পাহাড়, অরণ্য, ঝর্ণা, ধারায় আপাত নয়নাভিরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম সর্ম্পকে যারাই ওয়াকিবহাল, তারাই জানেন, প্রাকৃতিক শোভার স্বর্গভূমি পাহাড়ের রয়েছে অন্য আরেক বেদনা বিধুর রূপ।
শান্তিচুক্তির আগে অন্তত ১৩টি বড় ধরণের গণহত্যা হয়েছে সেখানে। লোগাং, লংগদু, নানিয়ারচর, বরকল, মাইচছড়ি, পানছড়ি, দীঘিনালা, কাউখালিসহ একের পর এক গণহত্যায় বরাবরই অকাতরে জীবন দিয়েছেন নিরস্ত্র আদিবাসী পাহাড়িরা।
সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহ দমনের নামে সেনা বাহিনীর এসব নিধনযজ্ঞের অপারেশনে বরাবরই সহযোগির ভূমিকা নিয়েছে পাহাড়ে অভিবাসিত বাঙালি সেটেলাররা। কখনো কখনো সেটেলাররাই গণহত্যার নেতৃত্বও দিয়েছে; তাদের প্রত্যক্ষ মদদদাতা হিসেবে কাজ করেছে সেনা বাহিনী। মেশিনগানের বুলেট আর ধারালো দায়ের কোপে ইতি ঘটেছে হাজারো জীবনের। [লিংক]
অশান্ত পাহাড়ে জীবন বাঁচাতে প্রায় ৭০ হাজার আদিবাসী পাহাড়ি ভারতের ত্রিপুরায় এক যুগেরও বেশী সময় শারণার্থীর গ্লানিময় জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। [লিংক] সেখানেও অনাহার, অপুষ্টি, চিকিৎসাহীনতায় মানুষ মরেছে ঝাঁকে ঝাঁকে। কল্পনা চাকমার তো অসংখ্য সম্ভাবনাময় তরুণ তাজা প্রাণ হারিয়ে গেছে চীরদিনের জন্য। [লিংক]
শান্তিচুক্তির পরে সাধারণ ক্ষমার আওতায় গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর প্রায় দুহাজার সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। বন্ধ হয়েছে সেনা-বাহিনীর সঙ্গে শান্তিবাহিনীর প্রায় দুদশকের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত। তবু সেটেলার-সেনা নেতৃত্বে আদিবাসী জনপদে সহিংস আক্রমণ বন্ধ হয়নি। এখনো ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনি দিয়ে সেটেলার হায়নারা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জীবন কেড়ে নিচ্ছে ভীত সন্ত্রস্ত পাহাড়িদের। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামই যেনো এখন ডাকাতদের গ্রাম।
অশান্ত পাহাড়ে জীবন বাঁচাতে প্রায় ৭০ হাজার আদিবাসী পাহাড়ি ভারতের ত্রিপুরায় এক যুগেরও বেশী সময় শারণার্থীর গ্লানিময় জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। [লিংক] সেখানেও অনাহার, অপুষ্টি, চিকিৎসাহীনতায় মানুষ মরেছে ঝাঁকে ঝাঁকে। কল্পনা চাকমার তো অসংখ্য সম্ভাবনাময় তরুণ তাজা প্রাণ হারিয়ে গেছে চীরদিনের জন্য। [লিংক]
শান্তিচুক্তির পরে সাধারণ ক্ষমার আওতায় গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর প্রায় দুহাজার সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। বন্ধ হয়েছে সেনা-বাহিনীর সঙ্গে শান্তিবাহিনীর প্রায় দুদশকের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত। তবু সেটেলার-সেনা নেতৃত্বে আদিবাসী জনপদে সহিংস আক্রমণ বন্ধ হয়নি। এখনো ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনি দিয়ে সেটেলার হায়নারা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জীবন কেড়ে নিচ্ছে ভীত সন্ত্রস্ত পাহাড়িদের। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামই যেনো এখন ডাকাতদের গ্রাম।
জমির দখলকে কেন্দ্র করে এই সেদিনও বাঘাইছড়িতে হয়েছে রক্তাক্ত সংঘাত। [লিংক] রামগড়ের সংঘাতের শিকার আদিবাসী কিশোরী মি প্রু’র রক্তাক্ত মুখোচ্ছবি নাড়া দিয়ে গেছে পুরো বিশ্ববাসীকে। [লিংক] চুক্তির পরে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ঘটেছে অন্তত ১৫ টি। এসব সংঘাত, সহিংস আক্রমনের মূল হোতা সেই সেটেলার-সেনা বাহিনী।
কেনো সেটেলার?
