বিপ্লব রহমান, মধুপুর (টাঙ্গাইল) থেকে ফিরে
মরেও
মুক্তি নেই আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলের। মৃত্যুর পাঁচ বছর পরও তাঁর
বিরুদ্ধে এখনো বহাল বন বিভাগের দায়ের করা মামলা! চলেশ রিছিল আট বছর আগে
গারো আদিবাসীদের মধুপুর ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। এ
কারণে সে সময় মধুপুর বন কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। এ মামলায়
'গরহাজির' থাকায় কিছুদিন আগে আদালত তাঁর বিরুদ্ধে সমনও জারি করেছেন।
মধুপুরের শত শত গারো আদিবাসী নারী-পুরুষের রয়েছে একই রকম আরো প্রায় পাঁচ হাজার মামলা। বছরের পর বছর ধরে এসব মামলার দুর্ভোগে এখন তাঁদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। সরেজমিনে মধুপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে জানা গেছে, শুধু তাই-ই নয়, ১০ থেকে ১৫ বছরের পুরনো আরো অনেক বন মামলা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা, স্কুলশিক্ষক, ছাত্র, কৃষিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার আদিবাসীর বিরুদ্ধে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জেলা সদরে এসে এসব মামলার খরচ চালাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হতে বসেছেন। বন মামলায় কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পেয়ে নতুন করে আবারও জড়িয়ে পড়েছেন মামলায়- এমন নজিরও রয়েছে। এভাবে মামলার মরণফাঁদে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে আদিবাসী জীবন। অথচ আন্দোলনের মুখে মধুপুর ইকো পার্ক প্রকল্পটি সরকার আট বছর আগেই বাতিল ঘোষণা করেছে।
জলছত্র, কাঁকড়াগনি, বেদুরিয়া, জয়নাগাছাসহ বিভিন্ন এলাকার আদিবাসীরা বলছেন, এসব মামলার মধ্যে ইকো-পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলার সংখ্যাই বেশি। তাই তাঁরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে এসব 'হয়রানিমূলক বন মামলা'র দ্রুত নিষ্পত্তি চান। অন্যদিকে বন কর্তৃপক্ষও স্বীকার করে বলছে, এর আগে মধুপুরে প্রতিবছর গড়ে সাড়ে তিন শ বন মামলা দায়ের করা হতো। 'এসব মামলা সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে'- এমন বিবেচনায় গত দুই বছরে বন কর্তৃপক্ষ নতুন কোনো মামলা করেনি। এখন তারা পুরনো বন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবছে। তবে এসবই সময়সাপেক্ষ।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে ৪৭৮ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী শালবনে কয়েক শ বছর ধরে প্রায় আড়াই হাজার গারো ও কোচ আদিবাসীর বসবাস। ২০০০ সালে বন বিভাগ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সেখানে ইকো পার্ক প্রকল্প করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, বনের মাঝখানে হবে ১০টি পিকনিক স্পট এবং ছয়টি ব্যারাক। বিশাল জায়গাজুড়ে দেওয়াল তুলে ঘিরে ফেলা হবে পুরো পার্ক এলাকা। তবে সে সময় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বন কর্তৃপক্ষ বনের স্থানীয় অধিবাসী আদিবাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। বন থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কায় আদিবাসীরা ইকো পার্ক প্রকল্প প্রতিরোধের জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি বনরক্ষী ও পুলিশ গুলি চালালে আদিবাসী নেতা পিরেন স্নাল মৃত্যুবরণ করেন। গুলিতে আহত হন ৩৪ জন নারী-পুরুষ। এরপর সরকার মধুপুর ইকো পার্ক প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে। তবে সেই সময় আন্দোলনে জড়িত আদিবাসী নারী-পুরুষের বিরুদ্ধে বন আইনে শত শত মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলাগুলো এখনো চলছে।
এদিকে গত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলকে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী। পরে পুলিশ 'ক্রসফায়ারে' নিহত বলে দাবি করে চলেশের পরিবারকে তাঁর মৃতদেহ হস্তান্তর করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী আদিবাসীদের অভিযোগ, গ্রেপ্তারকৃত চলেশ রিছিলকে জানালার গ্রিলে ঝুলিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ৯ সদস্য নির্যাতন করেছিল। এ কারণেই সে সময় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁরা জানান, চলেশের মরদেহ পরীক্ষা করে দেখা হয়, তাঁর চোখ দুটো ছিল উপড়ানো, ডান হাতের তিনটি আঙুলের নখও উপড়ে ফেলা হয়েছিল। তাঁর অণ্ডকোষ নষ্ট করে দেওয়া হয়, সারা গায়ে ছিল প্রচণ্ড আঘাতের চিহ্ন। মরদেহের ছবিতেও নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট ধরা পড়ে।
