বায়ান্ন, একাত্তর, নব্বইসহ বাংলাদেশের প্রতিটি গণ-আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সদা হাস্যোজ্জ্বল, সবার প্রিয় মধুদাকে (মধুসূদন দে) পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোরে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সামনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে তারা গুলি করে হত্যা করে মধুদা'র স্ত্রী যোগমায়া দে, তাঁর বড় ছেলে রঞ্জিত কুমার দে ও পুত্রবধূ রীনা রানী দে'কে। এই চার-চারটি হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী মধুর ক্যান্টিনের বর্তমান পরিচালক ও শহীদ মধুদার ছোট ছেলে অরুণ কুমার দে। দৈনিক কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় সে সময়ের ১০ বছরের শিশু অরুণ জানাচ্ছেন সেই নির্মম অভিজ্ঞতার কথা।
তিনি তখন নবকুমার ইনস্টিটিউটের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র।"২৫ মার্চ রাতে বাবা (মধুদা) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ীসংলঘ্ন স্টাফ কোয়ার্টারের দোতলা বাসায় ফিরে বললেন, ছাত্র-শিক্ষক সবাই খুব উত্তেজিত। দেশের অবস্থা ভালো না। কখন না জানি কী হয়ে যায়! সেটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। ওই রাতে আমরা ছোট ভাই-বোন তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু গভীর রাতে মেশিনগানের গুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। কী হচ্ছে, তা জানতে আমরা সবাই দৌড়ে বারান্দায় চলে আসি। দেখি পুরো ক্যাম্পাসের এখানে-সেখানে আগুন জ্বলছে। মাঝে মাঝে থেমে থেমে গুলি ও মর্টারের শব্দ। সেই সঙ্গে মানুষের 'বাঁচাও, বাঁচাও' চিৎকার, আকাশফাটা আর্তনাদ!"
তিনি কান্না চেপে ধরা গলায় বলে চলেন, 'ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পাক-সেনাদের কয়েকটি লরি আমাদের কোয়ার্টারের সামনে এসে থামে। তারা সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ওপরে এসে দরজায় লাথি মেরে ঘরে ঢোকে। সবার হাতে তাক করা বন্দুক। পাক-সেনাদের দেখে আমরা ছোটরা সবাই চিৎকার করে কাঁদছিলাম। ওরা আমাদের কাউকে লাথি মারে, কাউকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পেটায়, আবার কাউকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। ...যেন বাবাকে গুলি করতে না পারে, এ জন্য আমার মা তাঁকে জাপটে ধরে রেখেছিলেন। আমার চোখের সামনেই তারা মাকে একের পর এক গুলি করে। পিঠে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনি মাটিতে পড়ে যান। এরপর তারা ডান হাতে ও ডান পায়ে দুটি গুলি করে বাবাকে। গুলি করে হত্যা করে বড় ভাই ও তাঁর নববধূ স্ত্রীকে। কিন্তু তখনো বাবা আহত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন। এই হত্যাযজ্ঞের পর পাকিস্তানি সেনারা চলে যায়। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালী দুজন বাঙালিকে নিয়ে আবার ফেরত আসে। তাদের দিয়ে আহতাবস্থায় বাবাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় জগন্নাথ হলের দিকে। পরে শুনেছি, সেখানেই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়।'
'এরপর আমরা দিশেহারা অবস্থায় শুধুই মা, ভাই ও বৌদির রক্তাক্ত মৃতদেহ নিয়ে আহাজারি করছিলাম। কারফিউ শিথিল হলে আমার বাবার একজন বন্ধু হীরা লাল দে আমাদের খবর নিতে বাসায় আসেন। আমরা আট ভাইবোন প্রাণ বাঁচাতে ওই কাকার সঙ্গে কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায় চেপে সাভারে চলে যাই। পথে পথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চোখে পড়ে। এদিক-সেদিক আগুনে পোড়া, ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল লাশ আর লাশ। নদীতেও ভাসছিল অসংখ্য মৃতদেহ। পুরো ঢাকা শহর তখন যেনো এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।...১২ দিন সাভারে লুকিয়ে থেকে হীরা কাকার সঙ্গে আমরা চলে যাই গ্রামের বাড়ি শ্রীনগরে। যুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের বাসায় ফিরে শুনি মিউনিসিপাল করপোরেশন আমার মা, দাদা ও বৌদির লাশ সরিয়ে ফেলেছে। আমরা আজও শহীদদের কোনো লাশেরই সৎকার করতে পারিনি!'
http://www.kalerkantho.com/print_edition/?view=details&type=single&pub_no=115&menu_id=106&news_type_id=1&index=3&archiev=yes&arch_date=25-03-2010#.VRKMuY4rAdU
No comments:
Post a Comment