গত জুনে গিয়েছিলাম রংপুর-দিনাজপুর। দুটি আদিবাসী সান্তাল গ্রামে মানবাধিকার লংঘনের সরেজমিন সংবাদ করতে। রংপুরে আকাশমনিতে বন সৃজন করবে বলে বন বিভাগ উচ্ছেদ নোটিশ দিয়েছে ভূমিহীন শত সান্তাল পরিবারকে। আর দিনাজপুরে ভূমি দখল করতে সন্ত্রাসীরা দিনে-দুপুরে চারজন সান্তাল কৃষককে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। ...মোরে সান্তাল বানাইছে ভগমান গোমোরে মানুষ বানায়নি ভগমান...
খুব কাছ থেকে অনেকদিন পর দেখলাম অভাবের প্রকৃত করাল গ্রাস। ঘরে ঘরে ক্ষুধা। প্রতিটি সান্তাল পরিবারে দুবেলা, বড়োজোর একবেলা ভাত জোটে। তিন বেলা অন্ন সংস্থান হয়, এমন পরিবার খুজেঁ পাওয়া মুস্কিল। স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছে, এমন অনেক দিন হয়েছে, সকালে এক গ্লাস পানি খেয়ে তারা ক্লাসে গেছে। দুপুরে বাড়ি ফিরেও দেখে ভাত নেই। বাবা-মা সারাদিন ক্ষেতমুজুরি করার পর শুধু রাতে হয়তো সবাই পেট পুরে খেয়েছে। আবার স্কুল থেকে ফিরে ক্ষুধার্থ অবস্থাতেই জমিতে ক্ষেতমুজুরি করতে হয়েছে, এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও কম নয়। ...
খর রোদের ভেতর মাটির ভগ্ন ঝুপড়ি ঘরগুলোর সামান্য ছায়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলি নানা বয়সী আদিবাসী মানুষের সঙ্গে। কসাইয়ের নির্লিপ্ততায় দ্রুত হাতে টুকে নিতে থাকি নিউজ-নোট। কারো কারো ছবি তুলি মোবাইল ফোনে। গদলঘর্ম হতে হতে কল চিপে পানি খাই। ...
সে সময় নাম বিস্তৃত একজন মাঝ বয়সী কিষাণী আমাকে বলেছেন, প্রায় ২০ বছর আগে বিয়ে হয়েছে তার। বিয়ের পরদিন থেকেই তিনি স্বামী, শশুড়-শাশুড়ির সঙ্গে ক্ষেতে গেছেন মজুরি দিতে।...সেই থেকে শ্রম দাসত্ব চলছেই। অভাব, উচ্ছেদ আতংক কোনোটিরই যেনো শেষ নেই।...
ফেরার পথে বগুড়ার ধনকুণ্ডীর মোড়ে আমরা সাংবাদিক-মানবাধিকার দল ক্ষণিকের যাত্রা বিরতি করি। সেখানেই হঠাৎ চোখে পড়ে এই ভিনটেজ কার-- ফক্সওয়াগন গাড়ির খোলটিকে। এটি এখন শো-পিস, নগর নিসর্গ।
একসময় উত্তরবঙ্গের সান্তাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, কোলসহ ২৭টি বিপন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠিদেরও আক্ষরিক অর্থে বিলুপ্তির পর হয়তো আমরা এমনি করে মমি বানিয়ে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সড়ক মোড়ে সাজিয়ে বাড়াবো যন্ত্র-জীবনের শোভা! কে জানে?
ভাবতে ভাবতে, বিষম ঘোর লাগে এই চিন্তনে যে, এরাই নাকি দুর্ধর্ষ শিকারী জাতির উত্তোরাধীকার! এরাই তো নাচোলে ইলা মিত্রের নেতৃত্বে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো জমিদারী। আরো আগে সান্তাল হুলে, দন্ত-দখরে ভোঁতা করে দিয়েছিল ব্রিটিশ রাজসিংহের।...আর ১৯৭১ এ সান্তাল-ওঁরাও-মুণ্ডা দল বেঁধে যোগ দিয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার থ্রি নট থ্রি- রাইফেলের পাশাপাশি অসীম সাহসে নিজস্ব তীর-ধনুকে এরাই তো ঘেরাও করেছিল পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটি রংপুর সেনা নিবাস! সম্মুখ যুদ্ধে এরাও ঢেলেছে বুকের তাজা রক্ত!...
হায়! আজ সিঁধু নাই, কানহু নাই, বিরসা মুণ্ডাও তো নাই! আছে শুধু গুটি কয় দাতাগোষ্ঠির অর্থপুষ্ট ভেড়ার ছালওয়ালা এনজিও, আর মিশনারী গির্জা। অপরপ্রান্তে হাড্ডিসার, প্রায় ভগ্ন মেরুদণ্ডী কালো কালো মানুষজন!
__
[নিউজ লিংক: http://www.kalerkantho.com/print-edition/news/2014/06/17/97066]
ছবি: লেখক।
No comments:
Post a Comment