বিপ্লব রহমান, ঢাকা: মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের জঙ্গি হামলায় নৃশংসভাবে খুন হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার চর্চা ‘বিপদাপন্ন’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট অধ্যাপক ড. অজয় রায়।
মুক্তমনা ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের ৪৪তম জন্মদিনকে ( ১২ সেপ্টম্বর, শনিবার) সামনে রেখে নিহতের পিতা অধ্যাপক অজয় রায় নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ মন্তব্য করেন।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জঙ্গিরা কুপিয়ে খুন করে অভিজিৎ রায়কে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত অভিজিতের স্ত্রী, আরেক মুক্তমনা ব্লগার বন্যা আহমেদও জঙ্গি হামলায় আহত হন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই ব্লগার দম্পত্তি অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে দেশে এসেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় খোলামেলা কথনে তুলে ধরেন অনেক অজানা বিষয়। একের পর এক ব্লগার খুন হওয়ার প্রসঙ্গে নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে তিনি বলেন, ‘ফ্রি থিংকিং ইজ ইন ডেঞ্চার। কিন্তু আমি মনে করি, এটি একটি সাময়িক সঙ্কটকাল। কারণ, বাংলাদেশে ইসলাম চর্চার প্রেক্ষাপট, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম চর্চার প্রেক্ষাপট থেকে ভিন্ন। এদেশে ইসলাম হচ্ছে অনেকটাই সুফিবাদকেন্দ্রীক। এ কারণে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও তারা ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি বা জঙ্গিবাদ-মৌলবাদকে পছন্দ করে না। বরং মানুষে মানুষে ভাতৃত্ববোধ, সব ধর্মালম্বী মানুষের সহাবস্থান-এটিই এদেশের ধর্মীয় ঐতিহ্য। তাই শেষ পর্যন্ত এদেশে জঙ্গিরা খুব একটা সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না।’
অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘সরকারের উচিৎ হবে, জীবন ঝুঁকির মুখে থাকা ব্লগারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাদের সংখ্যা খুব বেশী নয় বলে এটি সম্ভব।’
‘জঙ্গিরা নাস্তিক ব্লগার বলে চিহ্নিত করে তালিকা ধরে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এখানে আমাদের কথা খুব পরিস্কার। নাস্তিক হোক, আর আস্তিক হোক, হত্যা একটি ফৌজদারি অপরাধ। সরকারকে সেভাবেই এসব হত্যার তদন্ত ও বিচার করতে হবে। কারো লেখালেখি যদি কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানে, তবে প্রচলিত আইনেই তার বিচার হতে পারে। কিন্তু কারো অধিকার নেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার। অথচ জঙ্গিরা তাই করছে।’
‘এ অবস্থায় মুক্তচিন্তা ও অনলাইন লেখালেখি অনেকটাই বিপদাপন্ন। ড. হুমায়ূন আজাদকে কুপিয়ে খুন (১১ আগস্ট ২০০৪) করে জঙ্গিরা তাদের মিশন শুরু করেছিল। শাহবাগ গণবিস্ফোরণের (২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়রি) ১০ দিনের মধ্যে খুন হন ব্লগার রাজিব হায়দার। এরপর মৌলবাদী জঙ্গিরা কুপিয়ে খুন করে আমার ছেলে অভিজিৎ রায়কে (এ বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি)। সিলেটে একইভাবে খুন হন (গত ১২ মে) আরেক মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। পরে ঢাকায় খুন হন আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু (৩০ মার্চ)। আর সর্বশেষ খুন হলেন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় (৭ আগস্ট)। একমাত্র ব্লগার বাবু হত্যাকাণ্ডের সময়ই জনতা হাতেনাতে দুজন খুনীকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে। এছাড়া পুলিশ এসব হত্যা মামলায় যাদের ধরেছে, তারা সকলেই সন্দেহভাজন। সরকারের উচিৎ হবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া। আর প্রগতিশীল ছাত্র-শিক্ষক-জনতার উচিৎ হবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এখনো এই কাজটি হচ্ছে না। অথচ এটি অব্যহতভাবে চালিয়ে যাওয়া খুব দরকার।’
প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন
অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘অভিজিৎ হত্যার সাত মাসে পুলিশ এ পর্যন্ত তিন-চারজনকে ধরেছে মাত্র, এর বেশী কিছু নয়। অথচ প্রধানমন্ত্রী আমাকে টেলিফোনে বলেছিলেন, এই হত্যার বিচার নাকি তার সরকারের টপ প্রায়োরিটি।’
তিনি বলেন, ‘তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না যে, প্রধানমন্ত্রী ব্লগার বিদ্বেষী। আওয়ামী লীগের কিছু কিছু লোক হয়তো ব্লগারদের সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার টেলিফোনে কথোকথন প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক ড. অজয় রায় বলেন, ‘অভিজিৎ খুন (২৬ ফেব্রুয়ারি) হওয়ার পর সম্ভবত ১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি ছিলাম না তো বাসায়। উনি ফোন করে একটি নম্বর দিয়েছিলেন। আমি ফোন ব্যক করলে তিনি বললেন, স্যার, আপনি আমার অনেকদিনের পরিচিত ও রেসপেক্টড পারসন। আপনি আমার হাজবেন্ডের (প্রয়াত পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া) সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আমি কী করতে পারি আপনার জন্য?’