আগেই বলা হয়েছে, সেটেলার সমস্যাটি সেনা বাহিনী সৃষ্ট। শান্তিচুক্তির আগে, আটের দশকের শুরুতে সরকারি উদ্যোগে লক্ষ্যাধীক হত-দরিদ্র বাঙালিকে সমতল থেকে নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়ে। তাদের খাস জমি বরাদ্দ দেওয়ার লোভ দেখানো হয়েছিলো। নেপথ্যে ছিলো পাহাড়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট করার জলপাই রাজনীতি, যা এখন ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিপরীতে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠির ভোটবাজীর রাজনীতিতে পরিনত হয়েছে।
কথিত পুনর্বাসনের নামে সমতল থেকে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া সেটেলারদের প্রতিটি গুচ্ছগ্রাম গড়ে উঠেছে সেনাবাহিনীর স্থায়ী বা অস্থায়ী ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে। নিরাপত্তা প্রশ্নেই এই ব্যবস্থা হয়েছিলো, তা সহজেই বোধগম্য। বরাবরই গুচ্ছগ্রামের অধিবাসী সেটেলাররা রয়েছেন এক অবরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে। ১৯৮০ থেকে ৮৩ সালের দিকে ব্যাপক হারে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের এ এলাকায় নিয়ে আসা হয়। এ সময়ের মধ্যে তাদেরকে বিভিন্ন পাহাড়ে খাস জমি দেওয়া হলেও ১৯৮৬ সালের দিকে পাহাড়ি জনপদে গণহত্যার প্রেক্ষাপটে গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর পাল্টা হামলার কবল থেকে বাঁচাতে তাদেরকে নিয়ে আসা হয় সেনা ক্যাম্প কেন্দ্রীক পাহাড়গুলোতে। তখন থেকেই এ গুচ্ছগ্রামের অধিবাসী বাঙালিদের দেওয়া হচ্ছে সরকারি রেশন।
দুই দশক ধরে রেশন নির্ভর কয়েক হাজার সেটেলার পরিবার এখনো প্রতি মাসে রেশন পাচ্ছেন ৮৫ কেজি চাল। তবে অনিয়মিত এ রেশন নিয়ে গুচ্ছ গ্রামের শতকরা ৮০ভাগ লোক রয়েছেন চরম সমস্যার মধ্যে। বাকী ২০ ভাগ লোক এই রেশনিং ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছে স্বল্প পুঁজিতে অধিক লাভের রেশন ব্যবসা। গুচ্ছগ্রামবাসীর জন্য সরকার প্রদত্ত খয়রাতি রেশনের মাসিক বরাদ্ধ ২২৩০ দশমিক ৫৮৬ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। সর্বসাকুল্যে এইখাতে সরকারের বাৎসরিক ব্যয় প্রায় ৩৬ কোটি টাকা।
পরিসংখ্যান বলছে, ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ‘বিশেষ’ বা ‘উপজাতীয় এলাকা’র মর্যাদা ভোগ করতো, তখনও এই পাহাড়ি অঞ্চলে বাঙালি বসতি ছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৪১ সালে ছিলো ৯৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ পাহাড়ি ও দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ বাঙালি। পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ সালে জনসংখ্যার হার ছিল ৯১ ঃ ৯ এবং ১৯৬১ সালে ৮৮ ঃ ১২। কিন্তু ১৯৬৪ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ বা উপজাতীয় মর্যাদা বাতিল এবং বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বিশেষ সুবিধা’ নিশ্চিত না করায় বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ছিলো ৭৭ শতাংশ এবং বাঙালি ২৩ শতাংশ। শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সমতল এলাকা থেকে বাঙালিদের নিয়ে পাহাড়ের তিন জেলার ৮৮টি গ্রামে ৩১ হাজার ৬২০ পরিবারের এক লক্ষ ৩৬ হাজার ২৫৭ ব্যক্তিকে জায়গা-জমি দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়।
বংশ পরম্পরায় পরিবারগুলোর সংখ্যা আরও কয়েক হাজার বেড়ে গেছে। খাগড়াছড়ি জেলার মেরুং, মানিকছড়ি, পানছড়ি, রামগড়, আলুটিলা, মুসলিম পাড়া, অভ্যা, গৌরাঙ্গ পাড়া, লক্ষ্মীছড়ি, কমলছড়ি, বাবুছড়া ও সিন্দুকছড়ি, রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী, লংগদু , ঘাগড়া, বরকল, কাউখালী, বিলাইছড়ি, রাঙামাটি সদর, মারিশ্যা ও নানিয়াচর এবং বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম প্রভৃতি এলাকায় সেটেলাররা বসতি স্থাপন করেছে। সেটেলাররা ছিলো মূলতঃ সমতল এলাকায় দরিদ্র ও নদীভাঙ্গা ভূমিহীন পরিবার। ১৯৮১ সালে পাহাড়ি ছিলো ৫৮ দশমিক ছয় শতাংশ এবং বাঙালি ৪১ দশমিক চার শতাংশ। বর্তমানে সর্বশেষ আদম শুমারি অনুসারে সেখানে ৫১ শতাংশ বাঙালি এবং ৪৯ শতাংশ পাহাড়ি। বলা ভালো, শান্তিচুক্তির পরে সেনা বাহিনী-শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ হওয়ায় সেখানে অবাধ চলাচল উন্মুক্ত হয়েছে। নিজস্ব উদ্যোগেই পাহাড়ে সমতল থেকে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার বিষও ছড়াচ্ছে যথেচ্ছ। [লিংক]
