[ওই ছ্যাড়া তুই কই যাস, কালা গেঞ্জি গতরে?/ছেমড়ি তুই চিন্তা করিস না, আয়া পড়ুম দুপুরে/ হা রে রে, হা রে রে, হা রে রে…ভাবানুবাদ, গারো লোকসংগীত “রে রে”।]
কিছুদিন আগে গারো (মান্দি) আদিবাসী লেখক সঞ্জিব দ্রং আলাপচারিতায় জানাচ্ছিলেন, প্রায় ১২৫ বছর আগে গারোরা আদি ধর্ম প্রকৃতিপূজা (সাংসারেক) ছেড়ে দলে দলে খ্রিস্টান হতে শুরু করেন। সে সময় গারোদের হাজার বছরের প্রাচীন সাংসারেক ধর্মটি বিপন্ন হয়ে পড়ে, একই সঙ্গে গারোদের ধর্মীয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা উৎসবও পড়ে হুমকির মুখে।
সঞ্জিব দ্রং এর এই বক্তব্যকে সমর্থন করে প্রকৃতি ও আদিবাসী গবেষক, বন্ধুজন পাভেল পার্থ জানান, ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন কার্যকর করলে সে সময় সব খাস জমি, জলা ও জঙ্গলের ওপর সরকারি দখল কায়েম হয়, সমস্ত প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে বন বিভাগ সংরক্ষিত বন হিসেবে অধিগ্রহণ করে। একই সময় বন বিভাগ গারো পাহাড়ের পাদদেশে জুম (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ চাষাবাদ) নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
পাভেল বলেন. জুম চাষ নিষিদ্ধ ঘোষণা ও কাছাকাছি সময়ে ধর্মান্তরিত হওয়ার ঝোঁক গারো সমাজের প্রাচীন রীতি-নীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকেই ফেলে হুমকির মুখে। গারোদের প্রধান দুটি পরব– জুম চাষের বীজ বাছাই উৎসব “রংচুগালা” ও জুমের ফসল তোলার নবান্ন উৎসব “ওয়ানগালা”ও বিলুপ্তির মুখে পড়ে।
এখনো অল্প কয়েক ঘর সাংসারেক বা আদি ধর্মের অনুসারী গারোরা কোনও রকমে এই উৎসব দুটিকে ছোট পরিসরে হলেও ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
মধুপুরের আদি বাসিন্দা, পাঠচক্র গ্রুপ চানচিয়া (চিন্তা)এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আন্তনী রেমা, বন্ধুবরেষু বলেন “রংচুগালা”র আদ্যপান্ত। আদিবাসী গানের দল “মাদল” এর কাহন বাদক আন্তনীর সঙ্গে আলাপচারিত হয় ওদের গ্রাম জালিচিড়ার আঙিনায়। সেটি এ বছর ১ থেকে ৫ সেপ্টেম্বরের কোন এক “রংচুগালা”র সকাল। দূর থেকে ঢোল, সিঙ্গা আর ঘন্টার শব্দ ভেসে আসছে।
আন্তনী রেমা বলেন, “রংচুগালা হচ্ছে গারোদের বীজ বাছাইয়ের উৎসব। আর কিছুদিন পরেই শাক-সব্জি লাগানোর সময়। আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে রংচুগালা শুরু হচ্ছে। এখন যে বীজ বপন করা হবে, তা প্রত্যেক বাড়ি থেকে বাছাই করা হবে। এটি গারোদের (সাংসারেক) দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। আর প্রথম বৃহত্তম উৎসব হচ্ছে, নবান্ন উৎসব, ওয়ানগালা। এই বীজ বপন করার পর প্রথম ফসল উঠবে, তা শষ্য দেবতাকে উৎসর্গ করা হয় ওয়ানগালা উৎসবে।”
