বিপ্লব রহমান, দিনাজপুরের আদিবাসী অঞ্চল থেকে ফিরে:
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার চক বানারসি সাঁওতাল আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দা সালগিন হেমরমের (৭০) স্বামী চণ্ডু মার্ডি মারা গেছেন বছরখানেক আগে। একমাত্র ছেলেটিও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। স্বামী মারা যাওয়ার পর বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁর আট একর ধানি জমি দখল করে বসেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। জমি হারিয়ে বৃদ্ধ বয়সে ভিক্ষে করে দিন কাটছে তাঁর।
কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'জমি উদ্ধারের জন্য মামলা করব কিভাবে? আমার তো টাকা-পয়সা নেই। এখন শুধু ভিটেমাটিটুকুই সম্বল!'
একই উপজেলার মাটিয়াকুড়া গ্রামের আদিবাসী রামবাই হাসদা (৯৬) বেদখল হয়ে যাওয়া দুই একর ৩৮ শতক জমি ফিরে পেতে স্থানীয় ভূমি অফিসে মামলা করেছিলেন। মামলার রায়ও তাঁর পক্ষে গেছে। কিন্তু পেশিশক্তির কাছে হার মেনে দখলদারদের কবল থেকে তিনি জমি উদ্ধার করতে পারছেন না। তাঁর পরিবারের সবাই এখন দিনমজুরি করে কোনো রকমে দুবেলার আহার জোগাচ্ছেন।
সম্প্রতি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ, চিরিরবন্দর, ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ উপজেলার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে দত-দরিদ্র ভাষাগত সংখ্যালঘু সাঁওতালদের জমি কেড়ে নেওয়ার চিত্র। পুরো জেলার প্রায় পাঁচ লাখ আদিবাসী সাঁওতাল বহু বছর ধরে এমনিভাবে জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হতে বসেছে। সবখানেই যেন চলছে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়ার মহোৎসব!
এমনকি জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে সেখানে খুন, গণধর্ষণ ও সাঁওতাল নারীকে বিবস্ত্র করার একাধিক ঘটনাও ঘটেছে। আদিবাসী নেতারা এসব ঘটনার প্রতিকার দাবি করে বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করেছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। কেউ এসে দাঁড়ায়নি অসহায় মানুষগুলোর পক্ষে।
তবে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বলছে, তারা আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তারা প্রতিকার করতে সচেষ্ট। কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা আদিবাসীরা মামলা-মোকদ্দমাসহ নানা গ্রাম্য রাজনীতিতে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
নবাবগঞ্জের জয়পুর আমলাকাঁঠাল গ্রামের উমতি হেমরম (৪৫) জানান, ১৯ একর ১২ শতক জমির দখলকে কেন্দ্র করে ভূমিদস্যুরা ২০০৮ সালের ৬ জুন তাঁর স্বামী সরকার টুডু এবং অপর আদিবাসী সোম হাসদাকে নির্যাতন করে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে। থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাওয়ায় ১২ জুন আদালতে হত্যা মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই মামলার আসামি আবুল মেম্বার, বাবুল, কামাল, দুলাল, মন্তাজ ও লোকমান মেম্বার প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। বাকি জমিটুকুও তারা দখল করে নিয়েছে।
ফুলবাড়ীর আলুডাঙ্গা গ্রামের একজন ধর্ষিতা সাঁওতাল নারী জানান, খাস জমিতে বসবাসরত ১২টি আদিবাসী পরিবার দিনমজুরি করে জীবন যাপন করছে। তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে গত কয়েক বছরে দখলদাররা বেশ কয়েকবার গ্রামটিতে আগুন দিয়েছে। তাঁর নিজের ঘরটিই পাঁচবার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবশেষ গত মে মাসে মমিনুল, জাহিদুল, বেল্লাল, বিধু ও মোনাক তাঁকে ধর্ষণ করে। পুলিশের কাছে অভিযোগ দিলে তারা গ্রামের মাতবরদের দিয়ে সালিস বৈঠক করিয়ে ধর্ষকদের মাত্র দুই হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়।