‘আমি বললাম, আপনি প্রাইম মিনিস্টার। আপনি আমাকে বলছেন, আপনি কী করতে পারেন? আমি চাই, অভিজিতের হত্যাকারীদের ধরার ব্যবস্থা করা হোক। তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা হোক। উনি বললেন, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো স্যার। এই নম্বরটা রাখবেন, তবে খুব বেশী ব্যবহার করবেন না। যদি কখোনো প্রয়োজন বোধ করেন, এই নম্বরে টেলিফোন করলে আমাকে পাবেন।’
‘অভিজিৎ রায় হত্যার বিচার প্রসঙ্গে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বললেন, এটি আমার টপ প্রায়োরিটি। এরপরে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি।’
‘অভিজিতের লেখা সম্পর্কে উনি বলেছিলেন, অভিজিৎ খুব ট্যালেন্টেড পারসন ছিলেন। ওনার কিছু কিছু লেখা আমি পড়েছি। সব পড়িনি। আমি নিজেও তো লেখালেখি করি।’
১৯৭১ এ অভিজিতের জন্ম মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক অজয় রায় স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার ছেলে অভিজিতের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময়। ’৭১ এর ২৫ মার্চে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা শিক্ষকদের একটি গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সীমান্তে জড়ো হই। প্রথমে কুমিল্লার সোনামুড়া বর্ডারে যুদ্ধের ট্রেনিং নেই এবং একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। সে সময় অভিজিৎ ছিল আমার স্ত্রী শেফালি রায়ের পেটে। যুদ্ধের শুরুতেই আমি মা ও স্ত্রীকে সীমানার ওপারে আসামের তিনসুকিয়া আমার এক ভাইয়ের কাছে রেখে আসি। আমার ভাই সেখানে প্রকৌশলীর চাকরি করতেন, বিরাট বাংলোতে আমার মা আর স্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা হয়। যুদ্ধের ময়দানে একজন গেরিলা সোলজার এসে আমাকে পুত্র সন্তানের জন্মের খবর দেয়। আসামের শিবসাগর নামে ছোট একটি শহরের মাতৃসদনে অভিজিতের জন্ম। জন্মের সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেখানের চিকিৎসকরা তা থামাতে পারেননি। আমরা একটি অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করতে পেরেছিলাম। অসুস্থ অভিজিতের মা আর ছোট্ট অভিজিৎকে স্থানান্তর করি ডিগবয় হসপিটালে। পরে মা, স্ত্রী আর ছোট্ট অভিজিৎকে পাঠিয়ে দেই কলকতায়, আমার আত্নীয়-স্বজনদের কাছে। আর আমি আবার যুদ্ধে যোগ দেই। স্বাধীনতার পর আমি স্বপরিবারে বিমানে করে দেশে ফিরেছিলাম। কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার কাছ থেকে খবর পেয়ে অধ্যাপক আহমদ শরীফ বিমানবন্দরে আমাদের স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন।’
মুক্তমনার বিনির্মাণ অধ্যাপক অজয় রায় বলে চলেন, ‘স্বাধীনতার পর আমি আবার কর্মস্থলে যোগ দেই। ফুলার রোডে ১৩/এইচ, কোয়ার্টারে ছিল আমার বাসায়। ছোটবেলায় অভিজিৎ খুব দুষ্টুও ছিল না, আবার খুব শান্তও ছিল না। সে ছিল মাঝারি স্বাভাবের শান্ত ছেলে। তাকে ভর্তি করিয়ে দেই বাসার কাছেই ‘ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে’, পরে এটি উদয়ন স্কুল হয়। ঢাকা কলেজ শেষ করে অভিজিৎ ভর্তি হয় বুয়েটে।’
‘ছাত্রাবস্থায় অভিজিৎ ছিল খুব আড্ডাবাজ। ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরি ঘেঁষে ফুটপাথে বসে বন্ধুদের সঙ্গে দিনরাত আড্ডা দিত। সেখান থেকে তাকে সরানো যেত না। আড্ডা দিতে দিতে রাত ৮টা ৯টা বেজে যেত, এমন অবস্থা।’
‘বুয়েটে তার পাঠ্য ছিল মেকানিক্যাল ইঞ্জিরিয়ারিং। পরে সে ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’এ বায়ো টেকনোলজিতে প্রথমে এমফিল ও পরে পিএইচডি করে। আরো পরে সে যায় আমেরিকায়।’