মধুপুরের প্রত্যন্ত পশ্চিম কাঁকড়াগনি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসী পঞ্চরাজ গাগরা (৫৮) কালের কণ্ঠকে জানান, ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের দায়ে ২০০৩ সালে তাঁর বিরুদ্ধে বন আইনে চারটি মামলা হয়। পরে ২০০৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আরো পাঁচটি মামলা। এসব মামলায় মোট ৭০ দিন কারাভোগের পর এখন তিনি জামিনে রয়েছেন। সবশেষ গত ৩০ এপ্রিল তিনি একটি মামলায় জেলা জজ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তবে একই দিন একই মামলায় হাজিরা না দেওয়ার জন্য নিহত আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলের বিরুদ্ধে আদালত একটি সমন বা হাজিরাসংক্রান্ত পরোয়ানা জারি করেন।
তিনি আরো জানান, ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনে পিরেন স্নাল নিহত হওয়ার দিনে (২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি) নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে পঙ্গু হন বেদুরিয়া গ্রামের উৎপল নকরেক। আদালতে নিয়মিত হাজিরা না দেওয়ায় গত ৩০ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধেও সমন জারি করা হয়েছে।
ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলন প্রসঙ্গে কৃষিজীবী পঞ্চরাজ গাগরা বলেন, 'এটি ছিল আমাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন। তাই আদিবাসীরা এই সামাজিক আন্দোলনে দলে দলে যোগ দিয়েছিল। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ছড়রার গুলিতে আমার স্ত্রী রহিলা সিমসাং, ছেলে মিঠুন, যুবরাজ ও তরুণ মারাত্মক আহত হয়। কিন্তু বন মামলার ভয়ে আমি তখন তাদের লুকিয়ে চিকিৎসা দিতে বাধ্য হই। এখন অভাবের কারণে আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছে। অন্যদিকে বছরের পর বছর জেলা সদরে গিয়ে মামলার খরচ চালাতে গিয়ে আমার এখন পথে বসার দশা।'
বেদুরিয়া গ্রামের কেজাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মালতী নকরেক (৪৫) জানান, একই বছর ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে রসুলপুর রেঞ্জ বন বিভাগ তিনটি বন মামলা করে। এই মামলাগুলোতে তিনি এখন জামিনে আছেন। তাঁর স্বামী আবেল মানখিনও (৫০) একই রকম আরেকটি মামলার আসামি ছিলেন। তবে ২০১০ সালে ওই মামলাটি থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন।
জয়নাগাছা গ্রামের কৃষক ইলারি কুবি (৪১) জানান, ১২ বছর আগে কয়েকজন আদিবাসী যুবক মিলে কাঠচোরদের একটি মোষ টানা গাড়ি আটক করেছিল। বন কর্তৃপক্ষ উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই কাঠ চুরির মামলা দায়ের করে। ১৯৯৬ সালের ওই মামলাটির পর ২০০৪ সালে ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হয় আরেকটি মামলা। শেষের মামলায় ২৪ দিন কারা ভোগ করে এখন তিনি দুটি মামলাতেই জামিনে আছেন।
তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় মধুপুরের এই শালবনে বাস করছি। অরণ্যের সন্তান হিসেবে যুগ যুগ ধরে আমরাই বন, জঙ্গল ও প্রকৃতিকে রক্ষা করে চলেছি। অথচ বরাবরই বন কর্তৃপক্ষ আমাদের বনের শত্রু মনে করে আসছে। তাই তারা আমাদের এভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। মামলার হাজিরা দিতে দিতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। আমাদের কারো মনে কোনো সুখ নেই।'
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং কালের কণ্ঠকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে নানা রকম বন মামলা আদিবাসীদের জন্য নিপীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আদিবাসীদের সব রকম হয়রানিমূলক বন মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু তারা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তিনি বলেন, '১৯২৭ সালের বন আইন মূলত একটি দমনমূলক কালো আইন। এই আইনে বন কর্তৃপক্ষ যে কারো বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে, এ জন্য কোনো সাক্ষীর প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের সুস্পষ্ট দাবি, বর্তমান বন আইন থেকে নির্যাতনমূলক ধারাগুলো বাদ দিয়ে আদিবাসীদের মতামতের ভিত্তিতে আইনটিকে সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হোক। এ ছাড়া আমরা চাই, আদিবাসীদের পরামর্শে সরকার যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে হয়রানিমূলক বন মামলাগুলো নিষ্পত্তি করে।' সঞ্জিব দ্রং বন ও ভূমির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক একটি ভূমি কমিশন গঠন করারও দাবি জানান।
