জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে (১২ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘ যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে রাতারাতি আন্তর্জাতিকভাবে আরেক দফা প্রশ্নবিদ্ধ হল বাংলাদেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলা এই গণঅভ্যুত্থানে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করার সম্ভাবনাও উঠে এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) ওই সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে।
এই প্রতিবেদন স্পষ্ট করেই রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎকে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে।
এদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংগঠিত গণহত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগামী অক্টোবরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে দুই-তিনটি মামলার রায় হয়ে যাবে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০৮টি হত্যা মামলা হয়েছে যার মধ্যে ১৬টি ট্রাইব্যুনালে গেছে।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, "রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে।"
তিনি আরও বলেন, "এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এক ধরনের ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে।"
২
শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন 'আয়নাঘর' খ্যাত সামরিক-বেসামারিক গোয়েন্দা বাহিনীর অসংখ্য টর্চার সেল। মিডিয়ার সামনে মুরগির খাঁচা মতো এসব 'আয়নাঘরের' উন্মোচন এবং মাইকেল চাকমাসহ কয়েকজন প্রাক্তন বন্দির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা পুরো জাতিকে হতভম্ব করে দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিরোজ আহমেদ মনে করেন, "আয়নাঘরের' অপরাধের প্রমাণাদি লুকানোর বিপুল চেষ্টার পরও যা জানা গেল, যা দেখা গেল, তা ভয়াবহ। 'আয়ানঘর'গুলোকে ভবিষ্যতের মানুষদের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত। এই যাদুঘরগুলো ভবিষ্যতে কারও হাসিনা হয়ে ওঠার পরণতি সম্পর্কে শিক্ষা দেবে, নাগরিকদের জোগাবে শক্তি।"
ফিরোজ বলেন, "(প্রবাসী সাংবাদিক) তাসনিম খলীল ও তার নেত্রনিউজের (নিউজ পোর্টাল) সহকর্মীদের সকলকে অভিনন্দন, তারাই এই 'আয়নাঘরের' অস্তিত্ব সম্পর্কে দেশের মানুষকে জানিয়েছেন। এর আগে আমরা জানতাম গুম হচ্ছে, কিন্তু গুম হওয়া মানুষদের পরিণতি সম্পর্কে কেউ কিছু জানতো না। 'আয়নাঘর' নিয়ে তাদের প্রতিবেদনগুলোর পর আমরা জানতে পারলাম এমন একটা ভয়াবহ প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্তের অস্তিত্ব।"
৩
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা ৩৬ জুলাইয়ের পট পরিবর্তনের পর দীর্ঘ বন্দিদশা কাটিয়ে 'আয়নাঘর' থেকে মুক্ত হয়েছেন।
বিবিসি'কে মাইকেল চাকমা জানান, গত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে বেশ কয়েকটি গোপন কারাগারে তাকে রাখা হয়েছে। শুরুর দিকে জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। তবে মাইকেল চাকমা জানিয়েছেন তাকে কোনো মারপিট করা হয়নি। তবে যেভাবে একাকী বন্দি করে রাখা হয় এবং যে পরিবেশে রাখা হয় সেটি তার ভাষায় অত্যন্ত অমানবিক এবং ভয়ংকর রকমের মানসিক অত্যাচার।
"যেভাবে তারা রাখে এটাতো অত্যন্ত অমানবিক। এটাতো মানুষের বসবাসের জায়গা না। মানুষ এভাবে বাঁচে না। এটাতো কবরের মতো। গুহা আছে না গুহা, গুহায় থাকলে মানুষ যেভাবে কিছুই দেখে না, কবরে থাকলে মানুষ যে কিছুই দেখে না ঠিক এই রকম।"
"এটাতো মানুষের বাঁচার মতো কোনো জায়গা না। কোনো জানলা নাই, একদম কোনো আলো ঢোকে না, বাতাস ঢোকে না শুধু চারিদিকে দেয়াল,” বলেন মাইকেল চাকমা।
৪
এদিকে, দিল্লির রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একের পর এক অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে যেসব বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার করছেন, দৃশ্যত তা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। এসব যে শুধু ইউনূস সরকারকে বিব্রত করছে তা-ই নয়, এসব প্রতিবেশী ভারত সরকারের জন্যও যথেষ্ট বিব্রতকর।