[লিংক]
সাংবাদিকতা-অপ সাংবাদিকতা দশকের পর দশক ধরে পাহাড়ে চলে আসা সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে পড়েছে অনেক আগেই শান্তিচুক্তি বিরোধী বিএনপি-জামাতের গর্ভ¯্রাব ‘সম-অধিকার আন্দোলন’ নামক সেটেলার সংগঠনের নামে। সরাসরি সেনা তত্ত্বাবধানে সেখানে গড়ে উঠেছে শিক্ষিত টাউট শ্রেণী। শান্তিচুক্তির আগেও দৃশ্যপট ছিলো প্রায় একই।
পাহাড়ের প্রকাশ্য আন্দোলনের অমিত শক্তি (অভিক্ত) পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণপরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনকে প্রতিহত করতে সে সময় তৈরি করা হয়েছিলো উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটেলার সংগঠন বাঙালি ছাত্র পরিষদ, বাঙালি গণপরিষদ, মুখোশ-বাহিনী ইত্যাদি। নয়ের দশকের শুরুতে খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় (নামকরণটি সামরিক জান্তার) পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে ‘হুয়াঙ বোইও বা’ নামক একটি টিন শেডের পাঠাগার। পাহাড়িদের গণ আন্দোলন দমন করতে প্রথমে সেনা বাহিনী ও পরে মুখোশ-বাহিনী দুদফায় পাঠাগারটি পুড়িয়ে দেয়। ওই পাঠাগারে এই লেখকের দান করা এক ট্রাক বইপত্রসহ হাজার হাজার মূল্যবান বই, দুর্লভ দলিলপত্র ও ছবি সম্পূর্ণ ভস্মিভূত হয়। তবু আন্দোলন থামেনি।
সেনা ছত্রচ্ছায়া গড়ে ওঠা ওইসব হামলাকারী টাউট-দালাল শ্রেণীর দর্শনটি চরম সাম্প্রদায়িক; অনেকটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী-পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বেসামাল বচনের আদলে, যথা:
বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই বা বাঙালিরাই এদেশের আদিবাসী বা উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠিরা বহিরাগত– ইত্যাদি।
[লিংক]
দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানে অনুমেয়, সাম্প্রদায়িক দর্শনটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ জন্ম নিয়েছে সেনা ল্যাবরেটরির টেস্ট টিউবে। জলপাই-ভ্রুণ জাত দর্শনটি তাদেরই আশ্রয়-প্রশয়ে বহু বছর ধরে বিকশিত হচ্ছে পাহাড়ের কথিত শিক্ষিত-অর্ধ শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে। এমনকি সমতল থেকে পাহাড়ে বসত গড়া বাঙালি সাংবাদিকদের অনেকেই গ্যারিসনের হালুয়া-রুটির ভাগ নিতে মরিয়া ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাদের অনেকই বন উজাড় করা কাঠ চোরদের খাম-প্রাপ্ত সংবাদিকও বটে।
পাহাড়ের সাংবাদিকতার দৌড় জানতে খুব বেশী অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়বে না। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবান — এই তিনটি পার্বত্য জেলার তিনটি প্রেসক্লাব উদ্বোধন করেছেন সামরিক কর্তা। শান্তিচুক্তির আগে সেনা বাহিনী ভাড়াটে সাংবাদিক দিয়ে পার্বতি, মৈত্রী, গিরি দর্পনসহ বিভিন্ন নামে পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতো। সে সময় সরাসরি সব ধরণের সংবাদ ছিলো সেনা নিয়ন্ত্রিত। চুক্তির পর ওই স্থানীয় পত্রিকাগুলো এখনো টিকে আছে। কোনো কোনটি সাপ্তাহিকের কলোবর ছাড়িয়ে দৈনিক হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক দর্শনের আরো নতুন নতুন পত্রিকা। বরং এখন এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়েছে জাতীয় পত্রিকার সংবাদে, আন্তর্জালে এবং অসংখ্য বাংলা ব্লগে তো বটেই। [লিংক]
তারা কেউ একা নন পার্বত্য অপসাংবাদিকরা কেউ একা নন। তারা গোষ্ঠিবদ্ধ প্রেসক্লাব/রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ আরো নানান ব্যানারে যুথবদ্ধ। খাগড়াছড়ি-রাঙামাটির বহিরাগত সাংবাদিকরা প্রেসক্লাবের ব্যানারে বিভিন্ন সময় বরাদ্দ পেয়েছেন সরকারি জমির; হয়েছেন পাহাড়ের ‘স্থায়ী বাসিন্দা’।
বান্দরবানের সাংবাদিকরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেনো? তারা সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপে কেউ দোকান, কেউ বহুতল মার্কেটের মালিক হয়েছেন। প্রেসক্লাবের ঝাড়–ুদার থেকে টিভি ক্যামেরার সাংবাদিক হয়ে গাড়ি-বাড়ি করেছেন, এমন সাংবাদিকও সেখানে আছেন। আবার একজন স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক একই সঙ্গে জামাতের নেতা কাম সমঅধিকার আন্দোলনের নেতা।
