(১) রাইস স্যালাইনগুলো বেশ করেছে।
প্যাকেটের গায়ে প্রস্তুত প্রণালির ক্ষুদে ছবি আছে। দুই হাতে চুড়ি পরা। সেবা মানেই
নারী? বিষয়টি
কি আপত্তিকর? নারীবাদী
কাম এনজিওগুলো কি বলে? ওরাই
তো নারীমুক্তি, মানবাধিকার
আর আদিবাসী মুক্তির জিম্মাদার্।
রাশিদাকে জিজ্ঞাসা করা যায়।
লালমাটিয়া মহিলা কলেজে পড়াতেন। এখন অবসর নিয়েছেন। ‘নারীপক্ষ’ করেন। ৬০ বছর বয়সেও
খুব সচল। দেখলে ৪০-৪৫ মনে হয়। চুলগুলো রং করে খানিকটা লালচে-কালো। শাহবাগের
‘অন্তরে’ রেঁস্তোরায় লুচি-আলুর দম খেতে খেতে মনোপজ সর্ম্পকে বলেছিলেন। আমাদের সঙ্গে
ছিলেন কানাডা থেকে গাড়ি চালিয়ে বিশ্ব পরিভ্রমণে বের হওয়া সাত্তার ভাই।
কাফকার চোখ জলছে। পাতা উল্টালেই
পান্ডুলিপির জলছাপ, খাগের
কলমে পাতার পর পাতা লেখা কি পরিশ্রমই না ছিল। আর এখন, শুধু স্পর্শে অভ্রের লিখি ইতং।
মোবাইলে ফোনেটিকে মায়াবী বা রিদমিকে বানান ফস্কে যায়। যেমন "জলছে" বানান
ভুল হলো। নিউটন ভাইয়ের চোখে পড়লে ঠিক বকে দেবেন। মাষ্টার মানুষ খুব সিরিয়াস। সেই
ছাত্র জীবন থেকে তার লেখার ভক্ত, এখনো ঘোর লেগে যায়। আর তার কন্যা
মীরা তো এক মীরাক্কেল! আমি তারও ভক্ত।
আগের বইমেলায় গান পয়েন্টে দিপু
কাফকা গিফট করেছিল। ছাত্রাবস্থায় কিছু পড়েছিলাম রূপান্তর. বিচার- এইসব। দিপুর সাথে
টাকা ছিল না। ব্যাংকার মানুষ, কার্ডে বই কিনে দিল। এইবার কেউ বই
দেয় নাই। অনেকেই আবার আমার বই "পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ" সৌজন্য চান। ভাবখানা
এমন, কষ্ট
করে পাহাড়-পর্বত ডিংগিয়েছেন, আরো কষ্ট করে পাহাড়ি জীবন নিয়ে বই
লিখেছেন, আবার
সেই বই পয়সা দিয়ে কিনে পড়তে হবে নাকি?
সৈয়দ মুজতবা আলী ভাষ্যমতে, আমি একখানা বই লিখেছি। কেউ সে বই
ছাপতে চায় না। তাই নিজেই পয়সা দিয়ে ছেপেছি। আমার বই তো কেউ কেনে না, তাই নিজেই মাঝে মাঝে কিনি। কি
কাণ্ড!
খুব ঘুম পাচ্ছে। আজকাল যখন-তখন
ঘুমিয়ে পড়ি। যখন তখন জেগে উঠি। মেশিনিস্ট মুভির মতো ব্যাপার, কতো বছর যে আয়েশ করে ঘুমাই না! আর
সেদিন টেলিফোনে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
...মেশিনিস্ট মুভিটা অনিন্দ্য
দিয়েছিল। সেও ব্যাংকার; গিটারে
রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে শুনিয়েছিল, ফুলে ফুলে ঢ'লে ঢ'লে বহে কি'বা মৃদু বায় ।।
তটিণী-র হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায় ...। ২৬ বছর বয়স, ক্ষুরধার বুদ্ধি, সম্পর্কে আমার ভাইপো, ওর প্রবাসী বাবা, আমার বড় ভাই মানব একসময় আজম খানের
গানের দলে গিটার বাজাতেন। তার কাছেই গিটারে হাতেখড়ি; সাতের দশকে আমার ভাই নকশাল হতে
গিয়েছিলেন। সেই ভাইয়ের দেওয়া এক স্টাম্পবুক ছেলেবেলা থেকে আগলে রেখেছি।
(২) আজকাল খুব মাথা ঘোরে। কাব্য করে বললে বলতে হয়, জীবনের
ঘূর্ণীপাকে এতটাই ঘুরিয়াছি যে,
আমার মাথা এখন সর্বদাই ঘোরে। ...