মধুপুরের জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, আন্দোলনে নিহত চলেশ রিছিলের বিরুদ্ধে বন মামলায় সমন জারির ঘটনাই প্রমাণ করে মধুপুরে বন কর্তৃপক্ষ আদিবাসীদের বিরুদ্ধে কী নির্মম নির্যাতনই না চালাচ্ছে! তিনি বলেন, 'আমরা একের পর এক সরকার, বন ও পরিবেশমন্ত্রী, সচিব, বন বিভাগ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে হয়রানিমূলক বন মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের দাবি, যেন একটি বিশেষ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দ্রুত হয়রানিমূলক বন মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সরকারই আমাদের দাবি পূরণে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।'
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) অসীত রঞ্জন পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দু-আড়াই বছর আগেও প্রতিবছর মধুপুরে গড়ে সাড়ে তিন শ বন মামলা দায়ের করা হতো। আমি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আমার নির্দেশে এসব মামলায় কাউকে হয়রানির শিকার যাতে না হতে হয়, সে জন্য গত দুই বছরে এখানে নতুন কোনো মামলা হয়নি। এখন আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, ১০-১৫ বছরের পুরনো বন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার।'
তিনি জানান, মধুপুর ইকো পার্ক প্রকল্পটি আট বছর আগেই সরকার বাতিল করেছে। তাই ওই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দায়ের করা মামলাসহ অন্য বন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য তাদের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে। তবে সব মামলা রাতারাতি নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়।
আদিবাসীদের দাবি মেনে তাদের মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হবে কি না, জানতে চাইলে ডিএফও বলেন, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। তাই বন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আদিবাসী বা অ-আদিবাসী বিবেচনা করা সঠিক হবে না। তবে বন কর্তৃপক্ষ শিগগিরই সমস্যাটির সুরাহা চায়।__
http://webcache.googleusercontent.com/search?q=cache:BNLnVi4Ell8J:www.kalerkantho.com/index.php%3Fview%3Ddetails%26type%3Dgold%26data%3DAntivirus%26pub_no%3D969%26cat_id%3D1%26menu_id%3D14%26news_type_id%3D1%26index%3D1%26archiev%3Dyes%26arch_date%3D09-08-2012&client=firefox-a&hl=en&gl=bd&strip=0
মধুপুরের শত শত গারো আদিবাসী নারী-পুরুষের রয়েছে একই রকম আরো প্রায় পাঁচ হাজার মামলা। বছরের পর বছর ধরে এসব মামলার দুর্ভোগে এখন তাঁদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। সরেজমিনে মধুপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে জানা গেছে, শুধু তাই-ই নয়, ১০ থেকে ১৫ বছরের পুরনো আরো অনেক বন মামলা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা, স্কুলশিক্ষক, ছাত্র, কৃষিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার আদিবাসীর বিরুদ্ধে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জেলা সদরে এসে এসব মামলার খরচ চালাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হতে বসেছেন। বন মামলায় কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পেয়ে নতুন করে আবারও জড়িয়ে পড়েছেন মামলায়- এমন নজিরও রয়েছে। এভাবে মামলার মরণফাঁদে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে আদিবাসী জীবন। অথচ আন্দোলনের মুখে মধুপুর ইকো পার্ক প্রকল্পটি সরকার আট বছর আগেই বাতিল ঘোষণা করেছে।
জলছত্র, কাঁকড়াগনি, বেদুরিয়া, জয়নাগাছাসহ বিভিন্ন এলাকার আদিবাসীরা বলছেন, এসব মামলার মধ্যে ইকো-পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলার সংখ্যাই বেশি। তাই তাঁরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে এসব 'হয়রানিমূলক বন মামলা'র দ্রুত নিষ্পত্তি চান। অন্যদিকে বন কর্তৃপক্ষও স্বীকার করে বলছে, এর আগে মধুপুরে প্রতিবছর গড়ে সাড়ে তিন শ বন মামলা দায়ের করা হতো। 'এসব মামলা সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে'- এমন বিবেচনায় গত দুই বছরে বন কর্তৃপক্ষ নতুন কোনো মামলা করেনি। এখন তারা পুরনো বন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবছে। তবে এসবই সময়সাপেক্ষ।