তবে পাহাড়ের অপসাংবাদিকতার বাইরে সৎ সাংবাদিকের সংখ্যাও কম নেই। ক্ষীণ এই ধারায় পাহাড়ি-বাঙালি উভয় জাতিগোষ্ঠির সাংবাদিকরা রয়েছেন। সকলের শ্রদ্ধাভাজন, রাঙামাটির মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে’র নাম এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি একাধিক শিক্ষিত পাহাড়ি তরুণকে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি দিয়েছেন। এখনো সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সামজ উন্নয়নমূলক কাজে জড়িত তিনি। পাহাড়ের চারণ সাংবাদিক, সহব্লগার হরি কিশোর চাকমা তো আছেনই। [লিংক]
এবার অপসাংবাদিকতার সামান্য কিছু নমুনা দেখা যাক। সকলেই জানেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে সাধারণের মধ্যে একটি দৃষ্টি সুখের মোহ কাজ করে। বহু বছর ধরে পাঠ্য বই, চলচ্চিত্র এবং নানান সরকারি অনুষ্ঠানে বা বিদেশী অতিথির আগমনে উপস্থাপন করা হয় আদিবাসী নাচ-গান। সব মিলিয়ে এমন একটি ধারণা যুগের পর যুগ ধরে প্রচ্ছন্নভাবে ভ্রান্ত ধারণা গেঁথে দেওয়া হয়:
এক। এদেশের আদিবাসীরা খুব সুখেই আছেন। দুই। তারা নাচ-গানে পটু, মদ-শুকর-সাপ-ব্যাঙসহ আমোদ-প্রমোদে মত্ত। তিন। আদিবাসী মেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো, সুন্দরী, তারা প্রেমকাতর, যৌন আবেদনময়ী, বহুগামী এবং এসবই আদিবাসী সমাজ অনুমোদিত। চার। বিচিত্র জীবন-যাপনের কারণে আদিবাসী জীবনের সব চেয়ে কৌতুহল উদ্দীপক হচ্ছেন আদিবাসী নারী। তারা বিছানায় খুবই পারদর্শী। বিয়ে বা সামান্য অর্থের প্রলোভনে তাদের সহজেই পাওয়া যায় — ইত্যাদি।
[লিংক]
এ কারণে সারাদেশে মোবাইল ফোন বা আন্তর্জালে বিভিন্ন আপত্তিকর দৃশ্য বা ব্যক্তিগত প্রেমময় জীবন বা ব্লাক মেইলিং হেতু লুকিয়ে ধারণকৃত নগ্ন স্থিরচিত্র/চলচ্চিত্র আকারে ছড়িয়ে পড়লেও তারকা না হলে বা কুখ্যাত কোনো কীর্তি না হলে সংবাদ হয় না। সতর্কভাবে এসব সংবাদ উপস্থাপন করা হয়; লক্ষ্য থাকে অপরাধীকে ধরিয়ে দেওয়া এবং কোনোক্রমেই ঘটনার শিকার মেয়েটিকে হেনস্থা না করা।
কিন্তু অপসাংবাদিকতায় এ সবের বালাই নেই। পাহাড়ি মেয়েদের ভিডিও ক্লিপিং মোবাইলে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে? চমৎকার! ধরা যাক দু-একটি মাউস এবার! অপসাংবাদিক খুব হিসেব করে সংবাদপত্রের ভাষায় লিখলেন একটি রগরগে যৌন-কিচ্ছা। রসময় গুপ্ত ধরা দিলেন সংবাদপত্রের পাতায়। পাঠক জানলেন পাহাড়ি মেয়েদের বেলেল্লাপনার কিচ্ছা।…
আগেই বলা হয়েছে, সেটেলার সমস্যাটি সেনা বাহিনী সৃষ্ট। শান্তিচুক্তির আগে, আটের দশকের শুরুতে সরকারি উদ্যোগে লক্ষ্যাধীক হত-দরিদ্র বাঙালিকে সমতল থেকে নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়ে। তাদের খাস জমি বরাদ্দ দেওয়ার লোভ দেখানো হয়েছিলো। নেপথ্যে ছিলো পাহাড়ে জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট করার জলপাই রাজনীতি, যা এখন ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিপরীতে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠির ভোটবাজীর রাজনীতিতে পরিনত হয়েছে।
কথিত পুনর্বাসনের নামে সমতল থেকে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া সেটেলারদের প্রতিটি গুচ্ছগ্রাম গড়ে উঠেছে সেনাবাহিনীর স্থায়ী বা অস্থায়ী ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে। নিরাপত্তা প্রশ্নেই এই ব্যবস্থা হয়েছিলো, তা সহজেই বোধগম্য। বরাবরই গুচ্ছগ্রামের অধিবাসী সেটেলাররা রয়েছেন এক অবরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে। ১৯৮০ থেকে ৮৩ সালের দিকে ব্যাপক হারে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের এ এলাকায় নিয়ে আসা হয়। এ সময়ের মধ্যে তাদেরকে বিভিন্ন পাহাড়ে খাস জমি দেওয়া হলেও ১৯৮৬ সালের দিকে পাহাড়ি জনপদে গণহত্যার প্রেক্ষাপটে গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর পাল্টা হামলার কবল থেকে বাঁচাতে তাদেরকে নিয়ে আসা হয় সেনা ক্যাম্প কেন্দ্রীক পাহাড়গুলোতে। তখন থেকেই এ গুচ্ছগ্রামের অধিবাসী বাঙালিদের দেওয়া হচ্ছে সরকারি রেশন।
