেপেছে। এই তো হচ্ছে অবস্থা। কমিউনিজম মানুষকে নতুনভাবে দাসত্ব করতে শেখায়। কিন্তু তারপরেও মার্কস পৃথিবীতে একজন মহান ব্যক্তি হিসেবে থেকে যাবেন। সামন্ততন্ত্রের চেয়ে উন্নত কোনো বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আগে সমাজতন্ত্রকে দেখানো হতো। কিন্তু পৃথিবী এখন আরেকট অরবিটে চলে গেছে—পৃথিবী এখন আরেকটা কক্ষের মধ্যে ঢুকে গেছে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সেই দেশগুলোকে কিভাবে তুলনা করা যাবে – সেটা এখনো সেট করা হয়নি।
বিপ্লব: কিন্তু শ্রেণীবৈষম্য, শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব?
ছফা: একদম বাজে।
বিপ্লব: তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের লেখা পড়েন?
ছফা: হ্যাঁ, পড়ি।
বিপ্লব: এদের মধ্যে প্রতিভাবান কাউকে চোখে পড়ে?
ছফা: সাজ্জাদ শরিফ না কি নাম – একে খুব মেধাবী বলে মনে হয়।
বিপ্লব: এদের প্রতি কোনো উপদেশ?
ছফা: (মাথা দিয়ে না-সূচক উত্তর দান।
বিপ্লব: শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে প্রগতির ভেকধারী ভক্তদের আপনি কিভাবে চিহ্নিত বা উৎখাত করতে চান?
ছফা: ভেক ধরলে আপনা-আপনি উৎখাত হয়ে যাবে।
বিপ্লব: কিন্তু মুখোশ উন্মোচন না করলে কী কিছু করা যাবে?
ছফা: এগুলো আমি করতে পারবো না, সেজন্য অন্যলোক আছে।
বিপ্লব: আপনি প্রতিভাবান, কিন্তু পলায়নবাদী, আত্মকেন্দ্রিক এবং অস্তিত্ববাদী একজন লেখক – মন্তব্য করুন।
ছফা: না, আমি তা নই। পলায়নবাদী লেখক হলে শেখ মুজিবকে চ্যালেঞ্জ করে লিখতে পারতাম না। আইউব খানের সময় লেখক শিবির (বাংলাদেশে লেখক শিবির, সাংস্কৃতিক সংগঠন, এখন প্রায় বিলুপ্ত) করতে পারতাম না। ’৭৫ এর পর উমর সাহেব (বদরুদ্দিন উমর) এবং শরীফ সাহেব (ড. আহমদ শরীফ) এটাকে হাইজ্যাক করেন। তারা সেখানে লেখকদের কোনো অবস্থান রাখেন নি।
বিপ্লব: হুমায়ুন আহমেদ তার একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, আপনারা কয়েক বন্ধু নাকি একবার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, লেখার জন্য জীবনকে উৎসর্গ করবেন?
ছফা: হুমায়ুন কথাটা কিভাবে বলেছে জানি না। তবে সে অনেক সময় অনেক কথা কল্পনা করে বলে। বলতে ভাল লাগে, এ জন্য বলে। তারপরেও দেশের সাহিত্যের জন্য বার বার জন্মালে বার বার মরতে রাজি আছি।
বিপ্লব: আমরা জানি যে, শিল্পী এসএম সুলতানকে প্রধানত আপনিই বাংলাদেশে পরিচিতি করিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন সময় আপনি তাকে সাহায্য সহযোগিতা, বন্ধুত্ব ইত্যাদি দিয়েছেন। তো এসএম সুলতানের শিল্পকর্ম এবং ব্যক্তি সুলতানকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
ছফা: ওয়েল। সুলতানের সঙ্গে চারিত্রিকভাবে আমার দূরত্ব অনেক। তবু আমি ফিল করি, সুলতান অন্তত একশ বছরের মধ্যে ওয়ান অব দ্যা টপ। তিনজন বাঙালি আছেন এখন পৃথিবীতে, যারা খুব বেশী বিখ্যাত। তারা হচ্ছেন – সত্যজিৎ রায়, রবিশঙ্কর এবং এসএম সুলতান।
বিপ্লব: আমরা জানি যে, আপনি গানও লেখেন। এ প্রসঙ্গে কিছু বলবেন কী?