যদি কাফকার মতো করে বলতে পারতাম, ভয়ংকর এক দুনিয়া বয়ে চলেছি আমার
মাথার মধ্যে!...কিন্তু বস্তত তা নয়। এ কেবলই নানা রকম আধাঁর হাতড়ে ফেরা। পথিক, তুমি কি পথ
হারাইয়াছো? নাকি, তুমিই পথ? জীবন
ও সত্য?
সৈয়দ আসাদুল্লাহ সিরাজীর কথা মনে পড়ছে। তিনি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর
পুত্র ছিলেন। আমার নানু ইসাহাক সিরাজীর বড় ভাই হচ্ছেন ইসমাইল সিরাজী।
আমি ছেলেবেলায় সিরাজগঞ্জে আসাদুল্লাহ সিরাজীকে নানু বাড়ির উঠোনে
দেখেছি। লিচু গাছের নীচু একটি ডাল ধরে আছেন ফর্সা মতোন এক বুড়ো; খালি গা, পরনে লুঙ্গি।
আমায় দেখে হাতের ইশারায় ডাকলেন, তুই কার বেটা রে? আমি বাবার নাম
বললাম। তিনি হেসে বললেন, ওহ, মধু এসেছে!
মধু আমার মার ডাকনাম। তখনকার ডাক সাইটের নায়িকা মধুমালার সংগে
মিলিয়ে রাখা নাম। ভালো নাম, সৈয়দা আসগারী সিরাজী। মাও খুব সুন্দরী ছিলেন। পাকিস্তান আমালে
কলেজে পড়ার সময় গান করতেন, নাটক করতেন। বিয়ের আগে নাটক করতে গিয়ে বাবার সংগে পরিচয়।
সিরাজী একাই কবি ছিলেন, গীতিকার ছিলেন তা নয়। আসাদুল্লাহ
সিরাজীও খুব গান লিখতেন। মা বলতেন, ভাইয়ের গান। ভোর বেলায় আমার
মামাতো বোন অপর্না আপা হারমোনিয়াম বাজিয়ে তার লেখা গজল করতেন। আমরা ছোটরা মাদুরের
চারপাশে গোল হয়ে বসে শুনতাম:
‘আমি আধাঁরকে ভয় পেয়ে ভাই, পথ কখনো ছাড়বো না, আধাঁর যতো আসবে
ঘিরে, চলবো আমি ততই জোরে, যতই পড়বো, ততই উঠবো, পথ কখনো ছাড়বো
না’...
আমার বালক বেলায় আসাদুল্লাহ সিরাজীর একটা গান অনুমতি ছাড়া সিনামায়
ব্যবহার করা হয়েছিল। এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন, ‘ডাক দিয়াছেন
দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশীদিন তোদের মাঝারে’...
মার কাছে শুনেছি,
সিরাজীর নাতিরা এই নিয়ে মামলা করেছিলেন, কিন্তু গানের স্বরলিপি-
পান্ডুলিপি সংরক্ষিত নয় বলে তারা জিততে পারেনি।
আমার মামাতো বোনেরা গান ছেড়েছেন কবে! ছেলেমেয়ে নিয়ে একেক জনের
সোনার সংসার্। শৈশবের নানু বাড়ি বলে এখন কিছু নেই। নানু বাড়ির সামনে দিয়ে এখন আর
সিটি বাজিয়ে ট্রেন চলে না। আম বাগান, লিচু বাগান কেটে বিরাট সব দালান।
সিরাজীর কবরটিও ধসে যাচ্ছে।...
রেডিও অফিসের সাবেক আপার ক্লার্ক আমার মা এখন ৭৩; এখনো সচল, রান্নাবান্না
সব এক হাতে করেন;আসুখ সারলে মাকে দেখতে যাবো। হা শৈশব! গ্ল্যাক্সো বেবি মিল্ক আর
ওভালটিন বিস্কুটের সৌরভমাখা সোনালি দিন!...
(৩) চারদিন হলো শয্যাশায়ী,
ঘুমের খুব ব্যাঘাত
হচ্ছে। কচি ভাইয়ের কাছে ফোন করে অষুধ চাইলাম। ডা. মনিরুল ইসলাম কচি। সেই ছাত্র
জীবন থেকে সখ্য, কচি ভাই আমাদের নেতা ছিলেন। তিনি একটা
ঘুমের বড়ি নিতে বললেন। সব অষুধে আমার প্রচণ্ড অনিহা। কিন্তু এখন উপায় তো নাই
গোলাম হোসেন!