দুই দশক ধরে রেশন নির্ভর কয়েক হাজার সেটেলার পরিবার এখনো প্রতি মাসে রেশন পাচ্ছেন ৮৫ কেজি চাল। তবে অনিয়মিত এ রেশন নিয়ে গুচ্ছ গ্রামের শতকরা ৮০ভাগ লোক রয়েছেন চরম সমস্যার মধ্যে। বাকী ২০ ভাগ লোক এই রেশনিং ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছে স্বল্প পুঁজিতে অধিক লাভের রেশন ব্যবসা। গুচ্ছগ্রামবাসীর জন্য সরকার প্রদত্ত খয়রাতি রেশনের মাসিক বরাদ্ধ ২২৩০ দশমিক ৫৮৬ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। সর্বসাকুল্যে এইখাতে সরকারের বাৎসরিক ব্যয় প্রায় ৩৬ কোটি টাকা।
পরিসংখ্যান বলছে, ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ‘বিশেষ’ বা ‘উপজাতীয় এলাকা’র মর্যাদা ভোগ করতো, তখনও এই পাহাড়ি অঞ্চলে বাঙালি বসতি ছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৪১ সালে ছিলো ৯৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ পাহাড়ি ও দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ বাঙালি। পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ সালে জনসংখ্যার হার ছিল ৯১ ঃ ৯ এবং ১৯৬১ সালে ৮৮ ঃ ১২। কিন্তু ১৯৬৪ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ বা উপজাতীয় মর্যাদা বাতিল এবং বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বিশেষ সুবিধা’ নিশ্চিত না করায় বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ছিলো ৭৭ শতাংশ এবং বাঙালি ২৩ শতাংশ। শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সমতল এলাকা থেকে বাঙালিদের নিয়ে পাহাড়ের তিন জেলার ৮৮টি গ্রামে ৩১ হাজার ৬২০ পরিবারের এক লক্ষ ৩৬ হাজার ২৫৭ ব্যক্তিকে জায়গা-জমি দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়।
বংশ পরম্পরায় পরিবারগুলোর সংখ্যা আরও কয়েক হাজার বেড়ে গেছে। খাগড়াছড়ি জেলার মেরুং, মানিকছড়ি, পানছড়ি, রামগড়, আলুটিলা, মুসলিম পাড়া, অভ্যা, গৌরাঙ্গ পাড়া, লক্ষ্মীছড়ি, কমলছড়ি, বাবুছড়া ও সিন্দুকছড়ি, রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী, লংগদু , ঘাগড়া, বরকল, কাউখালী, বিলাইছড়ি, রাঙামাটি সদর, মারিশ্যা ও নানিয়াচর এবং বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম প্রভৃতি এলাকায় সেটেলাররা বসতি স্থাপন করেছে। সেটেলাররা ছিলো মূলতঃ সমতল এলাকায় দরিদ্র ও নদীভাঙ্গা ভূমিহীন পরিবার। ১৯৮১ সালে পাহাড়ি ছিলো ৫৮ দশমিক ছয় শতাংশ এবং বাঙালি ৪১ দশমিক চার শতাংশ। বর্তমানে সর্বশেষ আদম শুমারি অনুসারে সেখানে ৫১ শতাংশ বাঙালি এবং ৪৯ শতাংশ পাহাড়ি। বলা ভালো, শান্তিচুক্তির পরে সেনা বাহিনী-শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ হওয়ায় সেখানে অবাধ চলাচল উন্মুক্ত হয়েছে। নিজস্ব উদ্যোগেই পাহাড়ে সমতল থেকে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার বিষও ছড়াচ্ছে যথেচ্ছ। [লিংক]
[লিংক]
সাংবাদিকতা-অপ সাংবাদিকতা দশকের পর দশক ধরে পাহাড়ে চলে আসা সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে পড়েছে অনেক আগেই শান্তিচুক্তি বিরোধী বিএনপি-জামাতের গর্ভ¯্রাব ‘সম-অধিকার আন্দোলন’ নামক সেটেলার সংগঠনের নামে। সরাসরি সেনা তত্ত্বাবধানে সেখানে গড়ে উঠেছে শিক্ষিত টাউট শ্রেণী। শান্তিচুক্তির আগেও দৃশ্যপট ছিলো প্রায় একই।
পাহাড়ের প্রকাশ্য আন্দোলনের অমিত শক্তি (অভিক্ত) পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি গণপরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনকে প্রতিহত করতে সে সময় তৈরি করা হয়েছিলো উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটেলার সংগঠন বাঙালি ছাত্র পরিষদ, বাঙালি গণপরিষদ, মুখোশ-বাহিনী ইত্যাদি। নয়ের দশকের শুরুতে খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় (নামকরণটি সামরিক জান্তার) পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে ‘হুয়াঙ বোইও বা’ নামক একটি টিন শেডের পাঠাগার। পাহাড়িদের গণ আন্দোলন দমন করতে প্রথমে সেনা বাহিনী ও পরে মুখোশ-বাহিনী দুদফায় পাঠাগারটি পুড়িয়ে দেয়। ওই পাঠাগারে এই লেখকের দান করা এক ট্রাক বইপত্রসহ হাজার হাজার মূল্যবান বই, দুর্লভ দলিলপত্র ও ছবি সম্পূর্ণ ভস্মিভূত হয়। তবু আন্দোলন থামেনি।
সেনা ছত্রচ্ছায়া গড়ে ওঠা ওইসব হামলাকারী টাউট-দালাল শ্রেণীর দর্শনটি চরম সাম্প্রদায়িক; অনেকটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী-পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বেসামাল বচনের আদলে, যথা:
বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই বা বাঙালিরাই এদেশের আদিবাসী বা উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠিরা বহিরাগত– ইত্যাদি।
[লিংক]
দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানে অনুমেয়, সাম্প্রদায়িক দর্শনটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ জন্ম নিয়েছে সেনা ল্যাবরেটরির টেস্ট টিউবে। জলপাই-ভ্রুণ জাত দর্শনটি তাদেরই আশ্রয়-প্রশয়ে বহু বছর ধরে বিকশিত হচ্ছে পাহাড়ের কথিত শিক্ষিত-অর্ধ শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে। এমনকি সমতল থেকে পাহাড়ে বসত গড়া বাঙালি সাংবাদিকদের অনেকেই গ্যারিসনের হালুয়া-রুটির ভাগ নিতে মরিয়া ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাদের অনেকই বন উজাড় করা কাঠ চোরদের খাম-প্রাপ্ত সংবাদিকও বটে।
পাহাড়ের সাংবাদিকতার দৌড় জানতে খুব বেশী অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়বে না। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবান — এই তিনটি পার্বত্য জেলার তিনটি প্রেসক্লাব উদ্বোধন করেছেন সামরিক কর্তা। শান্তিচুক্তির আগে সেনা বাহিনী ভাড়াটে সাংবাদিক দিয়ে পার্বতি, মৈত্রী, গিরি দর্পনসহ বিভিন্ন নামে পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতো। সে সময় সরাসরি সব ধরণের সংবাদ ছিলো সেনা নিয়ন্ত্রিত। চুক্তির পর ওই স্থানীয় পত্রিকাগুলো এখনো টিকে আছে। কোনো কোনটি সাপ্তাহিকের কলোবর ছাড়িয়ে দৈনিক হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক দর্শনের আরো নতুন নতুন পত্রিকা। বরং এখন এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়েছে জাতীয় পত্রিকার সংবাদে, আন্তর্জালে এবং অসংখ্য বাংলা ব্লগে তো বটেই। [লিংক]
তারা কেউ একা নন পার্বত্য অপসাংবাদিকরা কেউ একা নন। তারা গোষ্ঠিবদ্ধ প্রেসক্লাব/রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ আরো নানান ব্যানারে যুথবদ্ধ। খাগড়াছড়ি-রাঙামাটির বহিরাগত সাংবাদিকরা প্রেসক্লাবের ব্যানারে বিভিন্ন সময় বরাদ্দ পেয়েছেন সরকারি জমির; হয়েছেন পাহাড়ের ‘স্থায়ী বাসিন্দা’।
বান্দরবানের সাংবাদিকরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেনো? তারা সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপে কেউ দোকান, কেউ বহুতল মার্কেটের মালিক হয়েছেন। প্রেসক্লাবের ঝাড়–ুদার থেকে টিভি ক্যামেরার সাংবাদিক হয়ে গাড়ি-বাড়ি করেছেন, এমন সাংবাদিকও সেখানে আছেন। আবার একজন স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক একই সঙ্গে জামাতের নেতা কাম সমঅধিকার আন্দোলনের নেতা।
তবে পাহাড়ের অপসাংবাদিকতার বাইরে সৎ সাংবাদিকের সংখ্যাও কম নেই। ক্ষীণ এই ধারায় পাহাড়ি-বাঙালি উভয় জাতিগোষ্ঠির সাংবাদিকরা রয়েছেন। সকলের শ্রদ্ধাভাজন, রাঙামাটির মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে’র নাম এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি একাধিক শিক্ষিত পাহাড়ি তরুণকে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি দিয়েছেন। এখনো সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সামজ উন্নয়নমূলক কাজে জড়িত তিনি। পাহাড়ের চারণ সাংবাদিক, সহব্লগার হরি কিশোর চাকমা তো আছেনই। [লিংক]
এবার অপসাংবাদিকতার সামান্য কিছু নমুনা দেখা যাক। সকলেই জানেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে সাধারণের মধ্যে একটি দৃষ্টি সুখের মোহ কাজ করে। বহু বছর ধরে পাঠ্য বই, চলচ্চিত্র এবং নানান সরকারি অনুষ্ঠানে বা বিদেশী অতিথির আগমনে উপস্থাপন করা হয় আদিবাসী নাচ-গান। সব মিলিয়ে এমন একটি ধারণা যুগের পর যুগ ধরে প্রচ্ছন্নভাবে ভ্রান্ত ধারণা গেঁথে দেওয়া হয়:
এক। এদেশের আদিবাসীরা খুব সুখেই আছেন। দুই। তারা নাচ-গানে পটু, মদ-শুকর-সাপ-ব্যাঙসহ আমোদ-প্রমোদে মত্ত। তিন। আদিবাসী মেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো, সুন্দরী, তারা প্রেমকাতর, যৌন আবেদনময়ী, বহুগামী এবং এসবই আদিবাসী সমাজ অনুমোদিত। চার। বিচিত্র জীবন-যাপনের কারণে আদিবাসী জীবনের সব চেয়ে কৌতুহল উদ্দীপক হচ্ছেন আদিবাসী নারী। তারা বিছানায় খুবই পারদর্শী। বিয়ে বা সামান্য অর্থের প্রলোভনে তাদের সহজেই পাওয়া যায় — ইত্যাদি।
[লিংক]