জানা গেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে ৪৭৮ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী শালবনে কয়েক শ বছর ধরে প্রায় আড়াই হাজার গারো ও কোচ আদিবাসীর বসবাস। ২০০০ সালে বন বিভাগ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সেখানে ইকো পার্ক প্রকল্প করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, বনের মাঝখানে হবে ১০টি পিকনিক স্পট এবং ছয়টি ব্যারাক। বিশাল জায়গাজুড়ে দেওয়াল তুলে ঘিরে ফেলা হবে পুরো পার্ক এলাকা। তবে সে সময় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বন কর্তৃপক্ষ বনের স্থানীয় অধিবাসী আদিবাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। বন থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কায় আদিবাসীরা ইকো পার্ক প্রকল্প প্রতিরোধের জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি বনরক্ষী ও পুলিশ গুলি চালালে আদিবাসী নেতা পিরেন স্নাল মৃত্যুবরণ করেন। গুলিতে আহত হন ৩৪ জন নারী-পুরুষ। এরপর সরকার মধুপুর ইকো পার্ক প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে। তবে সেই সময় আন্দোলনে জড়িত আদিবাসী নারী-পুরুষের বিরুদ্ধে বন আইনে শত শত মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলাগুলো এখনো চলছে।
এদিকে গত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলকে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী। পরে পুলিশ 'ক্রসফায়ারে' নিহত বলে দাবি করে চলেশের পরিবারকে তাঁর মৃতদেহ হস্তান্তর করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী আদিবাসীদের অভিযোগ, গ্রেপ্তারকৃত চলেশ রিছিলকে জানালার গ্রিলে ঝুলিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ৯ সদস্য নির্যাতন করেছিল। এ কারণেই সে সময় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁরা জানান, চলেশের মরদেহ পরীক্ষা করে দেখা হয়, তাঁর চোখ দুটো ছিল উপড়ানো, ডান হাতের তিনটি আঙুলের নখও উপড়ে ফেলা হয়েছিল। তাঁর অণ্ডকোষ নষ্ট করে দেওয়া হয়, সারা গায়ে ছিল প্রচণ্ড আঘাতের চিহ্ন। মরদেহের ছবিতেও নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট ধরা পড়ে।
মধুপুরের প্রত্যন্ত পশ্চিম কাঁকড়াগনি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসী পঞ্চরাজ গাগরা (৫৮) কালের কণ্ঠকে জানান, ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের দায়ে ২০০৩ সালে তাঁর বিরুদ্ধে বন আইনে চারটি মামলা হয়। পরে ২০০৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আরো পাঁচটি মামলা। এসব মামলায় মোট ৭০ দিন কারাভোগের পর এখন তিনি জামিনে রয়েছেন। সবশেষ গত ৩০ এপ্রিল তিনি একটি মামলায় জেলা জজ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তবে একই দিন একই মামলায় হাজিরা না দেওয়ার জন্য নিহত আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলের বিরুদ্ধে আদালত একটি সমন বা হাজিরাসংক্রান্ত পরোয়ানা জারি করেন।
তিনি আরো জানান, ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনে পিরেন স্নাল নিহত হওয়ার দিনে (২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি) নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে পঙ্গু হন বেদুরিয়া গ্রামের উৎপল নকরেক। আদালতে নিয়মিত হাজিরা না দেওয়ায় গত ৩০ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধেও সমন জারি করা হয়েছে।
ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলন প্রসঙ্গে কৃষিজীবী পঞ্চরাজ গাগরা বলেন, 'এটি ছিল আমাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন। তাই আদিবাসীরা এই সামাজিক আন্দোলনে দলে দলে যোগ দিয়েছিল। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ছড়রার গুলিতে আমার স্ত্রী রহিলা সিমসাং, ছেলে মিঠুন, যুবরাজ ও তরুণ মারাত্মক আহত হয়। কিন্তু বন মামলার ভয়ে আমি তখন তাদের লুকিয়ে চিকিৎসা দিতে বাধ্য হই। এখন অভাবের কারণে আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছে। অন্যদিকে বছরের পর বছর জেলা সদরে গিয়ে মামলার খরচ চালাতে গিয়ে আমার এখন পথে বসার দশা।'
বেদুরিয়া গ্রামের কেজাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মালতী নকরেক (৪৫) জানান, একই বছর ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে রসুলপুর রেঞ্জ বন বিভাগ তিনটি বন মামলা করে। এই মামলাগুলোতে তিনি এখন জামিনে আছেন। তাঁর স্বামী আবেল মানখিনও (৫০) একই রকম আরেকটি মামলার আসামি ছিলেন। তবে ২০১০ সালে ওই মামলাটি থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন।
