Sunday, March 4, 2007

অলৌকিক ইস্টিমার









ফরাসী নৌ - স্থপতি ইভ মার একাই ছোট্ট একটি জাহাজ চালিয়ে এ দেশে এসেছিলেন প্রায় দেড় দশক আগে। এর পর এ দেশের মানুষকে ভালোবেসে থেকে গেছেন এখানেই স্থায়ীভাবে। তার স্ত্রী রুনা খান মার টাঙ্গাইলের মেয়ে, অশোকা ফেলো। আশ্চর্য এই জুটি গত এক দশক ধরে উত্তরের চরে চালিয়ে আসছেন একটি নিরখরচের জাহাজ হাসপাতাল 'লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল'।

বৃহত্তর রংপুরের মঙ্গা পীড়িত চরাঞ্চলে এই জাহাজ - হাসপাতাল যমুনায় ভেসে ক্যাম্প করে গরীব মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। তারা অনুসন্ধানে দেখেছেন, দরিদ্র বাংলাদেশের সবচেয়ে হতদরিদ্র মানুষের বাস এই সব চরাঞ্চলে। ...

সাংবাদিকতার সুবাদে বছর পাঁচেক আগে রুনা খানের সঙ্গে আমার পরিচয়। কুড়িগ্রামের চরে জাহাজ হাসপাতালের ভেতরে বসে কথা হয় আমাদের।

রুনা আপা বলেন, বিপ্লব, আপনি কল্পনা করতে পারেন, সরকারি হাসপাতালে ১০ টাকার টিকিট কিনে চিকিৎসা তো দূরের কথা, মাত্র তিন টাকা নৌকা ভাড়া দিয়ে আমাদের এই হাসপাতালে এসে রোগি দেখাতে পারেন না, এমন মানুষও এইসব চরগুলোতে বাস করে!

*
আমি বিস্ময়ের সঙ্গে রুনা আপার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখি 'ফ্রেন্ডশিপ' এর ব্যানারে জাহাজ হাসপাতালটির কর্মকাণ্ড।

ইভ মার পুরো জাহাজটির কক্ষগুলোকে আউটডোর হাসপাতালে পরিনত করেছেন। সেখানে একেবারে বিনে পয়সায় সাধারণ সব ধরণের রোগিদের চিকিৎসা সেবা ও অষুধ দেওয়া হয়। সকাল থেকে জাহাজ ঘিরে রোগিদের দীর্ঘ লাইন, সবার হাতে হাতে কার্ড। এই কার্ডে রোগির নামধাম লিখে চিকিৎসা পত্র দেওয়া হয়। জটিল রোগিদের ফ্রেন্ডশিপ এর খরচে পাঠানো হয় গাইবান্ধা বা রংপুর বা লালমনিরহাট হাসপাতালে।

জাহাজ হাসপাতালে রয়েছে দাঁত, চোখ ও ছোটখাট কাঁটাছেড়ার রোগিদের অপারেশন করার ব্যবস্থা। গুরুতর রোগিদের জন্য রয়েছে চারটি বেড। আর দুর্গম চরাঞ্চল থেকে জাহাজ হাসপাতালে রোগি নিয়ে আসার জন্য রয়েছে কয়েকটি 'রিভার অ্যাম্বুলেন্স'।

রুনা আপা বললেন, এই রিভার অ্যাম্বুলেন্সটির ধারণা ইভের। ও নিজেই কাঠের কয়েকটি ডিঙ্গি নৌকার নকশা করে এতে ছোট্ট ইঞ্জিন বসিয়ে তৈরি করেছে এ সব অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করেছে।

কিন্তু দূর্গম চর থেকে রোগি আনতে হবে, এই খবর আপনারা জানতে পারেন কি ভাবে? আমি জানতে চাই।

রুনা আপা মুচকি হেসে বলেন, চলুন আপনাকে সরেজমিনে ঘুরে দেখাই।

*
আমরা জাহাজ লাগোয়া একটি রিভার অ্যাম্বুলেন্সে করে রওনা দেই যমুনার ঘোলা জল ভেঙে। নাম বিস্মৃত এক চরে পৌঁছে দেখি এক গ্রামে একটি ঘরের ভেতরে হেল্থ ক্যাম্প করে স্বাস্থ্য জ্ঞান দিচ্ছেন অল্প বয়সী একজন মেয়ে। তিনি একজন স্বাস্থ্য কর্মী। নাম মাত্র বেতনে জাহাজ হাসপাতালের জন্য কাজ করেন। জাহাজের দুজন চিকিৎসকের বেতনও অবশ্য তাই। পুরোটাই প্রায় স্বেচ্ছাশ্রম।

এ রকম আরো দু একটি চর ঘুরে জানতে পারি, একেকটি চরে এরকম হেল্থ ক্যম্প করে জাহাজ হাসপাতালের তালিকাভুক্ত স্বাস্থ্য কর্মীরা চরের মানুষকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করেন। তারা ছোটখাটো অসুখের চিকিৎসাও দেন। বাকি রোগিদের হয় জাহাজ হাসপাতালে, না হয় ধারেকাছের সরকারি হাসপাতালে পাঠান। আর এ সব হাসপাতালে রোগি পৌঁছে দেয় রিভার অ্যাম্বুলেন্স।

পুরো নেট ওয়ার্কটি জাহাজ থেকে পরিচালনা করা হয় মোবাইল টেলিফোনের মাধ্যমে। প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে রয়েছে একটি করে মোবাইল ফোন।

জাহাজ হাসপাতাল কিম্বা হেল্থ ক্যাম্পের নিরাপত্তা? কোনো সমস্যা হয় না?