এ কারণে সারাদেশে মোবাইল ফোন বা আন্তর্জালে বিভিন্ন আপত্তিকর দৃশ্য বা ব্যক্তিগত প্রেমময় জীবন বা ব্লাক মেইলিং হেতু লুকিয়ে ধারণকৃত নগ্ন স্থিরচিত্র/চলচ্চিত্র আকারে ছড়িয়ে পড়লেও তারকা না হলে বা কুখ্যাত কোনো কীর্তি না হলে সংবাদ হয় না। সতর্কভাবে এসব সংবাদ উপস্থাপন করা হয়; লক্ষ্য থাকে অপরাধীকে ধরিয়ে দেওয়া এবং কোনোক্রমেই ঘটনার শিকার মেয়েটিকে হেনস্থা না করা।
কিন্তু অপসাংবাদিকতায় এ সবের বালাই নেই। পাহাড়ি মেয়েদের ভিডিও ক্লিপিং মোবাইলে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে? চমৎকার! ধরা যাক দু-একটি মাউস এবার! অপসাংবাদিক খুব হিসেব করে সংবাদপত্রের ভাষায় লিখলেন একটি রগরগে যৌন-কিচ্ছা। রসময় গুপ্ত ধরা দিলেন সংবাদপত্রের পাতায়। পাঠক জানলেন পাহাড়ি মেয়েদের বেলেল্লাপনার কিচ্ছা।…
মোবাইল ফোনসেট আর গোপন ক্যামেরায় বিপন্ন প্রেম!পাতা ফাঁদে পাহাড়ি তরুণীরা
ফজলে এলাহী, রাঙামাটি
একের পর এক প্রতারণার ঘটনা ফাঁস হচ্ছে আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে রাঙামাটিতে। ভালোবাসার অভিনয় করেই মূলত অপরাধ ঘটাচ্ছে অপরাধীরা। সম্প্রতি রাঙামাটি শহরে কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে গোপন মেলামেশার স্থির ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে রাঙামাটি শহরের অভিভাবকদের মধ্যে। অপকর্মের হোতারা ঘটনা ঘটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, একই সঙ্গে তা মোবাইল ফোনসেটের ব্লুট্রুথের মাধ্যমে অন্য মোবাইল ফোনসেটসহ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বিপাকে পড়ছে সংশ্লিষ্ট তরণীরা ও তাদের পরিবার।
প্রায় এক বছর আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হয়ে রাঙামাটিতে চাকরি করতে আসা এক শ্রীলঙ্কান কর্মকর্তা রাঙামাটি ছেড়ে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কা থেকেই তার পরিচিতদের ই-মেইলে একটি ভিডিও ফুটেজ এবং কিছু স্থির ছবি পাঠায়। সেখানে রাঙামাটি শহরের কলেজগেট এলাকার এক চাকমা গৃহবধূর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের খোলামেলা দৃশ্য আছে। এই ছবি ও ফুটেজ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এক মোবাইল ফোনসেট থেকে আরেক মোবাইল ফোনসেটে। ফলে গৃহবধূটিকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়।
এরপর শহরের চম্পকনগর এলাকার একটি অভিজাত পরিবারের এক মেয়ের ওয়েব ক্যামেরায় নিজের পরিচিত কারো সামনে নগ্ন হওয়াসংবলিত একটি ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। অভিজাত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় ঘটনাটি বেশ সাড়া ফেলে শহরে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফুটেজ ছড়িয়ে পড়লে মেয়েটির পরিবারের পক্ষ থেকে ইউটিউব ও ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সাইটে যোগাযোগ করে ফুটেজটির প্রচার কিছুটা বন্ধ করতে সক্ষম হয়।
এরপর কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ বের হয় পাহাড়ি তরুণীদের। এর মধ্যে শহরের তিনটি অভিজাত পরিবারের তিন মেয়ের ফুটেজ নিয়েই আলোচনা ছিল বেশি। এসব ফুটেজের বেশির ভাগই পাহাড়ি তরুণ-তরুণীদের। তবে সম্প্রতি আলোচনায় আসে গত সপ্তাহে পাওয়া দুইটি ফুটেজ। এ দুইটি ফুটেজের তরুণীরা পাহাড়ি হলেও অপরাধীরা বাঙালি। এর একটি ঘটনায় অভিযুক্ত তরুণ রাঙামাটি শহরের হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা। ফুটেজ প্রকাশের পর ঘটনার শিকার মেয়েটি বাদী হয়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণার অভিযোগ এনে কোতোয়ালি থানায় মামলা করে ওই ছেলেটির বিরুদ্ধে। ছেলেটি পলাতক। পুলিশ নিশ্চিত করেছে, এ ঘটনার পুরো ভিডিওটি ধারণ করা হয় কলেজগেট এলাকার মোটেল জর্জের একটি কক্ষে। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা নাসিরউদ্দিন শরীফ বলেন, ‘আমরা ঘটনার প্রকৃত চিত্র বের করার জন্য তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছি এবং একই সঙ্গে অপরাধীকে আটক করার জন্য অভিযান অব্যাহত আছে।’
একই সপ্তাহে রাঙামাটির বনরূপা এলাকার এক মোবাইল ফোনসেট বিক্রেতার সঙ্গে শহরের এক চাকমা তরুণীর কিছু স্থির ছবি প্রকাশ পায়। রিজার্ভবাজার এলাকার এ মেয়েটির সঙ্গে অপরাধ করা ছেলেটির বাসা ফরেস্ট কলোনি এলাকায়।