জয়নাগাছা গ্রামের কৃষক ইলারি কুবি (৪১) জানান, ১২ বছর আগে কয়েকজন আদিবাসী যুবক মিলে কাঠচোরদের একটি মোষ টানা গাড়ি আটক করেছিল। বন কর্তৃপক্ষ উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই কাঠ চুরির মামলা দায়ের করে। ১৯৯৬ সালের ওই মামলাটির পর ২০০৪ সালে ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হয় আরেকটি মামলা। শেষের মামলায় ২৪ দিন কারা ভোগ করে এখন তিনি দুটি মামলাতেই জামিনে আছেন।
তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় মধুপুরের এই শালবনে বাস করছি। অরণ্যের সন্তান হিসেবে যুগ যুগ ধরে আমরাই বন, জঙ্গল ও প্রকৃতিকে রক্ষা করে চলেছি। অথচ বরাবরই বন কর্তৃপক্ষ আমাদের বনের শত্রু মনে করে আসছে। তাই তারা আমাদের এভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। মামলার হাজিরা দিতে দিতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। আমাদের কারো মনে কোনো সুখ নেই।'
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং কালের কণ্ঠকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে নানা রকম বন মামলা আদিবাসীদের জন্য নিপীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আদিবাসীদের সব রকম হয়রানিমূলক বন মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু তারা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তিনি বলেন, '১৯২৭ সালের বন আইন মূলত একটি দমনমূলক কালো আইন। এই আইনে বন কর্তৃপক্ষ যে কারো বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে, এ জন্য কোনো সাক্ষীর প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের সুস্পষ্ট দাবি, বর্তমান বন আইন থেকে নির্যাতনমূলক ধারাগুলো বাদ দিয়ে আদিবাসীদের মতামতের ভিত্তিতে আইনটিকে সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হোক। এ ছাড়া আমরা চাই, আদিবাসীদের পরামর্শে সরকার যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে হয়রানিমূলক বন মামলাগুলো নিষ্পত্তি করে।' সঞ্জিব দ্রং বন ও ভূমির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক একটি ভূমি কমিশন গঠন করারও দাবি জানান।
মধুপুরের জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, আন্দোলনে নিহত চলেশ রিছিলের বিরুদ্ধে বন মামলায় সমন জারির ঘটনাই প্রমাণ করে মধুপুরে বন কর্তৃপক্ষ আদিবাসীদের বিরুদ্ধে কী নির্মম নির্যাতনই না চালাচ্ছে! তিনি বলেন, 'আমরা একের পর এক সরকার, বন ও পরিবেশমন্ত্রী, সচিব, বন বিভাগ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে হয়রানিমূলক বন মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের দাবি, যেন একটি বিশেষ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দ্রুত হয়রানিমূলক বন মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সরকারই আমাদের দাবি পূরণে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।'
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) অসীত রঞ্জন পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দু-আড়াই বছর আগেও প্রতিবছর মধুপুরে গড়ে সাড়ে তিন শ বন মামলা দায়ের করা হতো। আমি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আমার নির্দেশে এসব মামলায় কাউকে হয়রানির শিকার যাতে না হতে হয়, সে জন্য গত দুই বছরে এখানে নতুন কোনো মামলা হয়নি। এখন আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, ১০-১৫ বছরের পুরনো বন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার।'
তিনি জানান, মধুপুর ইকো পার্ক প্রকল্পটি আট বছর আগেই সরকার বাতিল করেছে। তাই ওই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দায়ের করা মামলাসহ অন্য বন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য তাদের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে। তবে সব মামলা রাতারাতি নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়।
আদিবাসীদের দাবি মেনে তাদের মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হবে কি না, জানতে চাইলে ডিএফও বলেন, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। তাই বন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আদিবাসী বা অ-আদিবাসী বিবেচনা করা সঠিক হবে না। তবে বন কর্তৃপক্ষ শিগগিরই সমস্যাটির সুরাহা চায়।__
http://webcache.googleusercontent.com/search?q=cache:BNLnVi4Ell8J:www.kalerkantho.com/index.php%3Fview%3Ddetails%26type%3Dgold%26data%3DAntivirus%26pub_no%3D969%26cat_id%3D1%26menu_id%3D14%26news_type_id%3D1%26index%3D1%26archiev%3Dyes%26arch_date%3D09-08-2012&client=firefox-a&hl=en&gl=bd&strip=0
No comments:
Post a Comment