এই প্রশ্নের জবাবে রুনা আপা বলেন, দেখুন বিপ্লব, আমি তো এ দেশেরই মেয়ে। আমি গ্রামের মানুষকে খুব ভালো করে চিনি। গ্রামের গরীব মানুষেরা এখনো খাঁটি আছে, নির্লোভ রয়েছে। তারা ভালোবাসার দাম দিতে জানে। যত সমস্যা আমাদের মতো শহুরে শিক্ষিতদের নিয়ে। ...আমার শক্তি এই সব গ্রামের সাধারণ মানুষ; যারা হয়তো দুবেলা পেট পুরে খেতে পায় না, যাদের পরনে হয়তো ভালো কাপড় নেই, কিন্তু তাদের ভেতরটা একদম সাদা। ...আমরা এখনো গ্রামের মানুষের দিক থেকে কোনো সমস্যা বা বাধার মুখোমুখি হয়নি।

*
এর পর আমি ঢাকায় ফিরে তখনকার কর্মস্থল দৈনিক যুগান্তরে 'উত্তরের চরে এক অলৌকিক ইস্টিমার' শিরোনামে সচিত্র ফিচার সংবাদ করি জাহাজ হাসপাতালের ওপর।

এই সংবাদটির সূত্রে ইভ - রুনা মারের সঙ্গে আমার সখ্যতা বাড়ে। পরে আমি যুগান্তরে আরেকটি ব্রেকিং নিউজ করি এই দম্পত্তির নৌকার ওপর গবেষণা নিয়ে।

সেই খবরটি হচ্ছে, মসলিন বা জামদানি নয়। বাংলাদেশের বাঙালির সবচেয়ে প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হচ্ছে কাঠের নৌকা!

এই নৌকা শিল্পটি গত প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে এখনো অনেকটাই অকৃত্রিম নকশায় টিকে আছে, যা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ইঞ্জিন নৌকা বা শ্যালো বোট এর কল্যাণে। এর পরেও নৌকার কারিগররা এখনো তৈরি করে চলেছেন বজরা, ছিপ, পানসি, ডিঙ্গি বা সাম্পন। ...

মজার তথ্য হচ্ছে, পশ্চিমায় যখন ধাতব গজাল বা তারকাটা ব্যবহার করা হতো কাঠের নৌকায়, তখনো এ দেশে নৌকার কারিগররা ব্যবহার করতেন কাঠের খিল বা গজাল, যা চুইয়ে পানি প্রবেশ করে না। আর গাবের আঠায় নৌকাগুলোকে পানি প্রতিরোধক ও টেকসই করা হতো।

ইভ - রুনা মার গবেষণায় জেনেছেন, নৌকার এই কারিগররা এখনো এই কৌশল অবলম্বন করে পুরোনো ঐতিহ্যের নৌকা তৈরি করছেন।

*
এরপর একাধিকবার রুনা আপার আমন্ত্রণে গিয়েছি, সেই অলৌকিক ইস্টিমারে। মঙ্গা বা রিভার অ্যাম্বুলেন্স, হেল্থ ক্যাম্প অথবা তাদের 'নৌকার জাদুঘর' এর ওপরে একাধিক প্রতিবেদন করি। অংশ নেই তাদের একাধিক সংবাদ সম্মেলন ও প্রদর্শনীতে।

ছোট ছোট নৌকার মডেল তৈরি করে কিছুদিন আগে ইভ - রুনা মার ধানমণ্ডির বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে তুলে ধরেন নদী মাতৃক এক অবাক করা বাংলাদেশকে। এই প্রদর্শনীতে একই সঙ্গে দেখানো হয়, নৌকা তৈরির বিভিন্ন সাজ - সরঞ্জাম। কৌতুহলি দর্শকদের প্রশ্নের জবাব দিতে আয়োজনে হাজির ছিলেন কয়েকজন নৌকার কারিগর।

সাভারে স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধবসে ক্ষতিগ্রস্ত বা বন্যা, ঝড় ও সিডর আক্রান্তদের ত্রাণ দেওয়ার পাশাপাশি ইভ - রুনা মার এখন ব্যস্ত তাদের 'নৌকার জাদুঘর' প্রতিষ্ঠার এক দক্ষযজ্ঞ আয়োজন নিয়ে।

প্রথমে তাদের পরিকল্পনায় ছিলো সোনারগাঁও এর কোল ঘেঁষে শীতলক্ষ্যার পাড়ে বসানো হবে এই জাদুঘর। সেখানে কাঠের তৈরি বিভিন্ন মডেল নৌকা, নৌকার ছবি, নৌকায় ব্যবহৃত সাজ - সরজ্ঞাম ছাড়াও দর্শনার্থীদের নৌ ভ্রমণের সুযোগ থাকবে।

কিন্তু সোনারগাঁয় জমির দাম বেশ চড়া। তাছাড়া ঢাকা থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকটিও খুব সহজ সাধ্য হবে না। এখন স্থান পরিবর্তন করে আশুলিয়ার কাছাকাছি তৈরি হচ্ছে এই জাদুঘর। ইভ - রুনা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন এই জাদুঘরের জন্য অর্থের যোগান সংগ্রহ করতে।।
____

ছবি: ফ্রেন্ডশিপ।

No comments:

Post a Comment