ছফা: আমার ধারণা, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গীতিকারদের মধ্যে আমার একটা জায়গা হবে।
বিপ্লব: একটু আগেই আপনি বলেছেন যে, আপনার বই অনুবাদ করার সময় এসে গেছে এবং শিল্পী জগতে আপনার একটা ভাল জায়গা হবে বলে আপনি মনে করেন। এই প্রেক্ষিতে আমরা বলছি যে, আপনি আসলে সুপিরিয়টি কমপ্লেক্সে ভুগছেন। মন্তব্য করুন।
ছফা: আমার কোনো কমপ্লেক্স নেই। তাছাড়া আমার বই তো অনুবাদ হচ্ছেও। সে জন্য অবশ্য গর্ব করার কিছু নেই।
বিপ্লব: বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যত কী?
ছফা: এই জাতির মধ্যে অনেক ভাঙচুর হবে, তারপর হয়তো মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
বিপ্লব: শোষণমূলক ব্যবস্থার কী উচ্ছেদ হবে?
ছফা: শোষণমূলক ব্যবস্থা বলতে আমাদের রাজনীতিবিদরা যেভাবে দেখেন, আমি সেভাবে দেখি না।
বিপ্লব: কিভাবে দেখেন?
ছফা: কিভাবে দেখি তা বলার জন্য আমি একটা অর্থনীতির বই লিখেছি। বইটার নামও আমি এখন পর্যন্ত দেইনি।“উন্নয়নের অর্থনীতি” নামে দুই-একটি কিস্তি বোধহয় দুই-একটা কাগজে ছাপা হয়ে থাকবে। সেখানে আমি বলেছি, বাংলাদেশের প্রধানত দুটি সমস্যা – (১) এটা একটা দরিদ্র দেশ, (২) এর অর্থনীতি অনুন্নত। এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারলে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিবর্তন করা যাবে।
বিপ্লব: সেটা কী বর্তমান রাষ্ট্রের উচ্ছেদ বা আমূল পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব?
ছফা: রাষ্ট্রের উচ্ছেদ, শুনতে ভাল, কিন্তু সেটা এনার্কিজম হবে।
বিপ্লব: রাষ্ট্রব্যবস্থার উচ্ছেদের কথা কার্ল মার্কস বলেছেন। মার্কস একজন এনার্কিস্ট ছিলেন?
ছফা: মার্কসের কথা বলেই এটা মানতে হবে – এমন কোনো কথা আছে। মার্কস ইজ নট এ প্রফেট। মার্কস নৈরাজ্যবাদী ছিলেন না। মার্কসের কমিউনিস্ট কান্ট্রি সর্বহারার রাষ্ট্রে পরিনত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে দেশগুলো ভাঙল স্টেটের সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের দ্বন্দ্বে।
বিপ্লব: মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সেতুং তো বিপ্লববাদী ছিলেন?
ছফা: মার্কস-এঙ্গেলস বিপ্লববাদী ছিলেন, লেনিন বিপ্লব করেছেন। কিন্তু স্ট্যালিন বিপ্লববাদী ছিলেন না। বিপ্লব অনেক সত্যিকে বিকশিত করে। স্ট্যালিন ছিলেন বিপ্লবের সবচেয়ে অজ্ঞ, সবচেয়ে নিষ্ঠুর, সবচেয়ে ফ্যাসিস্ট।
বিপ্লব: আপনি আসলে সর্বহারা বিপ্লবকে ভয় পান। মন্তব্য করুন।
ছফা: সর্বহারা বিপ্লবকে ভয় পাওয়ার কী আছে? তাছাড়া এখানে বিপ্লবটা করছে কে? বিপ্লবের কথা বলেন আপনার মতো কিছু শহুরেরা – যারা জীবনে হয়তো গ্রামকে চোখেও দেখেননি।
[সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রথম পর্ব এখানেই শেষ। চলে আসার উদ্যোগ নিতেই শেলফ থেকে থান ইট সমান একটি ইংরেজী বই (স্ট্যালিন প্রসঙ্গে জনৈক গবেষকের লেখা, নাম বিস্তৃত হওয়ায় বই বা লেথকের নাম উল্লেখ করা গেল না) বের করে পড়ার জন্য ধার দিতে চাইলেন ছফা। “ইংরেজীতে দুর্বল” এই কথা বলে শেষে পার পাওয়া গেল।
এরপর সাক্ষাৎকার গ্রহণের দ্বিতীয় পর্ব। একই ঘরে, এমনকি ধুমায়িত আদা চায়ের পেয়ালাসহ। সহজ ভঙ্গিতে পুনরায় কথামালার শুরু।]
বিপ্লব: আপনি পলায়নবাদী নন—এই প্রসঙ্গে আপনি এক পর্যায়ে বলেছেন যে, বদরুদ্দিন উমর ও ড. আহমদ শরীফ পরবর্তীত লেখক শিবিরকে হাইজ্যাক করে – এই পয়েন্টটা একটু পরিস্কার করে বলবেন?