অভিজিৎ রায় কী করে মুক্তমনা হলেন? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক অজয় রায় বলে চলেন, ‘অভিজিৎ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। তার প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা। কিন্তু ১৯৯৭ সালে আমি, আমার স্ত্রী, অভিজিৎ ও আমার ছোট ছেলে অনুজিৎসহ বেড়াতে যাই শান্তিনিকেতনে। সেখানে আমরা মাসখানেক ছিলাম। আমার ধারণা, শান্তিনিকেতনের পরিবেশ ও আবহাওয়া তার ভাবনার জগতে একটি বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটায়। সে হয়ে ওঠে একজন নতুন অভিজিতে।’
‘২০০০ সালের দিকে আমি নিজেই “মুক্তমনা” নামে একটি ওয়েবসাইট বানাই। তখন ছোট আকারে ছিল। তারপর অভিজিৎ যখন এই লাইনে ইন্টারেস্টেড হলো, ওর তো প্রযুক্তি জ্ঞান ছিল আমার চেয়ে বেশী। আমি তাকে বললাম এটি টেক ওভার করো। তুমি যদি মনে করো, এর নাম চেঞ্জ করতে হবে, তাহলে নাম চেঞ্জ করো। ও বলে, নাম চেঞ্জ করার দরকার নেই। মুক্তমনা ইজ আ ভেরি গুড নেম। তারপর ২০০১ সালে সে ডেভোলপড আ ওয়েব সাইট, বাংলা-ইংরেজী ব্লগ, অ্যান্ড ইট বিকাম আ ভেরি পপুলার সাইট। সেটি এখনো পপুলার।’
‘মুক্তমনা পপুলার হওয়ার পেছনে একটি আইডিয়া আছে। এক হলো- এরা কট্টর মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট নয়। আবার এরা রিলিজিয়াসও নয়। এর মাঝামাঝি… এদের আদর্শ হচ্ছে- সেক্যুলারিজম। আর লিবারেল ডেমোক্রেসি। এইটি হচ্ছে এর মূল। আর বিজ্ঞান চেতনা তো আছেই। এভরি ওয়ার্ল্ড ইভেন্ট, তারা চেষ্টা করলো, সবকিছু ব্যাখ্যা করতে, ইন সায়েন্টিফক লজিক। এ জন্যই এটি পপুলার হয়েছে। সারা বিশ্বে বহু লোক এর সঙ্গে জড়িত। এই ওয়েবসাইটের স্পেসটা একজন আমেরিকানের দেয়া। লেভিন বোধহয় ভদ্রলোকের নাম, ভুলে গেছি। সারাবিশ্বে হাজার হাজার এর পাঠক। রিচার্ড ডকিন্স নামে একজন বায়োলজিস্ট, তিনিও এর সঙ্গে জড়িত।’
অজয় রায় বলেন, ‘মুক্তমনা একটি আইডিয়া। এটি ব্লগারদের খুন করে নস্যাৎ করা যাবে না। মানুষের স্বাধীন ভাবনার স্বকিয়তা কখনোই কেউ চাপিয়ে দিয়ে বন্ধ করতে পারবে না। এটি সম্ভব নয়। তাই মুক্তমনার সংগ্রাম চলবেই।’
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/বিআর/এসএ
- See more at: http://bangla.newsnextbd.com/article188200.nnbd/#sthash.pyxxT2xN.dpuf
___
সংযুক্ত: ০১. ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, অভিজিৎ হত্যার বিচার টপ-প্রায়োরিটি’ (ভিডিও) [লিংক]
০২. ‘খুন করে মুক্তমনা নস্যাৎ করা যাবে না’ (ভিডিও) [লিংক]
মুক্তমনা ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের ৪৪তম জন্মদিনকে ( ১২ সেপ্টম্বর, শনিবার) সামনে রেখে নিহতের পিতা অধ্যাপক অজয় রায় নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ মন্তব্য করেন।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জঙ্গিরা কুপিয়ে খুন করে অভিজিৎ রায়কে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত অভিজিতের স্ত্রী, আরেক মুক্তমনা ব্লগার বন্যা আহমেদও জঙ্গি হামলায় আহত হন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই ব্লগার দম্পত্তি অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে দেশে এসেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় খোলামেলা কথনে তুলে ধরেন অনেক অজানা বিষয়। একের পর এক ব্লগার খুন হওয়ার প্রসঙ্গে নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে তিনি বলেন, ‘ফ্রি থিংকিং ইজ ইন ডেঞ্চার। কিন্তু আমি মনে করি, এটি একটি সাময়িক সঙ্কটকাল। কারণ, বাংলাদেশে ইসলাম চর্চার প্রেক্ষাপট, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম চর্চার প্রেক্ষাপট থেকে ভিন্ন। এদেশে ইসলাম হচ্ছে অনেকটাই সুফিবাদকেন্দ্রীক। এ কারণে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও তারা ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি বা জঙ্গিবাদ-মৌলবাদকে পছন্দ করে না। বরং মানুষে মানুষে ভাতৃত্ববোধ, সব ধর্মালম্বী মানুষের সহাবস্থান-এটিই এদেশের ধর্মীয় ঐতিহ্য। তাই শেষ পর্যন্ত এদেশে জঙ্গিরা খুব একটা সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না।’
অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘সরকারের উচিৎ হবে, জীবন ঝুঁকির মুখে থাকা ব্লগারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাদের সংখ্যা খুব বেশী নয় বলে এটি সম্ভব।’
‘জঙ্গিরা নাস্তিক ব্লগার বলে চিহ্নিত করে তালিকা ধরে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এখানে আমাদের কথা খুব পরিস্কার। নাস্তিক হোক, আর আস্তিক হোক, হত্যা একটি ফৌজদারি অপরাধ। সরকারকে সেভাবেই এসব হত্যার তদন্ত ও বিচার করতে হবে। কারো লেখালেখি যদি কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানে, তবে প্রচলিত আইনেই তার বিচার হতে পারে। কিন্তু কারো অধিকার নেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার। অথচ জঙ্গিরা তাই করছে।’
‘এ অবস্থায় মুক্তচিন্তা ও অনলাইন লেখালেখি অনেকটাই বিপদাপন্ন। ড. হুমায়ূন আজাদকে কুপিয়ে খুন (১১ আগস্ট ২০০৪) করে জঙ্গিরা তাদের মিশন শুরু করেছিল। শাহবাগ গণবিস্ফোরণের (২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়রি) ১০ দিনের মধ্যে খুন হন ব্লগার রাজিব হায়দার। এরপর মৌলবাদী জঙ্গিরা কুপিয়ে খুন করে আমার ছেলে অভিজিৎ রায়কে (এ বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি)। সিলেটে একইভাবে খুন হন (গত ১২ মে) আরেক মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। পরে ঢাকায় খুন হন আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু (৩০ মার্চ)। আর সর্বশেষ খুন হলেন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় (৭ আগস্ট)। একমাত্র ব্লগার বাবু হত্যাকাণ্ডের সময়ই জনতা হাতেনাতে দুজন খুনীকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে। এছাড়া পুলিশ এসব হত্যা মামলায় যাদের ধরেছে, তারা সকলেই সন্দেহভাজন। সরকারের উচিৎ হবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া। আর প্রগতিশীল ছাত্র-শিক্ষক-জনতার উচিৎ হবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এখনো এই কাজটি হচ্ছে না। অথচ এটি অব্যহতভাবে চালিয়ে যাওয়া খুব দরকার।’
প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন
অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘অভিজিৎ হত্যার সাত মাসে পুলিশ এ পর্যন্ত তিন-চারজনকে ধরেছে মাত্র, এর বেশী কিছু নয়। অথচ প্রধানমন্ত্রী আমাকে টেলিফোনে বলেছিলেন, এই হত্যার বিচার নাকি তার সরকারের টপ প্রায়োরিটি।’
তিনি বলেন, ‘তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না যে, প্রধানমন্ত্রী ব্লগার বিদ্বেষী। আওয়ামী লীগের কিছু কিছু লোক হয়তো ব্লগারদের সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার টেলিফোনে কথোকথন প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক ড. অজয় রায় বলেন, ‘অভিজিৎ খুন (২৬ ফেব্রুয়ারি) হওয়ার পর সম্ভবত ১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি ছিলাম না তো বাসায়। উনি ফোন করে একটি নম্বর দিয়েছিলেন। আমি ফোন ব্যক করলে তিনি বললেন, স্যার, আপনি আমার অনেকদিনের পরিচিত ও রেসপেক্টড পারসন। আপনি আমার হাজবেন্ডের (প্রয়াত পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া) সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আমি কী করতে পারি আপনার জন্য?’