“এই পূজা, উৎসব আচার কতো বছরের প্রাচীন, তার কোন লিখিত ইতিহাস নেই। তবে এটি হাজার বছরের প্রাচীন, সেটা বলাই যায়। কারণ শুধু মধুপুরেই গারোদের বসবাস ৭০০ বছরের বেশী সময় ধরে।…রংচুগালায় যে বীজ বাছাই করা হয়, তা সবই জুম চাষের। কিন্তু বহু বছর জুম চাষ নেই। তবু রংচুগালা করা হয় প্রতীকি রুপে। বন বিভাগ জুম চাষ নিষিদ্ধ করার পরেও কিছু কিছু জুমচাষ কিন্তু হয়েছে। যেমন, সকালে আপনি আমাদের বাড়ির পাশে যে কলাবাগান দেখেছেন, সেখানে কিন্তু ছোটবেলায় আমি জুমের ধান চাষ হতে দেখেছি। যতদূর মনে পড়ে, দু-তিন বছর আমরা জুমের ধান পেয়েছি। এটি আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যের। কারণ গারো জীবনের জুম ইতিহাসের শেষ সময়টা অন্তত আমি পেয়েছি। আর খুব কষ্টের বিষয় এই যে, আমার পরের প্রজন্মের কারো আর জুম চাষ দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে না।”
“রংচুগালার আয়োজন ক্রমেই কমে আসছে, সংক্ষিপ্ত হচ্ছে। এর কারণ, সাংসারেকরা ধর্মান্তরিত
হচ্ছেন, বা খ্রিস্টান হচ্ছেন, এমন নয়. সাংসারেকদের যে প্রবীন প্রজন্ম এই রীতিনীতি পালন করেন, তারা প্রত্যেকেই অনেক বয়স্ক, তাদের বয়স ৭০ বা ৮০ বছর। প্রতি বছরই একজন-দুজন করে তারা মারা যাচ্ছেন। আবার সাংসারেক ধর্মটি এমন নয় যে, কাউকে দীক্ষা দেওয়া যায়। তাকে আসলে জন্মগতভাবেই সাংসারেক হতে হয়। আবার অনেকে নতুন করে খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের অনেকেই মনে করেন, সাংসারেক ধর্মের পাহাড় পূজা, প্রেত পূজা, দেবতা পূজা ইত্যাদি রীতিনীতি কুসংস্কার, অবিজ্ঞান, এ ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু এর পরেও ঐতিহ্য হিসেবে রংচুগালার সংস্কৃতি টিকে আছে।”
আন্তনী রেমা বলে চলেন, “আমার দেখুন, ওয়ানগালা উৎসব, সেটিও খুব সীমিত পরিসরে পালন করা হচ্ছে।আবার দেখুন, ঢাকায় বড় আয়োজন করে যে ওয়ানগালা হয়, আমি বলবো, একটি গোষ্ঠি, খ্রিস্টান ধর্মের অংশ হিসেবে ওয়ানগালা পালন করে। এখন সেটির নাম দেওয়া হয়েছে, খ্রিস্ট রাজার পরব!”
“কিন্তু এর সঙ্গে খ্রিস্ট রাজার কোনো সম্পর্কই নেই।প্রশ্ন আসে যে, এক ধর্মের জন্য যে পূজা বা প্রার্থণা, সেটা আরেক ধর্ম প্রধানের জন্য কিভাবে হতে পারে? ঈদ কখনো যীশুর জন্য হতে পারে না, দুর্গা পূজা কখনো মোহাম্মদের জন্য হতে পারে না। …নেত্রকোনার দুর্গাপূরে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ানগালার আয়োজন করেন একজন গারো ফাদার। খ্রিস্টিয় ধর্মগুরুরা নতুন করে এটি চালু করলেও তারা আসলে চেয়েছিলেন, আদিবাসী সংস্কৃতিটুকু টিকে থাক। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ভুল ব্যাখ্যাটিই গেল যে, এটি খ্রিস্ট রাজার পরব। মিসিসাল জং নামক শষ্য দেবতার পরবটি এখন ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে ওয়ানগালায় এভাবেই উপস্থাপিত হচ্ছে।…”
আন্তনী রেমা বলে চলেন, “আমার দেখুন, ওয়ানগালা উৎসব, সেটিও খুব সীমিত পরিসরে পালন করা হচ্ছে।আবার দেখুন, ঢাকায় বড় আয়োজন করে যে ওয়ানগালা হয়, আমি বলবো, একটি গোষ্ঠি, খ্রিস্টান ধর্মের অংশ হিসেবে ওয়ানগালা পালন করে। এখন সেটির নাম দেওয়া হয়েছে, খ্রিস্ট রাজার পরব!”