বীরগঞ্জের বোচাপুকুর গ্রামে ৯ একর জমির দখলকে কেন্দ্র করে ২০০২ সালে গণধর্ষণের শিকার হন আরেক সাঁওতাল নারী। তিনি জানান, অভিযুক্ত ধর্ষক হবিবুর, মানিক, নয়ন, হীরা, বাবুসহ ছয় আসামির সবাই প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। ধর্ষণের বিচার আজও হয়নি। উপরন্তু জমিটুকু হারিয়ে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী পরিণত হয়েছেন দিনমজুরে।
একই উপজেলার ভোগনগর গ্রামের আরেক সাঁওতাল আদিবাসী নারী জানান, ২০ একর জমি দখল-বেখলের জের ধরে গত চৈত্র মাসে দখলদাররা লাঠিসোঁটা নিয়ে গ্রামে ঢুকে প্রকাশ্যে তাঁকে বিবস্ত্র করে। হামলাকারীরা মারধর করে তাঁর স্বামীর হাত ভেঙে পঙ্গু করে দিয়েছে। থানা অভিযোগ নিতে রাজি না হওয়ায় তিনি পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু এখনো এর বিচার হয়নি। তাঁর জমিটিও বেহাত হয়ে গেছে।
চিরিরবন্দর উপজেলার কাঁটাপাড়ায় গিয়ে জানা গেছে, সেখানেও দিন দিন বেদখল হয়ে যাচ্ছে আদিবাসীদের জমিজমা। গ্রামের বাসিন্দা গোর্কি মার্ডি (৫০) জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে আদিবাসীরা তিন একর ২৪ শতক খাস জমি কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু বছর দুয়েক হলো, দখলদাররা কবরস্থানের প্রায় দুই একর জমি দখল করে ধান চাষ করছে। কবরস্থানের বাকি অংশটুকুও দখল করার জন্য এখন সেখানে নানা ধরনের গাছ-বাঁশ লাগানো হচ্ছে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সরেণ কালের কণ্ঠকে জানান, দিনাজপুরের প্রায় পাঁচ লাখ আদিবাসী জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হতে বসেছে। প্রশাসন ও পুলিশ তাদের পক্ষে নেই।
তিনি বলেন, 'আদিবাসী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গত এক বছরে আমরা সমাবেশ, উপজেলা কার্যালয় ঘেরাও, মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশ, গণস্বাক্ষর জমা দেওয়াসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছি। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের সমস্যা সমাধানে গত ১০ আগস্ট প্রায় ১৫ হাজার আদিবাসীর অংশগ্রহণে রাজশাহী সদরে মহাসমাবেশও হয়েছে। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না।'
রবীন সরেণ বলেন, সরকারের উচিত হবে সমতলের আদিবাসীদের জমির বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য একটি পৃথক ও কার্যকর ভূমি কমিশন গঠন করা।
দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আদিবাসীরা শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে আছে। এ কারণে কোনো কোনো দখলদার চাপের মুখে তাদের জমিজমা থেকে উৎখাতও করে থাকতে পারে বলে আমরা জেনেছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা এ বিষয়ে তৎপর হতে পারি। তবে আদিবাসীরা যেন কোনো রকম চাপের মুখে জমিজমা বিক্রি না করে, আমরা সে চেষ্টা করছি। এর পরও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অনুমতি ছাড়া আদিবাসীদের জমি বেচা-কেনা বৈধ হবে না।'
পুলিশ সুপার সিদ্দিকী তাঞ্জিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, আদিবাসীরা লেখাপড়া জানে না বলে, কোনো কোনো মহল তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিচ্ছে। তারা যেন হয়রানির শিকার না হয়, সুবিচার পায়, সেটি দেখা পুলিশের কর্তব্য। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই পুলিশ যথাযথ আইনি ভূমিকা রাখবে।
আদিবাসী হত্যা ও গণধর্ষণ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ২০০৯ সাল পর্যন্ত কোনো হত্যা মামলা অমীমাংসিত নেই। পুলিশ সব মামলায় চার্জশিট দিয়েছে। একটি ধর্ষণ মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন। অপর ধর্ষণ মামলাটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তবেই তথ্য দেওয়া সম্ভব।
__
দৈনিক কালের কণ্ঠ, শেষ পাতা, ২২ আগস্ট ২০১০
লিংক: http://www.kalerkantho.com/print_edition/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=22-08-2010&type=gold&data=Cook&pub_no=262&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&index=1
No comments:
Post a Comment