‘আমি বললাম, আপনি প্রাইম মিনিস্টার। আপনি আমাকে বলছেন, আপনি কী করতে পারেন? আমি চাই, অভিজিতের হত্যাকারীদের ধরার ব্যবস্থা করা হোক। তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা হোক। উনি বললেন, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো স্যার। এই নম্বরটা রাখবেন, তবে খুব বেশী ব্যবহার করবেন না। যদি কখোনো প্রয়োজন বোধ করেন, এই নম্বরে টেলিফোন করলে আমাকে পাবেন।’
‘অভিজিৎ রায় হত্যার বিচার প্রসঙ্গে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বললেন, এটি আমার টপ প্রায়োরিটি। এরপরে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি।’
‘অভিজিতের লেখা সম্পর্কে উনি বলেছিলেন, অভিজিৎ খুব ট্যালেন্টেড পারসন ছিলেন। ওনার কিছু কিছু লেখা আমি পড়েছি। সব পড়িনি। আমি নিজেও তো লেখালেখি করি।’
১৯৭১ এ অভিজিতের জন্ম মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক অজয় রায় স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার ছেলে অভিজিতের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময়। ’৭১ এর ২৫ মার্চে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা শিক্ষকদের একটি গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সীমান্তে জড়ো হই। প্রথমে কুমিল্লার সোনামুড়া বর্ডারে যুদ্ধের ট্রেনিং নেই এবং একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। সে সময় অভিজিৎ ছিল আমার স্ত্রী শেফালি রায়ের পেটে। যুদ্ধের শুরুতেই আমি মা ও স্ত্রীকে সীমানার ওপারে আসামের তিনসুকিয়া আমার এক ভাইয়ের কাছে রেখে আসি। আমার ভাই সেখানে প্রকৌশলীর চাকরি করতেন, বিরাট বাংলোতে আমার মা আর স্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা হয়। যুদ্ধের ময়দানে একজন গেরিলা সোলজার এসে আমাকে পুত্র সন্তানের জন্মের খবর দেয়। আসামের শিবসাগর নামে ছোট একটি শহরের মাতৃসদনে অভিজিতের জন্ম। জন্মের সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেখানের চিকিৎসকরা তা থামাতে পারেননি। আমরা একটি অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করতে পেরেছিলাম। অসুস্থ অভিজিতের মা আর ছোট্ট অভিজিৎকে স্থানান্তর করি ডিগবয় হসপিটালে। পরে মা, স্ত্রী আর ছোট্ট অভিজিৎকে পাঠিয়ে দেই কলকতায়, আমার আত্নীয়-স্বজনদের কাছে। আর আমি আবার যুদ্ধে যোগ দেই। স্বাধীনতার পর আমি স্বপরিবারে বিমানে করে দেশে ফিরেছিলাম। কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার কাছ থেকে খবর পেয়ে অধ্যাপক আহমদ শরীফ বিমানবন্দরে আমাদের স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন।’
মুক্তমনার বিনির্মাণ অধ্যাপক অজয় রায় বলে চলেন, ‘স্বাধীনতার পর আমি আবার কর্মস্থলে যোগ দেই। ফুলার রোডে ১৩/এইচ, কোয়ার্টারে ছিল আমার বাসায়। ছোটবেলায় অভিজিৎ খুব দুষ্টুও ছিল না, আবার খুব শান্তও ছিল না। সে ছিল মাঝারি স্বাভাবের শান্ত ছেলে। তাকে ভর্তি করিয়ে দেই বাসার কাছেই ‘ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে’, পরে এটি উদয়ন স্কুল হয়। ঢাকা কলেজ শেষ করে অভিজিৎ ভর্তি হয় বুয়েটে।’