“কিন্তু এর সঙ্গে খ্রিস্ট রাজার কোনো সম্পর্কই নেই।প্রশ্ন আসে যে, এক ধর্মের জন্য যে পূজা বা প্রার্থণা, সেটা আরেক ধর্ম প্রধানের জন্য কিভাবে হতে পারে? ঈদ কখনো যীশুর জন্য হতে পারে না, দুর্গা পূজা কখনো মোহাম্মদের জন্য হতে পারে না। …নেত্রকোনার দুর্গাপূরে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ানগালার আয়োজন করেন একজন গারো ফাদার। খ্রিস্টিয় ধর্মগুরুরা নতুন করে এটি চালু করলেও তারা আসলে চেয়েছিলেন, আদিবাসী সংস্কৃতিটুকু টিকে থাক। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ভুল ব্যাখ্যাটিই গেল যে, এটি খ্রিস্ট রাজার পরব। মিসিসাল জং নামক শষ্য দেবতার পরবটি এখন ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে ওয়ানগালায় এভাবেই উপস্থাপিত হচ্ছে।…”
তরুণ গারো নেতা আন্তনী আরো বলেন, “ওয়ানগালা হচ্ছে শষ্য দেবতা মিসিসালের নামে শষ্য উৎসর্গ করার উৎসব, নাচগান, পানাহার। আমি নানি-নানাদের কাছে শুনেছি, ওয়ানগালা ছিল সব বয়সীদের মিলন মেলা। অনেক তরুণ-তরুণীরা সে সময় ওয়ানগালায় সমবেত হতেন। গানে গানে পরিচয়, আবার প্রনয়ও হতো। দেখা যেত, বেশীরভাগ সময় গারো তরুণ-তরুণীরা ওয়ানগালার সময় নিজের পছন্দের মানুষকে বেছে নিত।”
রংচুগালার পর্বগুলো কী? এমন প্রশ্নের জবাবে আন্তনী রেমা বলেন, “সংনকমা (গ্রাম প্রধান) এর বাড়িতে কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। এরপর গ্রামের যে সব সাংসারেক পরিবার আছে, সেখানে বীজ বাছাইয়ের মন্ত্রপ্রাপ্ত ওঝা ও বাদক দল সে সব পরিবারে একে একে যাবেন। আর সেখানে কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। এই দলটিকে সাংসারেক পরিবারটি চু (ঐতিহ্যবাহী গারো পানীয়, ভাতের রস) এবং সাথে মোরগের মাংস বা শুকরের মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করবে। এসব পানাহারের পরে বাদক দল যুদ্ধের একটি নৃত্য করবে। বাজনার তালে তালে সেই নৃত্য করা হবে। তারপর বীজ বাছাইয়ের ছোট্ট একটি আনুষ্ঠানিকতা আছে। এরপর ওঝা ও বাদক দল একের পর এক সাংসারেক ধর্মের সব বাড়িতে যাবেন, একই আচার-রীতি পালিত হবে। আর বীজ বাছাই পর্বে লা্উ বা কুমড়ো ফেড়ে দেখা হয় যে, বীজের মান কেমন। বর্ষিয়ান ওঝারা বলে দেবেন, বীজ কোনটা ভাল বা ভাল নয়।”
এরপর আন্তনী কথিত ওঝা ও বাদক দলের সাথে ঘুরে ঘুরে আমরা এ গ্রাম সে গ্রাম রংচুগালা উৎসবে মাতি। বিভৎস গরমে ঘেমে নেয়ে মাটির ঘরের বারান্দায়, খড়ো ছাউনি বা কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বেণ্চ ও চেয়ার পেতে প্লাস্টিকের গ্লাসে চু, কলা পাতায় ভাত, সব্জি, শুকরের মাংস ও ডাল খাই। দেখা যায়, রান্নার স্বাদ ষোলআনা বাঙালিয়ানা থেকে যথেষ্টই ভিন্ন। আবার চাকমাদের রান্নার সঙ্গে অনেক মিল, শুটকি/সিঁদোলের প্রধান্যটুকু ছাড়া।
আরো বিস্ময়কর ওঝাদের সঙ্গে যে বাদক দল ঘুরে ঘুরে যুদ্ধের নাচগান করেন, তারা ইস্পাতের তলোয়ার ও বেতের ঢালের অভাবে দুই থণ্ড লাকড়ি দিয়ে যুদ্ধের নাচটি সারেন! গারো বা মান্দিদের সহস্র বছরের প্রাচীন যুদ্ধের নাচ আগে দেখার সৌভাগ্য হওয়ায় ঘাটতিটুকু সহজেই চোখে পড়ে। …
এরকম ছোটবড় মারাত্নক ত্রুটির ভেতরেও আন্তনী রেমার মত তরুণ বুদ্ধিজীবীর দল আদিবাসী ঐহিত্য নিয়ে ভাবেন, মিছিলে, শ্লোগানে, গানে আদিবাসী অধিকারের সংগ্রাম করেন, এ-ও বা কম কী?
—
*ছবি ও ভিডিও: লেখক
No comments:
Post a Comment