ছফা: আসলে লেখক শিবির আমরা যখন করি – এটা পাকিস্তান আমলে…তখন উমর সাহেব একটা চিঠি লিখেছিলেন “দৈনিক পাকিস্তানে” লেখক শিবির প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। এটা বোধহয় ১৯৭১ সালের জানুয়ারির দিকে…না, ফেব্রুয়ারিতে। পরে যখন সেভেন্টি ওয়ানে তার ভূমিকাটা স্পষ্ট ছিল না।
বিপ্লব: তাদের ব্যক্তিস্বার্থ কী ছিল?
ছফা: ব্যক্তিস্বার্থ আর কিছু না, সর্দারী করা। আর উমর সাহেবরা লেখক শিবির নাম দিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটা এতকাল দাঁড় করিয়েছেন, ওতে না হয় লেখক, না হয় পলিটিশিয়ান সৃষ্টি। এটা এক ধরনের উমর সাহেবের ভ্যানেটি রক্ষা। উগ্র অহমিকা।
বিপ্লব: আপনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি চলে যাওয়ার পয়েন্টটা?
ছফা: চাকরি চলে যায়, আমি স্কলারশিপ ছেড়ে দিয়েছি। প্রথমে আমি বাংলা একাডেমিতে ছিলাম। ওখানে মাযহারুল ইসলাম ছিলেন ডিরেক্টার। উনি কলকতা থেকে অনেক টাকা-পয়সা চুরি করেছিলেন। আমরা তখন কলকাতার একটি কাগজে এর প্রতিবাদ করি। আমি একা নই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অজয় রায় – উনারও ছিলেন।তারপর তিনি যখন ডিরেক্টর হয়ে আসেন, গবেষণার জন্য বিলেত যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। তিনি প্রতিহিংসা বশত কিছু গ্রান্ট দিতে অস্বীকার করেন। এর এক পর্যায়ে পত্রিকাতে তার সঙ্গে আমার মস্ত বিতর্ক হয় এবং উমর সাহেবও অংশগ্রহণ করেন সেই বিতর্কে।
বিপ্লব: আপনার পক্ষে?
ছফা: হ্যাঁ। তারপর…
বিপ্লব: বদরুদ্দীন উমর তাহলে কেন আপনার পক্ষ নিলেন?
ছফা: এটা ’৭২ সালের ঘটনা। তারপরে…
বিপ্লব: তাহলে তার পরের ভূমিকা স্ববিরোধী ছিল?
ছফা: স্ববিরোধিতা অনেকের মত উমরের থাকাও বিচিত্র নয়। কিন্তু তিনি বড় মাপের মানুষ। সামনে তার দৃষ্টান্ত না থাকলে আমরা আসতে পারতাম না। গোঁয়ার একগুয়ে অহমিকাসম্পন্ন লোক, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিশেষ বোঝেন না।
বিপ্লব: বাংলাদেশে জনপ্রিয় লেখক কাদের বলে আপনি মনে করেন?
ছফা: জনপ্রিয় লেখক হচ্ছেন হুমায়ুন আহমেদ।
বিপ্লব: বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার দিক থেকে হুমায়ুন আহমেদ হচ্ছেন এ যুগের শরৎচন্দ্র। আপনি কী এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত?
ছফা: জনপ্রিয়তার দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ুন শরৎচন্দ্রের চাইতে বড়। মেরিটের দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ুন নিমাই ভট্টাচার্যের সমান। আর হুমায়ুনের প্রশ্নটা হচ্ছে – হি ইজ রাইটিং ফর বাজার।
বিপ্লব: অর্থই এখানে মূল?
ছফা: আমার তো মনে হয়না এখানে অন্যকোন উদ্দেশ্য আছে। হুমায়ুন সম্পর্কে বলতে আমার কষ্ট হয়। হি ইজ পার্টলি মাই ক্রিয়েশন। তারপরেও এগুলোকে পুত্রজ্ঞানে দেখাই ভাল।
বিপ্লব: বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো লেখকের লেখা কী ভবিষ্যতে ক্লাসিক হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে আপনি মনে করেন?