বছর ১৫ আগে আমি টানা
১১ দিন ঘুমাইনি। ১১ দিন ১১ রাত, সে এক খর দহন কাল, বয়স ছিল রেসের ঘোড়া। প্রথম বিচ্ছেদ বেলায় মনে হচ্ছিল ঢাকাই
ছবির ডায়লগ, ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে খাক হয়ে
গেছে!’ সেবারও ঘুমের বড়ি দিয়েছিলেন কচি ভাই। তাতেও
কাজ না হওয়ায় তলস্তয়ের ‘পুনরুজ্জীবন’ তৃতীয় দফায় পড়তে গিয়ে নিদান হলো।
কচি ভাই সিলেটে ওসমানী মেডিকেলে পড়তেন।
ছুটিতে ঢাকায় এলে তাকে নিয়ে ছাত্র ফেডারেশনের দেওয়াল লিখনে বের হতাম। তার
হস্তাক্ষর সেরাম সুন্দর। দেওয়াল লিখনকে আমরা বলতাম ‘চিকা মারা’, এ নিয়ে ’চিকা মারো, ভাই চিকা মারো’ নামে একদা ব্লগ নোট
লিখেছিলাম। সেটি গুগল করলে পাওয়া যাবে?
ছাপার কালির সংগে
তারপিন তেল মিশিয়ে তৈরি হতো কালি। আসবাব রং করার ব্রাশ দিয়ে লেখা হতো আগুন ঝরানো
শ্লোগান; তখন এরশাদ বিরোধী ছাত্র জনতার
অভূত্থানের কাল।
‘আমাদের ধমনীতে
শহীদের রক্ত, এই রক্ত কোনোদিন পরাভব মানে না’...
আমার বাবা আজিজ মেহের
(৮৩) সাবেক নকশাল নেতা ছিলেন। ১৯৭০ সালে কমিউনিস্ট নেতা মনি সিংকে পাক সামরিক
জান্তা গ্রেফতার করলে কারফিউয়ের ভেতর সাদা চুন দিয়ে তারা ঢাকার কালো পথে চিকা
লিখেছিলেন, ‘কমরেড মনি সিংহের মুক্তি চাই!’
এক-এগারোর সেনা
শাসনকালে দারুণ সব দেওয়াল লিখন কাপিয়েছিল দেশ;
এর মধ্যে একটি ছিল
এরকম:
‘মর বাংগালী না খেয়ে
ভাত
ফখরুদ্দীনের আশির্বাদ!’...
ফখরুদ্দীনের আশির্বাদ!’...
(৪) ঘুমের ভেতর মনে হচ্ছিল ঝুম বিষ্টি হচ্ছে। আবার ভাবলাম মনের ভুল।
ভাবতে ভাবতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
আধো জাগরণে মনে হলো, কাকভেজা হয়ে ইউসুফ এসেছে। আমি ফোন
করেছিলাম, হয়তো তাই। গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ইউসুফ ভেজা হাত রাখলো
কপালে। আর আমি পুরোপুরি জেগে উঠলাম।
বাইরে সত্যিই জোর বিষ্টি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আধখোলা জানালা দিয়ে
অল্প অল্প বিষ্টির ছাট আসছে। আমি মুখ ধুয়ে জানালার ধারে চেয়ার পেতে বসি। ইউসুফ
হাতে চা - বিস্কুট ধরিয়ে দেয়। আমার হাত অল্প অল্প কাপে; অসুস্থতার পর
এখনো জের আছে।
জানালার বাইরে এদো গলি। মুখোমুখি দালান কোঠার জানালাপাঠ হাট করে
খোলা; একটি কচি হাত জানালার বাইরে বিষ্টি ছুতে চাইছে। নীচের গলি পথে পানি
জমতে শুরু করেছে। ছাতা মাথায় বিষ্টি বিব্রত অফিস যাত্রী।
এই সকালেই কোন বাড়ির বউ যেন শুটকি মাছ রান্না চড়িয়েছে। তীব্র
ঝাঁজালো গন্ধ ভেসে আসছে। মনে পড়লো বগালেক থেকে শাপলা শালুক টেনে সিদোল শুটকির ঝোল
করেছিল বুদ্ধজ্যোতি চাকমা।
একবাটি চিড়া কলা দই খেতে না খেতেই দুপুরে কি খাব, ইউসুফ জানতে
চাইছিল। আমি লইট্টা শুটকির ভুনা বলতে গিয়েও চেপে গেলাম। ইউসুফ নিজে থেকেই ডিমের
ঝোল করতে চাইলো। আমি মাথা কাত করে হাসপাতাল মেন্যু মেনে নিয়ে আবার বিছানায় আধশোয়া
হলাম। আবারো খুব ঘুম পাচ্ছে। বিষ্টি ধরে এলো বোধহয়।. . .
__
ছবি: বজ্র মেঘের নীচে গম ক্ষেত, ভ্যান গখ।
No comments:
Post a Comment