‘ছাত্রাবস্থায় অভিজিৎ ছিল খুব আড্ডাবাজ। ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরি ঘেঁষে ফুটপাথে বসে বন্ধুদের সঙ্গে দিনরাত আড্ডা দিত। সেখান থেকে তাকে সরানো যেত না। আড্ডা দিতে দিতে রাত ৮টা ৯টা বেজে যেত, এমন অবস্থা।’
‘বুয়েটে তার পাঠ্য ছিল মেকানিক্যাল ইঞ্জিরিয়ারিং। পরে সে ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’এ বায়ো টেকনোলজিতে প্রথমে এমফিল ও পরে পিএইচডি করে। আরো পরে সে যায় আমেরিকায়।’
অভিজিৎ রায় কী করে মুক্তমনা হলেন? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক অজয় রায় বলে চলেন, ‘অভিজিৎ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। তার প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা। কিন্তু ১৯৯৭ সালে আমি, আমার স্ত্রী, অভিজিৎ ও আমার ছোট ছেলে অনুজিৎসহ বেড়াতে যাই শান্তিনিকেতনে। সেখানে আমরা মাসখানেক ছিলাম। আমার ধারণা, শান্তিনিকেতনের পরিবেশ ও আবহাওয়া তার ভাবনার জগতে একটি বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটায়। সে হয়ে ওঠে একজন নতুন অভিজিতে।’
‘২০০০ সালের দিকে আমি নিজেই “মুক্তমনা” নামে একটি ওয়েবসাইট বানাই। তখন ছোট আকারে ছিল। তারপর অভিজিৎ যখন এই লাইনে ইন্টারেস্টেড হলো, ওর তো প্রযুক্তি জ্ঞান ছিল আমার চেয়ে বেশী। আমি তাকে বললাম এটি টেক ওভার করো। তুমি যদি মনে করো, এর নাম চেঞ্জ করতে হবে, তাহলে নাম চেঞ্জ করো। ও বলে, নাম চেঞ্জ করার দরকার নেই। মুক্তমনা ইজ আ ভেরি গুড নেম। তারপর ২০০১ সালে সে ডেভোলপড আ ওয়েব সাইট, বাংলা-ইংরেজী ব্লগ, অ্যান্ড ইট বিকাম আ ভেরি পপুলার সাইট। সেটি এখনো পপুলার।’
‘মুক্তমনা পপুলার হওয়ার পেছনে একটি আইডিয়া আছে। এক হলো- এরা কট্টর মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট নয়। আবার এরা রিলিজিয়াসও নয়। এর মাঝামাঝি… এদের আদর্শ হচ্ছে- সেক্যুলারিজম। আর লিবারেল ডেমোক্রেসি। এইটি হচ্ছে এর মূল। আর বিজ্ঞান চেতনা তো আছেই। এভরি ওয়ার্ল্ড ইভেন্ট, তারা চেষ্টা করলো, সবকিছু ব্যাখ্যা করতে, ইন সায়েন্টিফক লজিক। এ জন্যই এটি পপুলার হয়েছে। সারা বিশ্বে বহু লোক এর সঙ্গে জড়িত। এই ওয়েবসাইটের স্পেসটা একজন আমেরিকানের দেয়া। লেভিন বোধহয় ভদ্রলোকের নাম, ভুলে গেছি। সারাবিশ্বে হাজার হাজার এর পাঠক। রিচার্ড ডকিন্স নামে একজন বায়োলজিস্ট, তিনিও এর সঙ্গে জড়িত।’
অজয় রায় বলেন, ‘মুক্তমনা একটি আইডিয়া। এটি ব্লগারদের খুন করে নস্যাৎ করা যাবে না। মানুষের স্বাধীন ভাবনার স্বকিয়তা কখনোই কেউ চাপিয়ে দিয়ে বন্ধ করতে পারবে না। এটি সম্ভব নয়। তাই মুক্তমনার সংগ্রাম চলবেই।’
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/বিআর/এসএ
- See more at: http://bangla.newsnextbd.com/article188200.nnbd/#sthash.pyxxT2xN.dpuf
___
সংযুক্ত: ০১. ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, অভিজিৎ হত্যার বিচার টপ-প্রায়োরিটি’ (ভিডিও) [লিংক]
০২. ‘খুন করে মুক্তমনা নস্যাৎ করা যাবে না’ (ভিডিও) [লিংক]
No comments:
Post a Comment