ছফা: একটা লেখা ক্লাসিক হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে আমি মনে করি। সেটা হলো আমার লেখা “ওঙ্কার”।
বিপ্লব: আর আখতারুজ্জমান ইলিয়াসের “চিলেকোঠার সেপাই”?
ছফা: লেখাটা আমি পড়েছি। অসাধারণ গ্রন্থ। আমার একটা নালিশ আছে, এর ভাষাটা খুব নিরস।
বিপ্লব: বর্তমানে এপার বাংলা-ওপার বাংলায় এমন কী কোনো লেখক আছেন, যাদের লেখা ভবিষ্যতে ক্লাসিক হবে বলে আপনি মনে করেন?
ছফা: হয়তো কেউ মৈত্রেয় দেবীর “ন’ হন্যতে”র কথা বলবেন। লেখাটা খুব ইম্পর্টেন্ট।
বিপ্লব: মহাশ্বেতা দেবীর “হাজার চুরাশির মা” বা “চোট্টি মুণ্ডা ও তার তীর” বা “অগ্নিগর্ভ” নয় কেন?
ছফা: মহাশ্বেতা দেবীর উপর আমার খুব ক্রোধ আছে।
বিপ্লব: কিভাবে? উনি তো স্ট্যাবলিশমেন্টের পক্ষের কোনো পত্রিকাতে লেখেন না। …
ছফা: সেটা জানি। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে আলাপ আছে। মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় সমাজের কতগুলো অংশ সম্পর্কে শানিত নালিশ আছে।লেখার ভেতরে কতগুলো কোয়ালিটি দরকার। মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় তা নেই।
বিপ্লব: আর এপার বাংলায়?
ছফা: সিক্টিজের দিকে রাজিয়া খানের একটা লেখা “বটতলার উপখ্যান” ভাল লেগেছিল।
বিপ্লব: আপনি কী তসলিমা নাসরিনের কবিতা পড়েছেন?
ছফা: মাঝে মাঝে পড়েছি। তার সম্পর্কে আমি কোনো কমেন্ট করবো না।
বিপ্লব: আমরা বলতে চাচ্ছিলাম, তার কবিতার গতিমুখ?
ছফা: তার কবিতা খুবই গতিমান।
বিপ্লব: কিন্তু তার কবিতার গতিমুখ কোনদিকে?
ছফা: আমি বলতে পারবো না। বোঝা খুব মুশকিল। তবে তার কবিতা বেশ স্বচ্ছন্দ। বেশ ঝরঝরে। এটুকু বলা যায়।
বিপ্লব: কোনো কোনো লিটল ম্যাগাজিন গ্রুপ মনে করে যে, তসলিমা নাসরিন যৌনতা লেখায় খুব খোলাখুলি নিয়ে আসেন। একারণে তরুণদের মাঝে তার বই বেশী চলে। আপনি কী এই ধারণায় একমত?
ছফা: তরুণদের মাঝে অনেক কারণেই বই চলে। একটা মেয়ে সাহস করে কিছু বলছে তো? এ জন্য তাকে আমরা অভিনন্দন জানাই।
বিপ্লব: তার কলামগুলো পড়ে আপনার কী মনে হয় যে, তসলিমা নাসরিন যতটা না বেশী সমাজ-বিদ্বেষী, তারচেয়ে বেশী পুরুষ-বিদ্বেষী?
ছফা: আমার মনে হয় সে কিছুটা পাগল প্রকৃতির। ক্রেজি।
বিপ্লব: আপনি “সাপ্তাহিক খবরের কাগজে” ফরহাদ মজহারের একটি লেখার উপরে একবার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। এই প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতটা কী ছিল?
ছফা: ফরহাদ মজহার বলেছিল, কিছু কিছু এনজিও আছে যারা মার্কসবাদকে সাপোর্ট করে। কিন্তু প্রব্লেম যেটা হচ্ছে, এনজিওর সাথে মার্কসবাদকে গুলিয়ে ফেলা। এটা একটা বাজে কাজ। এনজিও মার্কসবাদকে কখনো সাপোর্ট করতে আসে না। কেউ যদি অভাবে পড়ে এই কাজ (এনজিও) করে, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমাকে করতে হচ্ছে, কিন্তু এগুলোকে থিয়োরাইজ করা, ফিলোসফাইজ করা অপরাধ।
বিপ্লব: ফরহাদ মজহার এ ধরনের “অপরাধ” কেন করে চলেছেন?