ভারতীয় কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা শশী থারুও জানিয়েছেন, হাসিনার বক্তব্যকে ঘিরে কংগ্রেস বিব্রত। সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্য পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। এটি আমাদের জন্য জটিলতা তৈরি করেছে। শেখ হাসিনার বিবৃতির ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।"
"বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে দুটি মূল মাপকাঠি রয়েছে" উল্লেখ করে কংগ্রেসের সিনিয়র এ নেতা আরও বলেন, "আমি দুটো বিষয়ের ওপর জোর দেবো। আমাদের এমন কিছু প্রকাশ্যে বা গোপনে করা উচিত নয়, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের জনগণের স্বার্থে বাংলাদেশের জনগণের মঙ্গলকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।"
"বাংলাদেশের ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভারতকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। যা ঘটছে, তা স্পর্শকাতর। তাই সবখানে এই ধারণা দেওয়া উচিত যে, আমরা কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর চেয়ে বাংলাদেশির কল্যাণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ", যোগ করেন তিনি।
৫
সম্প্রতি বুলডোজার বাহিনী শেখ মুজিবের বাসস্থান ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িসহ শেখ পরিবারের বেশকিছু বাড়িঘর ও আওয়ামী লীগ অফিস গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদের প্রতি ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তাইবলে ফ্যাসিবাদের ভাষায় আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কোনও ভাবেই সমথর্নযোগ্য নয়।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং একই সংগে এই ভবনটি মুক্তিযুদ্ধের নেতা থেকে ফ্যাসিস্ট শাসক হয়ে ওঠা শেখ মুজিবের দুঃশাসনের সাক্ষী। ঐতিহাসিক কারণেই এর সংরক্ষণ জরুরি ছিল।
প্রচ্ছন্ন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়ী, চিহ্ন, প্রতীক ভেঙে রাগ দেখানো যায়, ফ্যাসিবাদ যায় না, ফ্যাসিবাদের পুনরুৎপাদন হয়!উন্মত্ত জনতাকে মাঠে নামানো হয়েছে সম্ভবতঃ এনজিও ইউনূস সরকারের তাবৎ ব্যর্থতাসমূহ আড়াল করতে এবং আরও কিছু গুঢ় কারণে।
সরকার অনেক দেরিতে হাসিনা জামানার ভবন রক্ষায়, তথা আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে দেখে লালন সাঁইয়ের একটি গানের কথা মনে পড়ে, "গাছ কেটে জল ঢাল পাতায়, এ চাতুরী শিখলে কোথায়?"
এসব মব জাস্টিসের ফলে হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যা কিছু মৌন সমর্থন পেয়েছিল, জাতিসংঘের "গণহত্যা" বিষয়ক ওই তদন্ত প্রতিবেদনের পর তাদের ভবিষ্যতকে আরও কয়েক হাত মাটির নীচে নিয়ে গেল।
৬
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ও ড. ইউনূস অন্ততঃ দুই দফায় ঘোষণা করেছেন, আগামী ডিসেম্বরে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
দৃশ্যতঃই নিষিদ্ধ করা না হলেও এ নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ থেকে যাবে অংশগ্রহণের বাইরে। টানা ১৫ বছরের লুটপাট ও হেলমেট লীগের রাজনীতিতে রঘু ডাকাতের দলে পরিনত আওয়ামী লীগ অনেক আগেই হয়ে পড়েছে জনবিচ্ছিন্ন।
একটু পেছনে ফেরা যাক। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ বা ঢাকামুখী গণযাত্রার ডাক দেওয়া হয়। কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসা হাজার হাজার ছাত্র-জনতার উপরে সেনা বাহিনী গুলি চালাতে অস্বীকার করে।
একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, একজন পুলিশ কর্মকর্তা মোবাইলে ভিডিও দেখিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে বলছেন, "গুলি করি, মরে একটা…একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না!"
দেশজুড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে গত ৫ আগস্ট দুপুর নাগাদ সরকারের গদি নড়ে যাওয়ার খবর আসে। এ বেলা আড়াইটায় হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা, আশ্রয় নেন ভারতে; যদিও ১ আগস্টেই তিনি দম্ভ করে বলেছিলেন, "শেখ হাসিনা পালায় না!"
দৃশ্যত, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাচীন দল আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে গেছেন।
No comments:
Post a Comment