Monday, February 9, 2015

প্রতিবন্ধিতাজয়ী শর্মীর আকাশ সমান স্বপ্ন

 
'প্রতিবন্ধকতার সব বাধা পেরুতে চাই। আর প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠা করতে চাই চিকিৎসাকেন্দ্র। সেখানে চলৎ প্রতিবন্ধী শিশুরা নামমাত্র মূল্যে আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি ব্যায়াম, ম্যাসাজ থেরাপি পাবে। তাদের অভিভাবকরা পাবেন চিকিৎসাসেবার নানা পরামর্শ। আর বয়সে বড় চলৎ প্রতিবন্ধীরাও সেখানে ব্যায়াম ও থেরাপির সুবিধা পাবে। এখন এই লক্ষ্যে কাজ করছি।' চলৎ প্রতিবন্ধী ও কম্পিউটার প্রোগ্রামার শর্মী রায় (২৫) এভাবেই জানান নিজের স্বপ্নের কথা।
প্রাণোচ্ছল মেয়েটি আশৈশব লড়াই করছেন সেরেব্রাল পালসি (সিপি) নামক দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে। মাতৃক্রোড়েই তাঁর দুই পা ও ডান হাত অবশ হয়ে যায়। প্রতিবন্ধকতার কারণে মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। অভাবের সংসারে নিত্যনতুন সংকট লেগেই থাকত। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। দুটি ক্রাচ সম্বল করে শর্মী শেখেন কম্পিউটার চালানো। প্রায় অসাড় ডান হাতে মাউস চালাতে তাঁকে রীতিমতো যুদ্ধই করতে হয়েছে। এরপর টানা জীবন জয়ের সংগ্রাম। অভাব আর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে সম্বল করে শুভানুধ্যায়ীদের সহমর্মিতায় শর্মী এখন একজন সফল আইসি প্রোগ্রামার। চাকরি করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা ভালো হয়ে তিনি নিজেকে সঁপেছেন দেশের প্রতিবন্ধীদের সেবায়। স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন প্রতিবন্ধীদের সংগঠনে।

সম্প্রতি কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় শর্মী জানান জীবন জয়ের গল্প। বলেন তাঁর স্বপ্নের কথাও। 'জন্মের সময়ই আমার মাথায় আঘাত লেগেছিল বলে সিপিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। আরেকটু বড় হলেও আমার পা দুর্বল থাকায় আর দশটা শিশুর মতো বসতে বা হামাগুড়ি দিতে পারতাম না। স্কুলে যাওয়ার বয়সে মা শেফালি রানী রায় আমাকে কোলে করে সাভার রেডিও কলোনি মডেল স্কুলে নিয়ে যেতেন। সেখানেই অনেক কষ্টে আমি নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ি। পাশাপাশি সাভারের পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) ম্যাসাজ থেরাপি ও ক্রাচ নিয়ে কিছুটা হাঁটাচলা শুরু করি। এরপর স্কুলে আনা-নেওয়ার সমস্যা থাকায় বন্ধ হয়ে যায় আমার পড়াশোনা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবা সুশীল কুমার রায়ের ব্যবসায় দিন দিন মন্দা চলতে থাকে। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। এর মধ্যেও বাবা আমার জন্য পত্র-পত্রিকা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বই কিনে আনতেন। তখন আমরা থাকতাম পুরান ঢাকার চানখাঁর পুলে। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থেকে রীতিমতো হতাশায় ভুগতে থাকি। নিজের ইচ্ছেয় বাসার কাছের একটি ব্যবসাকেন্দ্রে কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ নিই। এদিকে ২০১০ সালে আকস্মিক মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান বাবা। আমাকে নিয়ে মা অকূল সাগরে পড়েন।'

শর্মী বলে চলেন, "এই ঘোর বিপদের সময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান বাবার বন্ধু ইমতিয়াজ আলম খান। বিদ্যুৎ প্রকৌশলী এই কাকার রয়েছে 'সুপারনোভা ইঞ্জিনিয়ারিং' নামের একটি প্রতিষ্ঠান। মিরপুরের শেওড়াপাড়ার সেই অফিসে আমি কাজ পাই। চাচার উদ্যোগেই বাসা বদল করে আমরা শেওড়াপাড়ায় চলে আসি। আর ওই অফিসেই কম্পিউটার শেখার পাশাপাশি নিজেকে আইসি প্রোগ্রামার হিসেবে তৈরি করি। এ সময় আমি ফেসবুকে খুঁজে পাই প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যাডভোকেসি নেক্সাস' (বি-স্ক্যান)। এর দুজন প্রধান উদ্যোক্তা সাবরিনা সুলতানা ও সালমা মাহবুব আপা আমাকে প্রচুর উৎসাহ দেন। গত বছর আমি অনলাইনে জানতে পারি আমার অসুখের চিকিৎসার কথা। ভারতের এলাহাবাদের সমবেদনা ট্রাস্ট ফাউন্ডেশন নামক হাসপাতালের একজন ডাক্তারের সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করি। তিনি জানান, অপারেশন করে আমাকে অনেকটাই ভালো করা সম্ভব। এ জন্য কমপক্ষে দেড় লাখ টাকার মতো প্রয়োজন। সে সময় বি-স্ক্যান ৪০ হাজার টাকা এবং আমার অফিস ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। এ ছাড়া কলকাতাবাসী আমার বড় বোন তনুশ্রী রায় ও তাঁর ব্যবসায়ী স্বামী সুবোধ বিভিন্ন খরচ বহন করেন। সেখানে অপারেশনের পর দেশে ফিরে আমি অনেকটা সুস্থ বোধ করি। লাঠি নিয়ে এখন আমি একা একা চলাফেরা করতে পারি।" শর্মী আরো বলেন, ভারতের ওই হাসপাতালে দেখেছি সে দেশের প্রতিবন্ধীদের অপারেশনের অর্ধেক খরচ বহন করে সরকার। কিন্তু আমাদের দেশে এই সরকারি সহায়তাটুকু তো দূরের কথা, আধুনিক থেরাপি বা ব্যায়াম-কোনোটিরই সুযোগ নেই। তাই বি-স্ক্যানের অঙ্গসংগঠন হিসেবে আমি এখন 'অ্যাওয়ারনেস ফর পারসন্স উইথ সেরেব্রাল পালসি অ্যান্ড ম্যাসকুলার ডিসট্রফি' বা এপিসিপিএমডি সংগঠনের ব্যানারে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করার চেষ্টা করছি।

- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/news/2015/02/09/185623#shareButton
















































No comments:

Post a Comment