ছফা: ফরহাদ অনেক বেশী জানে, সে জন্য তার বিভ্রান্ত হওয়ার ক্ষমতাও যথেষ্ট। অসাধারণ মেধাবী, আমার ব্যক্তিগত বন্ধু, সে যদি শুধু গান গাইতো, ও দিয়ে বেঁচে থাকতে পারতো।
বিপ্লব: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক সন্ত্রাস [ছাত্রলীগ-ছাত্রদল, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ও খালেদা জিয়ার বিএনপি সমর্থিত দুই ছাত্র সংগঠন] সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ছফা: আমার মনে হয়েছে, আমার মাকে যদি কেউ আমার সামনে নেংটা করে রেইপ করতো, তাহলে আমি যে পরিমান কষ্ট পেতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সন্ত্রাসের কারণে আমি সে পরিমান কষ্ট পেয়েছি। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে যারা রাজনীতি করতে এসেছে, তারা অশিক্ষিত, আওয়ামী লীগ,
বিএনপি – তারা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিচ্ছে। যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, এ জন্য জাতিকে ৫০ বছর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পলেটিক্যাল পার্টিগুলোর কর্ম নয় সন্ত্রাস বন্ধ করা। সাধারণ ছাত্র, যারা এরশাদকে তাড়িয়েছে, তারা যদি একত্র হয়ে সন্ত্রাসকে বর্জন করে, প্রতিহত করে, তাহলেই সন্ত্রাস দমন সম্ভব। সমাজের সর্বস্তরের লোক মিলে সন্ত্রাস দমন সম্ভব। সমাজের সর্বস্তরের লোক মিলে সন্ত্রাসকে অসম্ভব করে তোলা উচিৎ।
বিপ্লব: তাহলে সন্ত্রাসী হিরোরা কেন অনেক ছাত্র সংসদে বিপুল ভোটে জয়ী হচ্ছে?
ছফা: আগে এরকম ছিল, যারা যত ভাল ছিল, চরিত্রবান ছিল, তারা নেতা হত। এখন ইউনিভার্সিটি বা জাতীয় পর্যায়ে যে যতবড় খুনি, সে তত বড় নেতা। যেখানে সন্ত্রাস থাকে, সেখানে ডেমোক্রেটিক প্রিন্সিপাল থাকে না।
বিপ্লব: সূত্রটা তাহলে কী এরকম: ভয় হইতে ভক্তির উদ্ভব?
ছফা: পাড়ায় যদি এবটা গুণ্ডা ছেলে থাকে এবং এক বিধবা মহিলার যদি চার মেয়ে থাকে, তাহলে একটাকে তার সাথে বিয়ে দিয়ে আর তিনটাকে রক্ষা করে। নৈতিক সমর্থন না থাকলে, পাঁচশ ছেলেও যদি একাট্টা হয়ে সন্ত্রাসীদের তাড়া করে, হাসিনা বা খালেদার বাবার সাধ্য নাই সন্ত্রাস করে। তারা এই শিল্পকর্মগুলো তো গত ১০ বছর ধরে করে যাচ্ছে।
বিপ্লব: আপনার কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন, আপনি কেন লেখেন?
ছফা: আমি সাধারণত তিনটি কারণে লিখি। মানুষের কল্যাণ করার উদ্দেশ্য যদি থাকে, তখন
লিখি। যদি আর্টিস্টিক কিছু সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য থাকে, তখন লিখি। আর যখন কোনো কিছু প্রতিবাদ করার ইচ্ছা থাকে, তখন লিখি।
[সাক্ষাৎকার পর্ব এখানেই শেষ। সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে “আপনারা সাক্ষাৎকারের জন্য বারবার আমাকে বিরক্ত করেন, আপনাদের তো এরপর আমাকে সন্মানী দিতে হবে” – এ কথা রসিকতা করেন আহমদ ছফা। সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে এরপর ধন্যবাদ জানানো হয়। জবাবে তার জন্য এক কপি পত্রিকার সৌজন্য সংখ্যা পৌঁচে দেওয়ার কামনা।]
--
ছবি: শিল্পী এসএম সুলতান ও আহমদ ছফা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩, সংগৃহিত
--
ছবি: শিল্পী এসএম সুলতান ও আহমদ ছফা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩, সংগৃহিত
No comments:
Post a Comment