আটের দশকে এসএসসি পরীক্ষার পর আমার স্কুলের বন্ধুরা কেউ স্পোকেন ইংলিশ, কেউ বেসিক ইংলিশ, কেউ বা শর্টহ্যান্ড-টাইপরাইটিং বা কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হয়ে গেল। তখন আমেরিকা যাওয়ার খুব ক্রেজ। এবং মাইকেল জ্যাকসন।…
আমি এ সব কিছুর কোনোটাই করিনি। একেবারে সিরিয়াস পরীক্ষার্থীর মতো সকাল বেলাতেই খাতা-কলম গুছিয়ে যেতে শুরু করি শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে। তারপর একেবারে টানা চলতে থাকে গভীর অধ্যায়ন।
সেই সময় আমি খুঁজে পাই আরেক সিরিয়াস পাঠককে। তার নাম জাহিদ হাসান পাপ্পু। সংক্ষেপে– জাহিদ। বয়সে আমার চেয়ে বছর চারেক বড়। আশ্চর্য সুন্দর ঝাঁ চকচকে তরুন। আয়নার মতো জ্বলজ্বলে চোখ। তার মেধার গভীরতা ও ক্ষুরধার যুক্তি আমাকে টানে। খুব দ্রুত আমাদের বন্ধুত্ব হয়। আমি মোহিত হই।
দুনিয়ার তাবৎ বিষয়ে আমাদের কথা হয়। বই পড়ি, আর তর্কে মাতি। তুমুল চেঁচামেচি করে একেকটি বিষয়ে একেবারে হাতাহাতি করার উপক্রম।
পাবলিক লাইব্রেরির পর আমরা আরো বইয়ের সন্ধানে হানা দেই বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে। গোগ্রাসে গিলতে থাকি বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎ, মানিক, জীবনানন্দ, বোদলেয়ার, চেখভ, তলস্তয়, দস্তভিস্ক, গোর্কি, কামু, কাফকা, সক্রেটিস, প্লেটো, রুশো, ভলতেয়ার, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও, দেরিদা, বেকন, জ্যাক লন্ডন, মম, মার্ক টোয়েন এবং আরো অনেক…
আমার সাবেক নকশালাইট বাবা আজিজ মেহের বলতেন, মানুষের জীবন খুব ছোটো। এ জন্য বই পড়তে হবে বাছাই করে, ভেবেচিন্তে। আর জাহিদ ভাই বলেন অন্যকথা, যা পড়তে ভাল লাগে, তার সবই পড়ে ফেলতে হবে–একেবারে মার্কস থেকে মাসুদ রানা পর্যন্ত।
আমি জাহিদ ভাইয়ের কথাটাই গ্রহণ করি। বাবার পরেই জাহিদ ভাই হয়ে ওঠেন আমার দ্বিতীয় ঈশ্বর। আমি তার সাথে উড়াল দেই।…
সেই সময় দেখতাম জাহিদ ভাই খুব সুন্দর কবিতা লিখতেন। পিজি হাসপাতাল (এখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) এলাকা ঘিরে জমে ওঠা লিটল ম্যাগের নানা গ্রুপ তার কাছ থেকে দু-একটা কবিতা চেয়ে নিত। কি যে সুন্দর তার হাতের লেখা! মনে হয়, একেকটি অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি।
অনেক কবিতাকেই উনি আবার নিজেই সুর দিয়ে গান বাঁধেন। সবই নগর-বাউল ঘরনার গান। গান কম্পোজ হতো সন্ধ্যায়, চারুকলার শুকনো পুকুর পাড়ে, পেশাদার ঢুলির ঢোলের বোলে।
তখন বিখ্যাত সব বাউলদের সঙ্গে দেখি তার অদ্ভুদ সখ্যতা। গ্রামীণ বাউল গানের সন্ধানে আমরা কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ায় লালন সাঁইয়ের মাজারে, ঘোড়াশালে লেঙটা পীরের ওরশে, মাতাল রাজ্জাকের আসরে, চট্টগ্রামে মাইজভান্ডারী শরীফে, এমনকি হাইকোর্টের মাজারেও ঘুরে বেড়াতে শুরু করি। সেই সময় পরিচয় হয় বাউল সম্রাট মহিম সাঁই, বর্ষিয়ান হিরু সাঁই, অতি গুনি শিল্পী রব বাউল ও মনা পাগলার সঙ্গে। …মাঝে মাঝে সিগারেটে বা এক বিঘৎ কল্কে দিয়ে গাঁজা টানাও চলতো। আশ্চর্য সোনালী সুন্দর সেই সব দিন।…