আবার ট্রাইবেল আদাম এলাকার দুই তরুণ-তরুণীর মোটরসাইকেল সেক্সের ফুটেজটি সাড়া ফেলে সর্বত্র। স্থানীয় দুই পাহাড়ি তরুণ-তরুণীর মোটরসাইকেলের ওপর খোলামেলা সেক্সের ফুটেজ এটি। আবার জাতিসংঘের একটি সহযোগী সংস্থায় চাকরিরত দুই পাহাড়ি সহকর্মীর ভিডিও ফুটেজ, একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ছবি, ঢাকার একটি বাসায় পাঁচ পাহাড়ি তরুণীর ব্যক্তিগত কিছু মুহূর্তের ছবি, ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত রাঙামাটির এক মারমা তরুণী মডেলের ব্যক্তিগত জীবনের ছবি এখন সহজলভ্য।
১৫ থেকে ২০টি ঘটনার স্থির ছবি ও ভিডিও ফুটেজ এখন এক শ্রেণীর যুবকের হাতে। এসব ফুটেজ ও ছবির একটি বড় অংশই গোপনে ধারণ করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্মতির ভিত্তিতেও।
[লিংক]
এ ঘটনায় সে সময় শিক্ষিত পাহাড়িদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তারা জনে জনে প্রতিবাদ জানান এই হেন কুৎসিত সাংবাদিকতার। তারা ঠিকই বুঝেছেন, ওই প্রতিবেদনে শুধু আদিবাসী মেয়ে নয়, পুরো পাহাড়ি আদিবাসী সমাজের মান-সন্মান নিয়ে টান দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এই লেখকও সে সময় বেশ কিছু প্রতিবাদী টেলিফোন ও এসএমএস পান। ফেসবুকে প্রতিবাদের বন্যা বয়ে যায়। আদিবাসী নারী সংগঠন সে সময় এ ঘটনায় মামলা দায়ের করার উদ্যোগও নিয়েছিলো। সংশ্লিষ্ট (অপ) সাংবাদিক একে তাকে ধরে সে যাত্রা কোনোক্রমে রেহাই পান।
এরপর কর্ণফুলি, কাপ্তাই লেক, চেঙ্গি, কাচালং, মাইনি, মাতামুহুরি, শঙ্খ নদীতে খানিকটা জল গড়িয়ে যায়। (অপ) সাংবাদিক কিছুদিন ঘাপটি মেরে থেকে আবার খোলসের মধ্য থেকে মাথা বের করেন। সময় বুঝে পেশ করেন আরেকটি শুভ্র অশ্ব ডিম্ব।
সম্প্রতি একমাসের মধ্যে পাহাড়ে দুজন আদিবাসী মেয়ে ধর্ষিত হওয়ায় ক্ষোভ জন্ম নেয় আদিবাসী মনে। সর্বশেষ ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। সুজাতা চাকমা নামে পঞ্চম শ্রেণী পড়–য়া একটি কিশোরী মেয়ে দুর্গম পাহাড়ে গরু চরাতে গেলে ইব্রাহিম এলাহী, ওরফে কাঞ্চন কুমার বিশ্বাস নামে এক বহিরাগত বাঙালি দুর্বৃত্ত মেয়েটি টেনে হিচড়ে গভীর জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষনের পর দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করে পালায়। অভিযুক্ত ধর্ষক বাঙালি সেটেলার বলে প্রকাশ পাওয়ায় পাহাড়িদের ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে পাহাড়ে খ- খ- প্রতিবাদী মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশ চলতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিবাদী মিছিল করেন পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীরা। আবারো ধর্ষক ও হত্যাকারীর বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় আন্তর্জাল। আবারো দাবি ওঠে পাহাড় থেকে সেনা-সেটেলার প্রত্যাহার করার জন্য। আবেগের বশে ফেসবুকের ফেকি কয়েকজন সেটেলার কিলিং মিশনও ঘোষণা করে!! অর্থাৎ জনমনে ক্ষোভটি এখন এতোই তীব্র।[লিংক]
আর এই সময়ই (অপ) সাংবাদিক অনুসন্ধান করে জানান, অভিযুক্ত ধর্ষক ও হত্যাকারী নাকি সেটেলার নন।
[লিংক]
যেনো ‘গোপন সত্য আবিস্কার/উদ্ঘটন’ এ সেটেলারদের সাতখুন মাফ হয়ে গেলো। উপপাদ্যের ভাষায়, অতএব প্রমাণিত হইলো যে, সব সেটেলারই খারাপ নহে। উহাদের মধ্যে ভালো লোকেরও অভাব নাই। ….
এ ঘটনায় পাহাড়ি জনপদে আবারো ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ছিঃ ছিঃ করে তারা ধীক্কার জানাচ্ছেন স্থানীয় কতিপয় (অপ) সাংবাদিককে। মনে করি, ওই চটুল সংবাদটিই সত্য। ধৃত ধর্ষক ও হত্যাকারী সত্য সত্যই কোনো সেটেলার নন। তিনি পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা না হয় ব্যক্তি উদ্যোগে বা কর্মসূত্রে পাহাড়ের বাসিন্দা বা নিছক বহিরাগত। কিন্তু এই গোপন সত্য উদঘাটনে জাতির কিবা এসে যায়? এতে সুবিধাভোগি হবেন কারা? এই সংবাদে কী হতভাগ্য মেয়েটির ধর্ষন ও হত্যা মামলা আরো কিছুটা গতিপ্রাপ্ত হবে? এর সংবাদমূল্যই বা কতটুকু? সবই প্রশ্নবিদ্ধ এবং একদম প্রকাশ্য (অপ) সাংবাদিক গং-এর কীর্তি, তথা দিগদর্শন।
পাহাড়ের একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এই লেখক চলতি বিবৃতির মাধ্যমে (অপ) সাংবাদিকতার তাবৎ ক্রিয়াকলাপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। আহ্বান জানাচ্ছেন, সব ধরণের (অপ) সাংবাদিকতা/অসৎ সাংবাদিকতা রুখে দেওয়ার। মুক্ত হোক শুদ্ধ চিন্তার, শুভ বুদ্ধির।। ….
—
সংযুক্ত: ফেসবুক গ্রুপ– পাহাড়ের রূদ্ধকণ্ঠ CHT Voice [লিংক]
No comments:
Post a Comment