কলেজে উঠে আমি জড়িয়ে পড়ি সামরিক জান্তা এরশাদ বিরোধী ছাত্র রাজনীতিতে। জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কমতে থাকে। কলেজ শেষ করে আমি পেশাদার সাংবাদিকতায় ব্যস্ত হই। দিনের পর দিন জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয় না।…
অনেক বছর পর একদিন গভীর বিস্ময় আর বেদনা নিয়ে আমি দেখি, পাবলিক লাইব্রেরির বারান্দায় আমার কবিতার মাস্টার জাহিদ ভাইকে। উনি তখন বদ্ধ উন্মাদ, পুরোপুরি হেরোইন আসক্ত, ভবঘুরে। মাথায় জট পাকানো চুল, পরনে শতছিন্ন নোঙরা পোষাক। দেখলে থুতু দিতে ইচ্ছে করে। …বেঁচে আছেন মানুষের দয়া-দক্ষিণায়, ভিক্ষে করে।
কতোজনে তাকে ফেরাতে চেষ্টা করেছে। শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাকে কয়েকবার রিহ্যাবে দিয়েছিল। কিন্তু কোনোটাতেই কোনো কাজ হয়নি। … সে তুলনায় আমি আর কোন ছাড়? সামান্য অক্ষরজীবী মাত্র; নিজের জীবন টেনে টেনে ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত।…
এখনো পথ চলতে চারুকলার সামনে, ছবি হাটে বা একুশের বই মেলায় মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। নেশাহীন জাহিদ ভাই কখনো আমাকে চিনতে পারেন, নেশাড়ে জাহিদ ভাই কখনো তা-ও পারেন না।
এমনি চেনাচেনির এক পর্বে তাকে বলি আমার হিংসার কথা। আমি বলি, জাহিদ ভাই, আপনিই আসলে সফল। কি চমৎকার সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে বসে আছেন।…জগতে যা কিছু আছে কিছু নেই তার অনুসঙ্গে।…আর আমরা? আমরা দিনরাত ব্যস্ত ইঁদুর দৌড়ে…অথবা মত্ত তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠে যাওয়ার অবিরাম চেষ্টায়।…
ভয়ংকর মাদকাসক্ত জাহিদ ভাই কী আমার কথা বোঝেন? না কী বোঝেন না? আমি ডাকি, জাহিদ ভাই, জাহিদ ভাই।…উনি ঘুরে তাকান। মৃত মাছের মতো দৃষ্টিশুন্য চোখ। আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। আমি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিলে কি যেন ভেবে তিনি অস্পষ্ট ফ্যাসফ্যাসে গলায় গেয়ে ওঠেন একদা এক স্বর্নালী দিনে লেখা তারই গান:
আমি যারে ভালবাসি
তারে আবার বাসি না
তারে ভাল লাগে না, লাগে না, গো…
যে মোরগের আজান শুইনা
রোজ সকালে ঘুম ভাঙিলা
তারে আবার না খাইলে
তোমার মগজ বাড়ে না
আমি যারে ভালবাসি গো…
আমার বুকের ভেতর থেকে কী দারুন এক কষ্ট ওপরের দিকে উঠে এসে দলা পাকিয়ে গলায় আটকে যায়। আমি একসঙ্গে হরবর করে অনেক কথা বলতে চাই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলতে পারি না।…
—
পুনশ্চ: কয়েক বছর আগে বাংলা ব্যান্ডের আনুশেহ জাহিদ ভাইয়ের একটা গান গেয়ে খুব জনপ্রিয় করেছেন: তোমার ঘরে বাস করে কারা, তুমি জান না, তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা?… [লিংক]
—
ছবি: মুন রাইজ, ভ্যান গখ, আন্তর্জাল।
ভাল লেগেছে। তোমার মত করে জীবনটাকে আমিও দেখার চেষ্টা করেছি কিন্তু তোমার মত প্রকাশ করার ক্ষমাতা আমার নাই। জীবনটাকে এভাবে দেখার এবং কাব্যিকভাকে সেগুলোকে প্রকাশ করার ক্ষমতা তোমাকে অনন্য করে তুলেছে। তোমার লেখায় আমাদের সেই সময়গুলো আমি দেখতে পাই। যখন আমরা সবাই ভালোর দিকে যাত্রা শুরূ করেছিলাম।
ReplyDelete